বিস্ময়বস্ত্র

>সেলাইবিহীন বস্ত্র ক্ল্যাসিক ড্রেপিংয়ের এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত। পাঁচ হাজার বছর পেরিয়ে জড়িয়ে বা পেঁচিয়ে কাপড় পরার রীতিটি আজও স্বমহিমায় উজ্জ্বল। বাঙালির বিস্ময়বস্ত্র নিয়ে লিখেছেন শেখ সাইফুর রহমান।
শিল্পী জয়নুল আবেদিনের চিত্রকর্ম ‘প্রসাধন’
শিল্পী জয়নুল আবেদিনের চিত্রকর্ম ‘প্রসাধন’

কোনো দেশের পরিচ্ছদধারা গড়ে ওঠে মূলত সেই দেশের ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ওপর নির্ভর করে। এর সঙ্গে সময়ের নানা বাঁকে যোগ হয় বিচিত্র উপাদান। সেগুলোর ক্রম-আত্মীকরণে গড়ে ওঠে নতুন নতুন ট্রেন্ড।

বাংলাদেশের মূল পোশাক সংস্কৃতিও এর বাইরে নয়। বাংলাদেশের পোশাক-প্রসঙ্গের আলোচনায় অবশ্যই উপমহাদেশীয় পোশাকধারা প্রণিধানযোগ্য হবে। কারণ, এই অঞ্চলজুড়েই ছিল সেলাইবিহীন পোশাকেরই চল। কাপড় পরা হতো জড়িয়ে বা পেঁচিয়ে। একেই আধুনিক ফ্যাশন আর স্টাইলের ভাষায় বলা হয়ে থাকে ‘ড্রেপিং’। রোমান রাজা-রাজড়াদের ভাস্কর্যে চোখ রাখলে আমরা অসাধারণ সব ড্রেপিং দেখে থাকি। এটা হালে ডিজাইনারদের নানাভাবে প্রাণিত করছে পোশাক নকশায়। সারা বিশ্ব থেকে হারিয়ে গেলেও এই উপমহাদেশে রয়ে গেছে ড্রেপ করে কাপড় পরার চল। এর অনবদ্য উদাহরণ শাড়ি আর ধুতি। বাংলাদেশে ধুতি খুব কম দেখা গেলেও ভারতে সেটা রয়েছে। 

এই অঞ্চলের পোশাক সংস্কৃতির স্বরূপ আলোচনার আগে একটু ইতিহাসের পথে হাঁটলে মন্দ হয় না। ভূতত্ত্ববিদদের ইদানীংকার গবেষণা বলছে, বঙ্গের মূলভূমি গড়ে উঠেছে ১০-২৫ লাখ বছর আগে। যদিও এই ভূখণ্ডে মানুষের বাস কবে থেকে, এখনো তা অজানা। এরই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার দেগঙ্গা থানায় আবিষ্কৃত প্রত্নক্ষেত্র চন্দ্রকেতুগড় এই অঞ্চলের ইতিহাসে নতুন আলো ফেলেছে। ইতিহাসবিদদের অনুমান, পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন মহেঞ্জোদারো আর হরপ্পার সমকালীন এই জনপদে ছিল সমৃদ্ধ সভ্যতা। তখন অবশ্যই এই অঞ্চলকে বঙ্গ বলা হতো না। বঙ্গ বা বাংলার নাম নিয়েও রয়েছে নানা অভিমত। এখানে বলা দরকার, মধ্য এশিয়া থেকে আসা আর্যরা ভারতবর্ষে যে দুটো অঞ্চলে সুবিধা করতে পারেনি তার একটি দাক্ষিণাত্য আর অন্যটি এই নদীবিধৌত সমতট। এই এলাকা আগে থেকেই ছিল আলোকিত—শিক্ষাদীক্ষা, অশন-বসনে। কাশ্মীরি কবি ক্ষেমেন্দ্রের হাজার বছর আগে লেখা দশোপদেশ গ্রন্থেও মেলে কেতাদুরস্ত বাঙালির বর্ণনা।

ইতিহাসের আলোয়
ইতিহাসের পথে হেঁটে এই ভূখণ্ডের দূর-অতীতের পোশাক সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার সুযোগ প্রায় নেই–ই। ভরসা বলতে গেলে বিভিন্ন প্রত্নক্ষেত্র থেকে পাওয়া খোদাইচিত্র, ফলক, মূর্তি ইত্যাদি। কালের সাক্ষী এসব স্মারক প্রত্নবস্তু, বাংলাদেশের পাহাড়পুর কিংবা চন্দ্রকেতুগড়ের শিলালিপি আর ফলকে চোখ রাখলে অনেক প্রশ্নেরই মীমাংসা মেলে। স্পষ্ট ধারণা মেলে তখনকার পোশাক সম্বন্ধে। নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাই সেই সময়ে পরেছে এক খণ্ড সেলাইবিহীন কাপড়। পুরুষেরটা ছিল দৈর্ঘ্য-প্রস্থে খাটো; আর নারীর উভয় দিকে বিস্তৃত। পুরুষের এই কাপড়ই ধুতি আর মেয়েদের শাড়ি। যদিও তখন এর কী নাম ছিল বা আলাদা কোনো নাম ছিল কি না, সে বিষয়ে জানা যায় না। সেলাইবিহীন পোশাক পরার ক্ষেত্রে ড্রেপিং বা পেঁচিয়ে পরা একটি পুরোনো এবং আদি রীতি। বঙ্গসমাজে হাজার বছরের পোশাক পরার এই চর্চা এখনো টিকে রয়েছে স্বমহিমায়। ওই সময়ের পরিধানরীতিতে একটা মিল নারী–পুরুষ উভয়ের মধ্যেই ছিল—কাপড় পরা হতো নাভিকুণ্ডের বেশ নিচে। মজার বিষয় হলো, এই রীতি কিন্তু কালের নিয়মে আবারও ফিরে এসেছে আধুনিক রূপে। 

সেই সময় প্রত্যেকেরই—বিশেষত সম্ভ্রান্তদের কোমরে থাকত কটিবন্ধ। ঊর্ধ্বাঙ্গ আবৃত রাখার নিয়মিত চল তখন কোনো শ্রেণিতেই ছিল না। নারী-পুরুষনির্বিশেষে অনাবৃত রাখত শরীরের ওপরের অর্ধাংশ। ধুতির মতো করে শাড়ি পরত মেয়েরা। এই রীতি বলবৎ ছিল নিকট অতীতেও। উত্তর-বাস রচনার প্রয়োজন অনুভব করত না নারীরা। তত দিনে শাড়ি পরার স্টাইলে পরিবর্তন এল। ধুতির মতো করে কোমর থেকে নিচের অংশে অধোবসন রচনার পাশাপাশি তৈরি হলো আঁচলও। গোটা শরীরে তা জড়ানো যেত। এমনকি বক্ষবন্ধনী পরার রেওয়াজও তখন ছিল না। তবে নারী-পুরুষনির্বিশেষে প্রচুর গয়না পরত। কর্ণালংকার পরতেও দেখা গেছে পুরুষদের। এই আভরণই সৌন্দর্যবর্ধনের পাশাপাশি পরোক্ষে আবরণের বিকল্প হয়েছে। চন্দ্রকেতুগড়ের ফলক এ বিষয়কে স্পষ্ট করে। এই রীতি বালি দ্বীপ এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় কিছু দ্বীপে আজও অনুসৃত হচ্ছে। 

পরবর্তীকালে ঊর্ধ্বাংশ আবৃত করার জন্য নারী তো বটেই, পুরুষও বাড়তি এক খণ্ড বস্ত্র ব্যবহার করত। কখনো তা হয়েছে শীত থেকে রক্ষার, কখনো বা লজ্জা নিবারণের জন্য। এখানেও দেখা যায় শ্রেণিভেদ। কারণ এই ঊর্ধ্বাঙ্গের বসন পরতে দেখা যেত অভিজাতদেরই। পুরুষদের বেলায় এই এক খণ্ড কাপড়কে বলা হতো উত্তরীয় আর মেয়েদের ক্ষেত্রে তার নাম ছিল ওড়না। 

ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানিজ ছবিতে শাড়ির মতো পোশাকে হাজির হয়েছিলেন অড্রে হেপবার্ন, ১৯৬১। ছবি: সংগৃহীত
ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানিজ ছবিতে শাড়ির মতো পোশাকে হাজির হয়েছিলেন অড্রে হেপবার্ন, ১৯৬১। ছবি: সংগৃহীত

বস্ত্রবৃত্তান্ত
বাংলার তন্তুবায় সম্প্রদায় সমাজের শ্রেণিভেদ অনুযায়ী বয়ন করত বিভিন্ন মানের কাপড়। কার্পাস, রেশম ও পাট—তিন ধরনের সুতাই ছিল বস্ত্রবয়নের মূল উপকরণ। রেশমি কাপড়কে বলা হতো কৌষেয় বসন। বদ্বীপের অতুল্য এই বস্ত্র কেবল ভারতবর্ষ নয়, বাইরেও খ্যাতি লাভ করেছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, গ্রিক পেরিপেরাসের বই এবং আরব বণিক সুলেমানের সূত্রে পাওয়া তথ্য আমাদের বিশেষভাবে গর্বিত করে। সে সময় সোনা ও রুপার জরি ব্যবহৃত হতো শাড়ি বা কাপড় বোনায়, এমনকি রত্নখচিত কাপড়ও বোনা হতো। এই বিশেষ ধরনের বস্ত্র পরিচিত ছিল অংশুক বা দ্যুতিময় কাপড় হিসেবে। বিগ্রহপালের আমগাছিলিপিতেও উল্লেখ রয়েছে এই কাপড়ের। এদের আবার ছিল নানা মনোহর নাম—মেঘউদুম্বর, গঙ্গাসাগর, লক্ষ্মীবিলাস, দ্বারবাসিনী, সিলহটি, গাঙ্গোরি ইত্যাদি। কাদম্বরীর কবি বাণভট্ট তাঁর নায়িকাকে স্বচ্ছ বসন পরিয়ে রমণীয় করে তুলেছেন। তাঁর বয়ানে সেই কাপড় ‘নিশ্বাস-হার্য’ ও ‘নির্মোঘ শুচিলা’। এ কাপড় যেন সাপের খোলস, এতটাই হালকা যে নিশ্বাসের সঙ্গে উড়ে যায়। এই মহার্ঘ বসনে আবৃত হতে দেখি বাণভট্টের নায়িকা কাদম্বরীকে। এসব কি আমাদেরই মসলিন নয়? লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামের মসলিন দেখে সেটি মনে হওয়া অবান্তর নয়। ইতিহাসও কিন্তু এখানে সরব। কারণ, মিসরের মমির গায়ে জড়ানো কাপড়ও যে মসলিন, সে প্রমাণও মিলেছে।

বাংলার অনিন্দ্যসুন্দর কাপড়ের মুগ্ধকর বর্ণনা আরও পরে পাওয়া যায় চৈনিক পরিব্রাজকদের কাছ থেকে এবং মার্কোপোলোর লেখাতেও। 

ইতিহাস বলছে, আজকের সভ্যতাগর্বী পশ্চিম অর্থাৎ ইউরোপ ও আমেরিকা যখন গুহাবাসী, বাঙালি তখন তুলা চাষ করত। শুধু তাই নয়, সেই তুলা থেকে হাতে কেটে তৈরি করা সুতা দিয়ে উৎকৃষ্ট মানের কাপড়ও বুনতে পারত তারা। 

এক্ষণে মসলিন নিয়েও বলা যেতে পারে দু-চার কথা। আমাদের গাজীপুরের কাপাসিয়া নামটি এসেছে কার্পাস থেকে। উৎকৃষ্ট মানের কার্পাসের আবাদ হতো এখানে। সেই তুলায় হাতে কাটা সুতা থেকে তৈরি কাপড়ই মসলিন। ঢাকাতেই বোনা হয়েছে ২০-২২ ধরনের মসলিন। এই কাপড়কাব্যই ইউরোপীয় বণিকদের ভারতবর্ষে টেনে এনেছে যৌক্তিক কারণে। এ কাপড় প্রথমে রপ্তানি হতো আরব বণিকদের মাধ্যমে। সূক্ষ্মতার কারণে তারা একে বাতাসের সুতোয় পরিদের বোনা কাপড় হিসেবেও আখ্যায়িত করেছে। মোগলসম্রাজ্ঞী নুরজাহান ছিলেন মসলিনের বিশেষ অনুরক্ত। একসময় ইউরোপীয় ললনারা অপেক্ষায় থাকতেন মসলিনের জন্য। নইলে তৈরি হবে বিয়ের গাউন। মসলিনেরই একটি ধারা হলো জামদানি, আজও টিকে আছে যার বয়নসৌকর্য। 

জামদানির জন্ম সম্রাট জাহাঙ্গীরের জমানায়, সপ্তদশ শতকে। পারস্য থেকে আসা বয়নশিল্পীদের কল্যাণেই উদ্ভব এই বয়নপদ্ধতির। একে বলা হয় ফিগারড মসলিন বা ফুলতোলা মসলিন। বিশ শতকের আগ পর্যন্ত জামদানি ছিল সাদা জমিনে সাদা ফুল। ১৯০০ সালের পরে এসে জামদানিতে রঙের উপস্থিতি দেখা যায়। এই উদ্ভাবনের নেপথ্যে ছিলেন ঢাকার শৌখিন নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। সুতি জামদানির পাশাপাশি রেশম ও সুতি সুতা দিয়ে জামদানি বুনিয়েছেন তিনি। তখন এই শাড়িটি বিশেষ জনপ্রিয়তাও লাভ করে। 

পরিধানরীতি
সভ্যতার সমৃদ্ধি, নগরজীবনের উন্মেষ, সংস্কৃতি আর আদর্শই মেয়েদের—ক্ষেত্রবিশেষে পুরুষেরও—শরীর আবৃত করতে উৎসাহী করেছে। ফলে একসময় সমাজের অভিজাতদের মধ্যে শাড়ির সঙ্গে চোলি বা স্তনপট্টের সংযোজন লক্ষ করা যায়। বস্ত্রবয়নে এই অঞ্চলের মানুষের কুশলতা ছিল বহু আগে থেকেই। কাপড়ে সূক্ষ্মতা ও স্বচ্ছতা অনেক আগেই দেখা গেছে এখানে। আবার এখানকার মানুষের পোশাক রুচিও উৎসাহিত করেছে বয়নশিল্পীদের। তবে আজকের মতো শ্রেণিভেদ ছিল তখনো। আর ছিল সংগতির সীমারেখা। তাই সাধারণ নারী-পুরুষের জন্য বরাদ্দ ছিল মোটা কার্পাস বস্ত্র। 

পুরুষের দেহের ওপরের অংশে সেলাই করা পোশাক উঠেছে তুর্কিদের কল্যাণে। তারাই ইজের পরানো শুরু করে। পোশাকটি পরতে হতো নিচের দিকে দড়ি গিঁট দিয়ে। 

বস্তুত, পৃথিবীর সব সভ্যতাতেই নতুন কোনো কিছু রাজা-রাজড়ারা প্রথমে প্রচলন করেন। পরে সেটি উন্নীত হয় আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে এবং আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে সাধারণের জীবনে। এই ‘ট্রিকল ডাউন থিওরি’র ব্যত্যয় পোশাক ও এর পরিধানরীতিতেও দেখা যায় না। ফ্যাশনের সঞ্চালন আসলে এভাবেই হয়ে এসেছে। এখনো আমরা সেই ঐতিহ্যের মধ্যেই রয়েছি। তবে রাজা-রাজড়াদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে অভিজাতরা। আর সমাজের মধ্যবিত্তরা সব সময়েই থেকেছে রক্ষণশীল। এরা তাই নতুন কিছুকে মেনে নেয় না; কিংবা চট করে খাপ খাইয়ে নিতে তাদের কিছুটা সময় লাগে।

গ্রিক মূতি, প্রাচীন গ্রিসে পুরুষেরাও জড়িয়ে–পেঁচিয়ে কাপড় পরতেন
গ্রিক মূতি, প্রাচীন গ্রিসে পুরুষেরাও জড়িয়ে–পেঁচিয়ে কাপড় পরতেন

সময়ের পটবদল
সময়ের পটবদলে অনেক কিছুতেই পরিবর্তন ঘটে। আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক গতিশীলতা এসব বদলের দোসর হয়। ঠিক এভাবেই ধুতি হিন্দু-মুসলমানের অভিন্ন পোশাক হলেও তার ঝুল বাড়ে। পরার স্টাইল হয়ে ওঠে আকর্ষণীয়। ঘটে পরিমার্জন। ধীরে ধীরে মোগলদের সাম্রাজ্য বিস্তার আমাদের পোশাক-সংস্কৃতিকে বিস্তর প্রভাবিত করতে থাকে, যার প্রভাবে ব্যাপক পরিবর্তন আসে মেয়েদের পোশাকেও। পোশাকটি হয়ে উঠে বর্ণবিভোর। শাড়িতে সেসব রং বিভা ছড়ায়। প্রচলন ঘটে লাল ডোরে শাড়ির। রাধার নীল শাড়ি মাথা ঘোরালেও লাল শাড়িই বাঙালি নারীর চিরকালের প্রিয়। আজও এই রুচিতে ছেদ পড়েনি।

এ সময়ই বঙ্গ নারীরা আরও ফ্যাশনেবল হয়ে ওঠেন। অভ্যস্ত হন অন্তর্বাসের অন্তরঙ্গতায়। সে সময় এই বক্ষবন্ধনীর আদল ছিল চোলি বা কাঁচুলির মতো। এক খণ্ড কাপড়। লিনেন। সামনে থেকে টেনে এনে গিঁট দিয়ে বাঁধা হতো পিঠে।

ব্রিটিশ আমলে অভিজাত বঙ্গললনাদের অন্তরালবর্তী হওয়ার একটি কারণ ছিল বাংলাদেশের তাঁতে বোনা কাপড়। স্বচ্ছতার কারণে তা যেমন করেই পরা হোক না কেন, শরীরের রেখা দৃশ্যমান হতো। ১৮৫১ সালে ফ্যানি পার্কসের ওয়াস্কারিংস অব আ পিলগ্রিম ইন সার্চ অব দ্য পিকচারেস্ক বইতে ধনী ও অভিজাত নারীদের যে বর্ণনা রয়েছে, সেখানেও শাড়ির সঙ্গে পেটিকোট বা ব্লাউজ দেখা যায় না। আবার ১৮৬৩-৬৪ সালে প্রকাশিত আক্কেলগুড়ুম গ্রন্থে রাজকুমার চন্দ্র লিখেছেন বাংলার অনন্য সাধারণ বয়ন নিয়ে।

ইংরেজদের আসার আগেই এ দেশে এসেছিল পেটিকোট, তখন নাম ছিল শায়া। মরিচ আর লাউচিংড়ির মতো এই ‘শায়া’ শব্দ এবং আন্ডারগার্মেন্টটি এ ভূখণ্ডে আসে পতুর্গিজদের কল্যাণে। পাশাপাশি কাঁচুলি থেকে ব্লাউজে রূপান্তরিত হতে সময় লেগেছিল আরও কিছুদিন। সেই কৃতিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর। আইসিএস হওয়ার পর স্ত্রীকে নিজের কাছে বোম্বে (মুম্বাই) নিয়ে গিয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। বাড়ির বাইরে বেরোতে হবে, তাই ফরাসি দর্জিকে দিয়ে জ্ঞানদানন্দিনীর জন্য সেমিজের মতো একটা পোশাক বানিয়ে নিয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় পুত্র। এটাই আসলে ব্লাউজের প্রথম রূপ। কিন্তু সেটি পরতে যথেষ্ট বেগ পেতে হতো জ্ঞানদানন্দিনীকে। এই কাজে প্রতিবারই তাঁকে সহায়তা করতেন স্বামী সত্যেন্দ্রনাথ। 

পোশাকরীতিতে মোগলপ্রভাব যথেষ্ট থাকলেও সম্পূর্ণ গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসায়নি বাঙালি। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিল মেয়েরা। মূল্যবোধ বদলে যাওয়ার যুগেও তাই তারা অভ্যস্ত ছিল সনাতনি শাড়িতে। এ জন্য নবাবি কিংবা ইংরেজ আমলের গোড়ার দিকেও কোনো বাঙালি মেয়েকে শাড়ি ছাড়া অন্য পোশাকে দেখা যায়নি। সালোয়ার-কামিজ অনেক পরে এসে জনপ্রিয় হয়েছে। 

ঘরকুনো বদনাম থাকলেও বাঙালির বাতিক ছিল এদিক-সেদিক যাওয়ার। তারা কালাপানি পার হয়েছে, বার্মার (মিয়ানমার) রেঙ্গুনেও গিয়েছে। কিছু দিয়েছে, কিছু নিয়েছে। একসময় পরা হতো ইজের। ব্রিটিশ আমলে এই ইজেরের মতোই প্রচলিত ছিল বেনিয়ান। এ ছাড়া ছিল আরও একধরনের সেলাই করা জামা, যাকে আমরা এখন ফতুয়া বলি। এটি এসেছে বার্মা থেকেই। লুঙ্গিও। একটা সময় ছিল যখন আমাদের দেশে নারী-পুরুষ উভয়েই লুঙ্গি পরেছে। চট্টগ্রামের কোনো কোনো এলাকায় এখনো মেয়েদের লুঙ্গি পরতে দেখা যায়। 

থানকাপড় পেঁচিয়ে পরার রীতি আফ্রিকার কিছু দেশে রয়েছে। কিন্তু ধুতি আর শাড়ির মতো ধ্রুপদি উদাহরণ আর দুটো নেই। বরং শাড়ি এমন একটা পোশাক, যা যেকোনো বিত্ত আর বৃত্তেই সমান মানানসই। আটপৌরে জীবন, করপোরেট পরিমণ্ডল, উৎসব, উপলক্ষ, অনুষ্ঠানাদি—সবকিছুতেই দিব্যি মানিয়ে যায় শাড়ি। আমাদের মায়েরা শাড়ি পরেন কুঁচি ছাড়া। আমাদের শিশু, বালিকা, তরুণীরা বিশেষ উপলক্ষে যখন শখ করে শাড়ি পরে, তখনো তাদের অপরূপ লাগে। ঢাকায় বিদেশিনী রাষ্ট্রদূতেরা শাড়ি পরেন মাঝেমধ্যে, আমরা খুবই অনুপ্রাণিত বোধ করি। তাঁদের কিন্তু বেশ গ্ল্যামারাসও লাগে। অতএব বলার অবকাশ নেই অন্যেরা শাড়িতে বেমানান। সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্ত্রী লীলা রায়ের মতো কোনো কোনো বিদেশিনী তো আজীবনই শাড়িতে স্বচ্ছন্দ থেকেছেন। 

তবে আজকের মেয়েদের শাড়ি পরার যে স্টাইল, তা রপ্ত করতে তাদের ক্লেশ কম হয়নি। আর এর পেছনে ছিলেন ঠাকুরবাড়ির বউ-ঝিরা। কেবল ব্লাউজ নয়, শাড়ি পরার ধরন নিয়েও নানা নিরীক্ষা করেছেন জ্ঞানদানন্দিনী। আর তাঁর সঙ্গে অবদান রেখেছেন তাঁরই দুই ননদ—স্বর্ণকুমারী ও সৌদামিনী। 

সেলাই ছাড়া ১২ হাত কাপড় পরার কৌশল এবং নানা স্টাইল বিশ্ববাসীকে কেবল বিস্মিতই করে না, আদায় করে নেয় সম্ভ্রমও। রাইসা গর্বাচেভ যেমন সবিস্ময়ে বলেছিলেন, ‘সেলাই ছাড়া এক খণ্ড কাপড় কী করে যে পরা হয় তা আমি ভেবেই পাই না।’ 

বলার অপেক্ষা রাখে না, শাড়ি রমণীকে রমণীয় করে তোলে। স্থানভেদে শাড়ির রয়েছে নানা পরিধানরীতি। এর মধ্যেও ‘ফর্মাল’ আর ‘ক্যাজুয়াল’ স্টাইল ঠিকই স্পষ্ট হয়। আর পৃথিবীর যেকোনো দেশের নারীই যে শাড়িতে অনন্য হয়ে উঠবেন, তা-ও হলফ করেই বলা যায়। চারপাশে এমন উদাহরণও রয়েছে অসংখ্য। সমাজের দুই বিত্ত আর বৃত্তের দুই নারীচরিত্র কৃষ্ণকলি ও লাবণ্যের শাড়ি পরার বর্ণনায় আজও সমানভাবে মুগ্ধ হয় বাঙালি। রবীন্দ্রনাথসৃষ্ট এই দুই নারীর শাড়ি এবং সেটি পরার ধরনের মধ্যে দিয়ে সমাজের ছবিটাও কিন্তু ফুটে ওঠে ঠিকঠাকভাবে। 

আশার কথা, শাড়ি পরা কিছুটা হ্রাস পেলেও বাঙালি নারীরা শাড়ি কিন্তু ঠিকই কেনেন। তবে পরাটার বৃদ্ধি ঘটলে উপকার হবে আমাদের তন্তুবায় সম্প্রদায়ের। এ ক্ষেত্রে অফিসে সপ্তাহের একটি দিন কি ‘শাড়িদিবস’ হতে পারে না? প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, আমাদের বয়নশিল্পীদের বর্তমান প্রজন্ম কতটা পারঙ্গম সে দৃষ্টান্ত রয়েছে হাতের কাছেই। বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদ ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের যৌথ আয়োজন জামদানি উৎসব তো তারই অনিন্দ্য উদাহরণ। 

শাড়ি যখন প্রেরণা
নানা সময়ে ডিজাইনারদের পোশাক নকশার প্রেরণা হয়েছে শাড়ি। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ্য ফরাসি ডিজাইনার হিউবার্ট ডি জিভাঁশির নাম। ১৯৬১ সালে মুক্তি পাওয়া ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানিজ ছবিতে তিনি, হোলিগোলিথলি চরিত্র রূপায়ণকারী তাঁর বন্ধু অড্রে হেপবার্নের জন্যই শাটিকাপ্রাণিত কস্টিউম ডিজাইন করেছিলেন। তবে বস্ত্রখণ্ডটি শাড়ি ছিল না, ছিল বিছানার চাদর। কিন্তু তিনি পরিয়েছিলেন শাড়ির মতো করে। সেই প্রথম হলিউডে শাড়িকে নিয়ে গেলেন তিনি; পরের বছর লাইফ সাময়িকীর মে সংখ্যার এডিটোরিয়ালের জন্য আবারও শাড়িকে প্রেরণা করে অড্রের জন্য গাউন করেন জিভাঁশি। তবে এরও আগে ১৯৩০ সালের জেসেফিন বেকার শাড়ির ঘোমটাকে প্রেরণা করেন তাঁর গাউনে। তার পাঁচ বছর পর পাঞ্জাবের কাপুরথালার প্রিন্সেস কারামের জন্য শাড়ির প্রেরণায় গাউন ডিজাইন করেন বিখ্যাত ইতালিয়ান ডিজাইনার এলসা শিয়াপারেল্লি। সেই পোশাক পরে তিনি হলেন বিখ্যাত ফ্যাশন সাময়িকী ভোগ-এর প্রচ্ছদকন্যা। শাটিকাপ্রাণিত পশ্চিমা পোশাকের উদাহরণ কম নয়। বরং তালিকা যথেষ্টই দীর্ঘ। এ বছর প্রয়াত ডিজাইনার কার্ল লেগারফেল্ডও ভারতপ্রেমের নিদর্শনস্বরূপ ২০১২ সালের সংগ্রহে শাড়িকে চমৎকারভাবে তুলে ধরেন। আরমানি, লুই ভুইতো, জন গ্যালিয়ানো, ইভ সাঁ লোর, ব্যালাঁসিয়াগা, ক্রিস্তিয়ঁ দিওর, আলেকজান্ডার ম্যাককুইন, দ্রিস ভন নতেঁ, এলি সাব, ইসাবেলা মারান্ট হয়ে ভারতের সব্যসাচী মুখার্জী মায় প্রবাল গুরুংসহ শাড়িকে প্রেরণা করেছেন অনেকেই। আর সেসব পোশাক শরীরশোভিত করেছে নানা ক্ষেত্রের তারকাদের। বাংলাদেশের ফ্যাশন হাউস ক্লাবহাউজও রয়েছে এই তালিকায়। শাড়ির শিলুয়েটই হয়েছে পোশাক প্রেরণার মূল উপাদান। তাই বলে মূল পোশাক হিসেবে শাড়ির আবেদন কমেনি। হয়তো নানা পারিপার্শ্বিকতায় পরার হার কমেছে। কিন্তু শাড়ি আছে স্বমহিমায়, স্বকীয়তায়—থেকে যাবে অনাগত ভবিষ্যতেও। 

সূত্র: এ কে এম শাহনেওয়াজের বাংলার সংস্কৃতি বাংলার সভ্যতা, মোহাম্মদ হাননানের বাঙালির ইতিহাস, গোলাম মুরশিদের হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, হাকীম হাবিবুর রহমানের ঢাকা পাচাস বারাস পহ্​লে এবং এনামুল হক ও অন্যান্য প্রণীত চন্দ্রকেতুগড়: আ ট্রেজার-হাউজ অব বেঙ্গল টেরাকোটাজ।

শেখ সাইফুর রহমান: লেখক ও সাংবাদিক।