ধনঞ্জয় রাজকুমারের কবিতা
>গত ৩১ আগস্ট প্রয়াত হয়েছেন বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি কবিতার পথিকৃৎ ধনঞ্জয় রাজকুমার। কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ছাপা হলো তাঁর দুটি কবিতা। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন শুভাশিস সিনহা।
একটা ফুলের নাম
একটা ফুলের নাম বলো দেখি। একটা নদীর নাম।
দেবতার নামে দেবে এমন কিছুর নাম বলো।
জানি পারব না দিতে, আমরা তো পথের ফকির।
থাকবার ঘর নেই, মাথার ওপর নেই সূর্য।
পিতলের থালার মতন এক চাঁদ ছিল
তা–ও বাবা দিয়েছে বন্ধক। আজোবধি ফেরাতে পারিনি।
স্নান করবার নদী নেই, ছায়া পাবনেই সেই গাছ।
এক কানাকড়ি নেই তোমাকে দেবার।
এই নেই-এর গল্প আর কত শোনাব তোমাকে।
দুঃখটাকে রেখে দেব—সেটুকু জায়গা নেই বুকের ভেতর।
আনন্দটা রুয়ে দেব, নেই সেই জমি।
তৃষ্ণা নেই; কোথায় গিয়ে যে চুপি শুকিয়ে মরছে, দেখতে পাই না।
এক রাত থাকতে বলব
ঘুমাবার বিছানা কোথায়!
একটা ফুলের নাম বলো দেখি আমি চিনতে পারি কি না।
একটা নদীর নাম বলো
একদিন তো খুঁজে পাব কোথাও নিশ্চয়।
একটা ফলের নাম বলো তুমি খেয়ে স্বাদ পেয়েছিলে।
তুমি নাম বললেই আমিও যে স্বাদ পাব তার।
এক দলা নুন-ভাত খেতে যে বলব—দুফোঁটা চোখের পানি নেই।
যতক্ষণ বেঁচে আছি, নেই-এর গল্পই শুধু বলে যাব আমি।
আবার নতুন করে...
আকাশ-আঁচল থেকে খসে পড়ে এতটুকু আলো, দীন প্রকৃতির সামনে ভাতের থালার মতো। কামনার ঠোঁটে শুদ্ধ এক ফোঁটা জল। আহ্! পিপাসা মিটিয়ে দাও, হে করুণাময়ী। ওই কেশগুচ্ছ থেকে জন্মান্তরের সুবাস ভেসে আসুক এমন থরথর-কাঁপা মুহূর্তগুলোতে। কী কথা যে বলেছিলে, ফের তুমি বলো হে ফিয়ম। আমাদের তুচ্ছ হাহাকার আর বেআবরু ক্ষুধা-তৃষ্ণার মূল্য কী-বা আছে! রুক্ষ দুই চোখ, চৈত্রসংক্রান্তির না-লেপা উঠান, রোদে পোড়া মন্ত্রখানি, চৌদিকের প্রাচীন শূন্যতা...আমাদের খুঁজে পায় না কেউ। যে ভোগ করেছি নিবেদন, কেউ একজন এসে গ্রহণ করুক, বাসি হয়ে যাবার আগেই কেউ এসে স্পর্শ করে যাক। আমাদের এ আকুল অর্ঘ্য দেবার তিন কদম জায়গা কেউ রাখুক মাটিতে।
শুক্লপক্ষ-কৃষ্ণপক্ষ, হৃদয়শুদ্ধির জন্য দেওয়া অর্ঘ্যটুকু, দুপুরের একা কোনো গাছে বসা পাখিটির মৃদু কণ্ঠস্বর আবার ফিরিয়ে দাও আমাদের আদি-ঊষাকাল। আমরা তা হারিয়ে ফেলেছি।
ফিয়ম : পিতৃগৃহ থেকে বিয়ের কনের জন্য দেওয়া বস্ত্রাদির ঝাঁপি।
ধনঞ্জয় রাজকুমার
ধনঞ্জয় রাজকুমারের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি, ভারতের আসামের শিলচরের পাকইরপার গ্রামে। তাঁর আসল নাম ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহ। পেশায় ছিলেন অর্থনীতির অধ্যাপক। ভারতের বরাক উপত্যকার অগ্রগণ্য এই কবি মাতৃভাষা বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ছাড়া বাংলাতেও প্রচুর লিখেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য বাংলা কাব্যগ্রন্থ ভিখারি বালকের গান ও ত্রাণশিবির। প্রায় অর্ধশত গ্রন্থের প্রণেতা ধনঞ্জয় সাহিত্যে অবদানের জন্য পৌরি, মণিপুরি থিয়েটারসহ ভারত-বাংলাদেশের অসংখ্য সংগঠনের সম্মাননা লাভ করেছেন। কবিতা ছাড়াও লিখেছেন গল্প, নাটক, প্রবন্ধ, ব্যাকরণ, শিশুসাহিত্য ও ভ্রমণকাহিনি; সংগ্রহ করেছেন মণিপুরি প্রবাদ-প্রবচন-লোককথা।
ধনঞ্জয় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষার কবিতায় সৃষ্টি করেছিলেন এক ভিন্ন ও ব্যাপ্ত কণ্ঠস্বর। তাঁর কবিতায় যেমন রয়েছে ব্যক্তির নৈঃসঙ্গ্য, নৈরাশ্য ও শূন্যতাবোধ; তেমনি তা অনেক সময়ই গড়ে তোলে এক নৈর্ব্যক্তিক যৌথ হাহাকার, যেখানে আপন প্রান্তভূমি আর জাতিসত্তার ক্রমশ হারিয়ে যাওয়া জীবনোপাচার নানান চিহ্নে–ভাষ্যে–রূপকে ফুটিয়ে তোলে এক মহাবয়ান।