সৈয়দ মুজতবা আলীর উদ্যাপন

দেশে–বিদেশে ও পঞ্চতন্ত্র: সৈয়দ মুজতবা আলীর বই
দেশে–বিদেশে ও পঞ্চতন্ত্র: সৈয়দ মুজতবা আলীর বই

জীবনকে উদ্​যাপনের মতো যাপনের প্রতি সৈয়দ মুজতবা আলীর নিদারুণ আগ্রহ ছিল, কিন্তু হাহাকার ছিল না। হাহাকার না থাকার কারণ, জীবন স্বয়ং উদ্​যাপনের বিচিত্র বর্ণিল সাজে ধরা দিয়েছিল তাঁর জীবনে। তাঁর কলম ছিল সেই উদ্​যাপিত জীবনের বিশ্বস্ত অনুকারী। 

অবশ্য যে জীবন তাঁর কলমে যাপনযোগ্য রূপে ধরা পড়েছে, তার জন্য প্রস্তুতির দরকার হয়েছে। একটা বিশেষ সময়ে জীবন যেসব আয়োজন নিয়ে ব্যক্তির সামনে সুযোগের হাতছানি হয়ে বিরাজমান থাকে, সেগুলো সাধ্যমতো গ্রহণ করার জন্য ব্যক্তির মনের জোর আর তৎপরতা দরকার হয়। মানুষ সাধারণত জীবনকে যাপন করার সুবিধাজনক অবস্থান তৈরির জন্য কাজ করে। প্রস্তুতি নেয়। সে প্রস্তুতি জীবনকে নানা সুবিধা দেয়। জীবনযাপনকে সহজতর করে। এদিকে মুজতবার বিশেষ আগ্রহ ছিল বলে মনে হয় না। তাঁর জীবনীকারেরা বলেছেন, যেসব বর্গ হাসিল করার জন্য মানুষ পরিশ্রম করে, যেমন পাণ্ডিত্যপূর্ণ সন্দর্ভ রচনা করা, লেখক হিসেবে বিশেষ ফর্মের চর্চা করে হাত পাকানো বা খ্যাতি অর্জন, কিংবা বড় পদাধিকারী হয়ে নির্দিষ্ট ছকের মধ্যে বিশিষ্ট হওয়া—সেগুলোর অনেকগুলো করার বা হওয়ার মতো গুণ তাঁর ছিল। কিন্তু দেখাই যাচ্ছে, মুজতবা সেদিকে যাননি। তিনি পরিশ্রমসাধ্য প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে গেছেন। বিদ্যা অর্জন করে পণ্ডিত হয়েছেন। বহু ভাষা এমনভাবে রপ্ত করেছেন, যেন ভাষার গভীরতর তল ব্যবহার করে সম্পর্কিত হতে পারেন বিচিত্র জনগোষ্ঠীর সঙ্গে। বিচিত্র সংস্কৃতি ও জীবনধারার সঙ্গে অনায়াসে মিশে জীবনযাপন করতে শিখেছেন। কিন্তু তাঁর রচনায় বা উচ্চারণে আমরা সে পরিশ্রমের কোনো প্রত্যক্ষ নিশানা দেখি না। আমরা ওই অর্জিত প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে জীবন তিনি যাপন করেছেন, তার প্রত্যক্ষতা দেখি। 

মানুষের জীবন বর্ণাঢ্য হলেই তা উপস্থাপনযোগ্য হয় না। ব্যক্তিগত ভোগ-উপভোগের কাহিনিমাত্রই যে মূল্যবান হয়ে উঠবে এমন নয়। যে জীবনাভিজ্ঞতা একটি জনগোষ্ঠী বা বিশ্বমানবের জীবনধারার কোনো নিগূঢ় বৈশিষ্ট্য নিজের করে নিতে পারে, কিংবা অন্তত এ রকম দাবি করতে পারে যে এই অভিজ্ঞতার মধ্যে সমষ্টির কোনো নির্যাস ধরা পড়েছে, তা-ই আসলে উপস্থাপনযোগ্য হয়ে ওঠে। এ অর্থে যে এ ধরনের উপস্থাপনার মধ্যে অন্যের সম্পৃক্ত হওয়ার উদার আমন্ত্রণ থাকে। সৈয়দ মুজতবা আলী এ রকম উদ্​যাপনযোগ্য জীবনযাপন করেছেন। আবার সেগুলো বলে, অর্থাৎ লেখার মাধ্যমে ‘বলে’, দ্বিতীয়বার উদ্​যাপন করেছেন। পাঠক হিসেবে আমরা এই দ্বিতীয় উদ্​যাপনের স্বাদ পেয়েছি। বলে রাখা দরকার, এই দ্বিতীয় উদ্​যাপন বা লেখার মাধ্যমে বলার মধ্যেও মুজতবা নিজে হাজির থেকেছেন পুরোপুরি। মুজতবার লেখা তাঁর নিজের মূর্তিমান উপস্থিতি ছাড়া হয়ে উঠত না। 

এভাবে দেখলে আমরা বুঝব, মুজতবা একজন রম্যলেখক বা হাস্যরসাত্মক কথামালার কারবারি—এ পর্যন্ত বললে আসলে তাঁর শিল্পীসত্তার নিগূঢ় পরিচয় সম্পর্কে কিছুই বলা হয় না। এ কথা সত্য, মুজতবা কথাজনিত হাস্যরসের ওস্তাদ, আর আচরণজনিত হাস্যরস জোগানোর কলাও তাঁর ভাঁড়ারে বিস্তর। তিনি নিজে সুকুমার রায় সম্পর্কে একবার বলেছিলেন, সুকুমার রায় দুনিয়ার রসসাম্রাজ্যের একমাত্র ব্যক্তি, যিনি কোনো অবলম্বন ছাড়াই, অর্থাৎ সংলাপ এবং আচরণের প্রত্যক্ষ সাহায্য ছাড়াই আমদানি করতে পারেন অলৌকিক হাসির সম্ভার। মুজতবার নিজের ক্ষেত্রেও সে কথা খাটানো যেতে পারে। বলা যায়, হাস্যরস উৎপাদনের যেসব ধ্রুপদি কলাকৌশল দুনিয়ার মানুষ বহুকাল ধরে দেখে আসছে, মুজতবার তহবিলে সেগুলোর প্রস্তুত জোগান দেখি। শ্লেষ বা বিদ্রূপ তাঁর রচনায় তুলনামূলক কম হলেও যথেষ্ট আছে। আর যাকে আমরা ‘হিউমার’ ও ‘উইট’ নামে চিনি, সে ধরনের হাস্যরসের তো তিনি সম্রাট বিশেষ। বাখতিন হাসির মধ্যে যে রাজনৈতিকতা আবিষ্কার করেছেন, বা ক্ষমতা-সম্পর্কের প্রতিষ্ঠিত ছকগুলো হাসির আবহে যেভাবে ভেঙে পড়তে দেখেছেন, সে বস্তু মুজতবার সম্ভারে বোধ হয় কম। বস্তুত, মুজতবা তুলনামূলক কম রাজনৈতিক, আর ক্ষমতা-সম্পর্কের অসমতা সম্পর্কে তুলনামূলক কম আগ্রহী। কিন্তু তাঁর রচনাসম্ভারে আছে আরও অনেক কিছু। আছে কলাকৌশল, আছে বিচিত্র হাস্যকলার বিচ্ছুরণ। এই কলার তালিকা প্রণয়ন করে যদি কোনো বিবরণী তৈরি করা হয়, তাহলে তা মুজতবার লেখার জগৎ সম্পর্কে খুব সামান্যই প্রকাশ করবে। তাঁর হাস্যরসের গোড়ায় আছে ওই উদ্​যাপন; আর তার কেন্দ্রে আছে উদ্​যাপনকারী ব্যক্তি। বলা যায়, রস ও রসিকতা যেভাবে যাপিত জীবনের মধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে, কিংবা আরও ভালো হয় বললে, যেভাবে তা উপভোগের সীমানায় এসেছে, মুজতবার লেখায় তার অর্গানিক উপস্থাপন দেখি। ব্যক্তিকে বিয়োগ করে সে রসসাম্রাজ্যের তল পাওয়া যাবে না। 

ব্যাপারটা আরেকটু বিচরে দেখার জন্য আমরা বুদ্ধদেব বসুর সাহায্য নিতে পারি। বসু আত্মজীবনীতে পরিষ্কার করে বলেছেন, যা কিছু উপভোগযোগ্য, জীবনের দেখা বা কুড়িয়ে পাওয়া যা কিছু তাঁকে বিশেষভাবে আনন্দিত করেছে, তা তিনি অন্যের জন্য উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। বসুর লেখালেখি তাঁর এ কথার অভ্রান্ত সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন তাঁর দেখা বা পাঠের অভিজ্ঞতাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এমনকি তিনি উপস্থাপনার কালে নৈর্ব্যক্তিক হতে চেয়েছেন। চেয়েছেন এমনভাবে সে স্বাদ তুলে ধরতে যেন পাঠক তাঁর নিজের সম্পৃক্ততার কোনো আঁচ ছাড়াই উপভোগের রূপটা ধরতে পারে। মুজতবা আলীর ক্ষেত্রে ঘটেছে ঠিক উল্টো। মুজতবা চেয়েছেন ব্যক্তির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আর উদ্​যাপনের ভাগ অন্যকে ‘বলতে’। ধরা যাক, তিনি ‘বাঙালি মেনু’ প্রণয়ন করবেন। বলবেন, কাসুন্দি দুনিয়ার সেরা সস। এ কথা তিনি ‘জ্ঞান’ হিসেবে উপস্থাপন করবেন না। দুনিয়ার সস-সাম্রাজ্য সম্পর্কে ভোজনরসিকদের মতো তথ্য হিসেবে উপস্থিত করবেন না। কিংবা এমনকি কোনো সন্দর্ভেরও আশ্রয় নেবেন না, যেখানে ব্যবহৃত তথ্য-উপাত্ত থেকে নিশ্চিন্তে কথাটা প্রমাণ করা যাবে। তিনি বরং এমনভাবে কথাটার নিঃসংশয় প্রমাণ দাখিল করবেন যেন পাঠক ব্যক্তিকে বিচিত্র সস উদ্​যাপনরত দেখতে পায়, তার শারীরিক-মানসিক প্রতিক্রিয়া দেখতে পায়, আর নিশ্চিত হয় যে কথাটা বিকল্পহীনভাবে সত্য। বলা যায়, খাওয়ার উদ্​যাপনটা মুজতবা অনুবাদ করে দেন লেখায়। অনুবাদে শারীরিক-মানসিক প্রতিক্রিয়াটাও হাজির রাখতে চান। আসলে তাঁর ক্ষেত্রে সেটাই মুখ্য। এ বস্তু ‘লেখায়’ ধরা পড়তে চায় না, এর জন্য ‘বলতে’ হয়। মুজতবার লেখায় আছে এই দুই উদ্​যাপন। প্রথমে ভোগের, পরে বলার। বলাটা মুখ্য। বলাতেই সুখ। ওই যে অমিয়ভূষণ মজুমদার মধুসাধু খাঁ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, গল্প বলাতেই সুখ, এমনকি শোনার চেয়েও—সে কথা মুজতবার ক্ষেত্রেও সত্য। মুজতবার ভোগটা যেমন ক্রিয়া, বলাটাও তেমনই ক্রিয়া। বলা যায়, একটি আরেকটির অনুবাদ, এবং দুটিই উদ্​যাপন। এমনকি তিনি যখন মজাটা সংগ্রহ করেন অন্যের কাছ থেকে, তখনো গুরুত্ব দেন ‘বলা’র ওপর। অন্যের বলা কথাই তাঁর কাছে মুখ্য। কথাটা আরেকটু বিশদ করা দরকার। 

মুজতবার লেখা পড়া আসলে এক বহুজাতিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়া। এই বাস্তবতাটা সেকালের কলকাতায় ছিল। ছিল শান্তিনিকেতনেও। বাস্তবে ছিল। ছিল ভাবগত অর্থেও। মুজতবা যখন কলকাতায় এবং শান্তিনিকেতনে দিনযাপন করছিলেন, বলা যায়, দিন উদ্​যাপন করছিলেন, তখন সাম্প্রদায়িক বিভক্তি এবং স্বাতন্ত্র্যচেতনা বেশ প্রবল হয়ে উঠেছে। কিন্তু এরও আগে, বিশ শতকের গোড়ায়, কলকাতা এমন এক ভাবগত কাল যাপন করেছে, অন্তত অংশত, যেখানে অস্তিত্বটা যে বহুজাতিক এবং সমন্বয়ধর্মটাই যে জরুরি ধর্ম, সে ভাবাদর্শ তুলনামূলক প্রবল ছিল। এর পরিচয় আছে নজরুলে, আছে শিখা গোষ্ঠীর তৎপরতায়, আছে বিনয় সরকারের মতো মানুষের প্রবল উত্থানে, এবং বরীন্দ্রনাথের সেকালের লেখালেখিতে। ওটাই যে সেকালের কলকাতার একমাত্র ভাব ছিল না, তার প্রমাণ পরে পাওয়া গেছে যথেষ্ট। কিন্তু লক্ষণবিচারে মনে হয়, মুজতবার মানসগঠনে ওই তুলনামূলক পুরোনো আবহের প্রতাপ ছিল। সরল করে বললে একে উদারনৈতিক মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নামে চেনা যেতে পারে। পশ্চিমা এই ভাবকলা উপনিবেশিত কলকাতায় যে রূপ নিয়েছিল, তাতে ঔপনিবেশিক শাসনের নিপীড়নটা আর বড় হয়ে বজায় থাকেনি। রাজনীতি আর ক্ষমতাসম্পর্কের মাত্রাগুলো ভাবজগতে বেশি গুরুত্ব পায়নি। প্রাচ্যবাদী চর্চার যে অংশটা ভারতীয় বা অপরাপর প্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদগুলো উদ্​যাপনযোগ্য বলে প্রচার করেছিল, তা উপভোগ করা কলকাতার ভদ্রসমাজের প্রাত্যহিক অভ্যস্ততার মধ্যে এসে গিয়েছিল। আমাদের লেখকদের মধ্যে নজরুলকে অবশ্য এ ছাঁচে ফেলা যাবে না। যা হোক, উদারনীতিবাদী সংস্কৃতিচর্চার যে রূপটা কলকাতায় বিশ শতকের গোড়ার দিকে জমে উঠেছিল, মুজতবা আলীকে বলতে পারি তার এক নিষ্ঠাবান এবং চরিত্রবান খাদেম। নিজে পূর্ববঙ্গীয় হওয়ায় এবং মুসলমান হওয়ায় তাঁর দৃষ্টির প্রসারতা আর ভঙ্গির ঔদার্য বেড়েছিল, দেখতে পাই। ফলে তাঁর জলচল হয়েছিল বিস্তর জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে। তিনি পশ্চিমে গেছেন, গেছেন প্রাচ্যেও—অর্থাৎ ভারতে। ভারতের বাইরে নিকট মধ্যপ্রাচ্য আর দূর মধ্যপ্রাচ্যেও তিনি স্বচ্ছন্দ ছিলেন। 

বলা যায়, তাঁর কালের ওই ভাবই তাঁকে এভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছিল যে বিচিত্র জাতিগোষ্ঠী আর ভাষাভাষি মানুষের মধ্যে উদ্​যাপনের যে বহু সম্ভার জমা হয়ে আছে, মানব জাতির এক কামিয়াব সন্তান হিসেবে তার সবগুলোতে ভাগ বসানোর অধিকার জন্মসূত্রেই তিনি পেয়েছেন। কিন্তু আলাদা করে সবার সঙ্গে দীর্ঘকাল বসতি করে তো সে অভিজ্ঞতার ভাগীদার হওয়া যাবে না। লোকে সাধারণত পড়ার মধ্য দিয়ে ওই অভিজ্ঞতাটা অর্জন করে। মুজতবাও যে তা করেছেন এবং করেছেন অন্য অনেকের চেয়ে বেশি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু পড়ার কথাটা নিছক জরুরি না হয়ে পড়লে তিনি বলতে চাইতেন না। তিনি বলতেন ‘বলা’র কথাটা, ‘শোনা’র কথাটা। প্রতিটি জনগোষ্ঠীই তার যাপিত জীবনের মধ্যে উপভোগের-উদ্​যাপনের নানা কেতা আবিষ্কার করে। তার রান্নাবান্না ও পরিবেশনা, পোশাকের বিচিত্র–বৈভব, হাই আর্ট এবং সর্বোপরি অবসর-বিনোদনের নানা ইন্তেজাম। জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা ও ভাষায় জমা হওয়া এসব উপাদানের উদ্​যাপিত রূপ দেখতে ও পেতে চাইতেন মুজতবা। বই তাঁর কাছে নির্ভরযোগ্য ছিল না। সে বিবরণী পরোক্ষতায় মৃতসদৃশ। তিনি উদ্​যাপনকারী ব্যক্তির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বয়ানরূপে দেখতে চাইতেন কোনো জনগোষ্ঠীর জমজমাট ভোগ-উপভোগ। দেখতে চাইতেন ‘বলা’, শুনতে চাইতেন ‘কথা’। একমাত্র আড্ডাতেই এটা সম্ভব। 

আড্ডা এ কারণেই মুজতবার প্রধান ফর্ম। এ কারণেই মুজতবাকে দেখি আড্ডায়—কলকাতায়, কাবুলে, প্যারিসে, বার্লিনে আর কায়রোয়। এ কারণেই নিশাচর শহরের প্রতি তাঁর দুর্মর পক্ষপাত। যাকে বলা যায় পাবলিক স্পেইস—জনপরিসর, সে রকম আখড়ায় তাঁর আসর জমে প্রায় রুটিনমাফিক। তাতে নানা সংস্কৃতির বহুবিচিত্র মানুষের সমাগম। আড্ডার শরিকেরা সবাই রসিক। রসের রসিক। উপভোগের রসিক। তথ্য-উপাত্ত আর পাণ্ডিত্যে তারা টইটম্বুর। কিন্তু মুজতবার আড্ডায় তথ্য আর পাণ্ডিত্য ভার হয়ে আসে না। প্রতিহত করে না। কারণ, সেখানে উপভোগের সাদর আমন্ত্রণ আছে। প্রধান শরিকদের পাশে আরও অনেকেই আছে। তারা কথা বলে না। কিন্তু আড্ডার রস উদ্​যাপনে কোনো বাধা নেই। এরাই মূলত পাঠক। মুজতবার লেখা পড়া মানে আড্ডার সজীব সপ্রতিভ কথামালার অংশীদার হওয়া। 

মুজতবা এমন জমানার মানুষ, যখন কলকাতায় ‘সংস্কৃতি’ একটি উচ্চতম বর্গ হিসেবে পরম প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ওই সংস্কৃতি-ধারণায় সংকীর্ণতা ছিল, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছিল। মুজতবা এই সংকীর্ণতা ও বিদ্বেষ ভাব থেকে বেশ অনেক দূর পর্যন্ত মুক্ত ছিলেন। তখন ভারতীয়রা কেবল আর পশ্চিমের কথা শুনছিল না, পশ্চিমকে ভারতের কথাও শোনানো শুরু করেছিল। মুজতবা নিজের আবিষ্কৃত আড্ডার ফর্মে একজন ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নিতেন। তাতে হীনম্মন্যতার লেশমাত্রও ছিল না। ছিল বহুজাতিক অভিজ্ঞতার মধ্যে নিজের হিস্যা উপস্থাপনের আর আদায়ের সক্রিয়তা। উদারনৈতিক ভাব-পরিসরে নিজেকে মজলিসি কেতায় উদ্​যাপনের ভঙ্গিতে হাজির করতে পেরেছিলেন বলেই সহস্র ভ্রমণকাহিনি আর রম্য রচনার ভিড়ে মুজতবাকে সহজেই চিনে নেওয়া যায়।