সৈয়দ আইয়ুবের কাবুল যাত্রা

>

সৈয়দ মুজতবা আলী (১৩ সেপ্টেম্বর ১৯০৪—১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪), প্রতিকৃতি : মাসুক হেলাল
সৈয়দ মুজতবা আলী (১৩ সেপ্টেম্বর ১৯০৪—১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪), প্রতিকৃতি : মাসুক হেলাল

সৈয়দ মুজতবা আলীর জন্মদিন আজ। তাঁর একটি অপ্রকাশিত রচনাসহ দুর্দান্ত এই রসস্রষ্টাকে ফিরে দেখা।

সৈয়দ মোহাম্মদ আইয়ুব চাকরি লইল কাবুলে। বাঙালি চাকরি করিতে যায় পশ্চিমে, জোর বর্মায়। কাবুলে যখন তাই চাকরি মিলিল, তখন দেশের পাঁচজন তাহার বুদ্ধি সম্বন্ধে নিজেদের সন্দেহ নানা বর্ণে-গন্ধে প্রকাশ করিলেন। আইয়ুব দমিল না। যে ব্যক্তির গৃহে পত্নী কিংবা মাতা নাই, তাহার পক্ষে গৃহই–বা কি, অরণ্যই–বা কি। চাকরি যদি করিতে হয় তো কাবুলেই–বা কি, কোয়াম্বাটোরেই–বা কি।

পেশোয়ার পর্যন্ত রেলগাড়িতে কাটিল। বৈচিত্র্যহীন একটানা গাড়ির শব্দ, স্টেশনে স্টেশনে আস্তে আস্তে ভাষার পরিবর্তন। আইয়ুব কল্পনা–সাগরে ডুব দিল। বৈচিত্র্যহীন বাঙালিজীবনের সঙ্গে তিন বছরের মতো হিসাব-নিকাশ চুকাইয়া দিয়া রোমান্সে ঢুকিবে। প্রকাণ্ড উচ্চ কাবুলির পাগড়ি, মোহাম্মদ ঘোরির অস্ত্রের ঝনঝনা, নাদির শাহের তখতে তাউস, পাহাড়ের পেছনে গুড়ুম শব্দ, একটুখানি ধোঁয়া নীলাকাশে সাদা পাখির মতো—চিৎকার ইয়া আল্লাহ, তড়াক তড়াক উন্মত্ত ঘোড়ার দৌড় খুনিকে ধরিবার জন্য, পথপ্রান্তে কাবুলি মেয়ে ঘোমটা খুলিয়া বসিয়া ছোরাতে শাণ দিতেছে—সমস্ত জানটা একেবারে গরম হইয়া উঠিল—এই রোমান্সের ভিতর সে না কোনো ডাকাতের দলের পিছনে ঘোড়া ছুটাইবে, না কোনো সরদারজাদির বরমাল্য পাইবে।

পেশোয়ারের গরমে আর্ধেক রোমান্স কাটিয়া গেল। কাবুলে যাইবার জন্য মোটরস্টেশনের ঠেলাঠেলিতে না আছে রোমান্স, না আছে শিভালরি, আছে শুধু সীমান্তের কাবুলিদের গায়ের বোটকা গন্ধ। অনেক কষ্টে সিট মিলিল একটা বাসে, তাতে সবসুদ্ধ ১৪ জন আরোহী। ড্রাইভার পাঞ্জাবি শিখ। নিরীহ বাঙালির চেহারা দেখিয়া বাবু সাহেবকে তাহার পাশে বসিতে বলিল। আইয়ুব বসিয়া গেল। ১২০ ডিগ্রি গরমে যদি ১২ জন কাবুলিওয়ালার সঙ্গে বাসের ভিতর ২০০ মাইল বন্ধ হইয়া চলিত, তাহা হইলে সে নির্ঘাত মারা যাইত। ড্রাইভারের পাশে বসিলে আর কিছু হোক না হোক, হাওয়া তো মিলিবে।

খাইবার পাসের ভিতর দিয়া মোটর চলিয়াছে। বসিয়া বসিয়া আইয়ুব ভাবিতে লাগিল, এই পথ দিয়াই সেকান্দার শাহের সেনানী আসিয়াছিল, এই পথের উপরই মোহাম্মদ ঘোরির তলোয়ার চমকাইয়ছিল, বাবর আসিয়াছিল, তৈমুর আসিয়াছিল, নাদির আসিয়াছিল—তারও বহু পূর্বে কোনো অজানা যুগে রাজকুমারী গান্ধারী সোনার তানজিমে করিয়া এই পথ বাহিয়াই দিল্লি গিয়াছিলেন। বালিকা বধূর চোখের জল, বাবরের ঘোড়ার খুরের আগুন, তৈমুরের বক্র ছোরার ঝলক আইয়ুব যেন চোখের সামনে দেখিতে লাগিল। দুই দিকে দৈত্যের ন্যায় উচ্চ কৃষ্ণ পর্বত, তরুহীন, পতঙ্গহীন উলঙ্গ ভীম কারাগারের পাষাণ প্রাচীর। তাহার উপর সূর্যরশ্মি যুগ যুগ ধরিয়া দগ্ধ করিতে করিতে যেন আগুন করিয়া তুলিয়াছে। দুই পাশে আফ্রিদিরা বন্দুক ঘাড়ে করিয়া চলিয়াছে, তাহাদের ঘনকৃষ্ণ দাড়ি, ঝোলা ঝোলা সালোয়ার, প্রকাণ্ড দেহ, তামার মতো রং। কোনো আরব্য উপন্যাসের রাজপুরীর প্রহরীর মতো চেহারা। আইয়ুব ভাবিল, আর কাহাকেও দুশমন বানাইতে রাজি কিন্তু ইহাদের নয়। ইহাদের যাহারা হারাইয়াছে, তাহাদের কথাও মনে পড়িল—তৈমুরের বাহিনী যেদিন এই পথ দিয়া ঢুকিয়াছিল, কোথায় ছিল তখন তাহারা। সে দুর্যোগ দিনে তাহারাও ত্রাসে পাতাড়ের পশ্চাতেই আশ্রয় নিয়াছিল। তৈমুরকে হাজার সালাম। 

আফগান রাজ্যে গাড়ি ঢুকিল। স্বাধীন দেশের হাওয়া লাগিত ভালো, যদি এত গরমি না হইত। ১২০ ডিগ্রি তখন। তারি মাঝে দশ মিনিট যাইতে না যাইতে গাড়ি দাঁড় করায়। পাসপোর্ট দেখাও। আইয়ুব বলে, এ তো ভারি আপদ, স্বাধীন দেশ, এতে আবার পাসপোর্টের এত গোলামি কেন? দেশে ইংরেজদের পদে পদে সালাম দিই, এ দেশে যে পাসপোর্টের কর্তাকে সেলাম দিতে দিতে ট্রাউজারের ব্রেসেস ছিঁড়িবার জোগাড়। কর্তার তনখাবিস আফগানি, বিদুনে নান (ইংরাজি ভাষায় যাহাকে without rice allowance বলা যাইতে পারে) কিন্তু লম্ফঝম্ফ দেখিলে মনে হয় আমানউল্লাহ্ সাহেব বুঝি হকিকি চাচেরা ভাই। আইয়ুব ঠিক করিল, দেশে যখন ফেরত যাইবে, তখন এমন একটা কল কপালে লাগাইবে, যাহাতে পাসপোর্টখানি ঝুলাইয়া রাখা যায়। 

ভাষার বিপদ। কাবুলি যারা, তাহাদের মধ্যে কেউ কেউ ভাঙা ভাঙা উর্দু বলিতে পারে; আশপাশের লোক বলে পশতু। একটি আরোহীর সঙ্গে আলাপ হইল। নব্যতম অক্সফোর্ড কাটের পত্​লুন জামা, মাথায় তুর্কিস্তানি পশমের টুপি। মুখের রং ফরসা, আগুনে পোড়া ইটের মতো লাল লাল গাল, পিঙ্গল চোখ সব সময় ঘুরিতেছে, যেন কাহার পকেটে কী, তাহারই সন্ধান। উর্দু বলিতে পারে কিন্তু কাবুলি উর্দু, ট বর্গের উচ্চারণ করিতে পারে না, ত বর্গের দ্বিতীয় বর্ণ বলিতে যখন চেষ্টা করে, তখন মনে হয় ভিরমি লাগে বুঝি। আইয়ুব তাহাকেই দোভাষী বানাইল। স্বাধীনতার জ্ঞান খুব টনটনে, হিন্দুস্তানি আদমি যে বড়া না মর্দ, তাদের ভিতরে যে জোশ নাই, সে বিষয়ে তিনি একেবারে বেশক্ হইয়া আছেন। আইয়ুব যখন আফগানি সেপাহির ম্লান ও ছিন্ন বেশ সম্বন্ধে নিজের মতামত খুব ভদ্র সংযত ভাষায় প্রকাশ করিতে সাহস করিল, তখন তিনি চটিয়াই লাল। তাহার লাল গাল দুটি বুঝি ফাটিয়া পড়ে। হামলোগোওঁকে সেপাহি তো লড়েঙ্গে, শাদিকি নওশে থোড়াই হাঁয়। আইয়ুব ভাবিল, ঠিকই তো, পরিষ্কার কাপড়জামা তো খোদাতালা শাদির নওশার কপালেই লিখিয়াছেন, তা না হইলে বাসের ভিতর হইতে এত উৎকট গন্ধ বাহির হইত কেন। বলিল, সাহেব, রাস্তাঘাটগুলি একটু ভদ্রস্ত কর না কেন, ঝাঁকুনিতে তো পেটের ভিতরে পেশওয়ারি রুটিও যে লুকোচুরি খেলা আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। সাহেব গম্ভীরভাবে বলিলেন, ‘সড়ক সাগর আচ্ছা বানায়ে যায়, আংরেজ আহসানিসে ঘুস জায়েগা, জহ হরবি বাত আপ হিন্দুস্তানি সমঝেঙ্গে নাহি।’ এর বিরুদ্ধে আর কথা চলে না। হিন্দুস্তানি লড়াইয়ের কী বুঝিবে! বলিতে সাহস হইল না যে হিন্দুস্তানির তাকতেই কাবুল জয় করিয়াছিল লর্ড রবার্টস। যাক, তবু তো স্বাধীন দেশ, কাউকে তো সালাম করে না, আংরেজকে না, রুশকেও না।

গাড়ির কল বিগড়াইল। সেই প্রকাণ্ড উপত্যকা, দূরে দুই পাশে ভীমকায় নগ্ন পর্বত। ক্রোশের পর ক্রোশ সামনে খোলা। তার সামনে ও অতিদূরে ছায়ার মতো কালো পাহাড়—দূরে অতিদূরে পিছনেও পাহাড়, চারিদিকেই পাহাড়, ঘাস নাই, পাতা নাই, একটি মাছিও নাই। জনপ্রাণী বলিতে এই পনেরোটি আদমসন্তান ও কাবুলিদের ইজারবন্দের ছারপোকা। গাড়ি যতক্ষণ চলিতেছিল, ততক্ষণ হাওয়ায় প্রাণ টিকিয়া ছিল, এখন তো মরিবার জোগাড়। আইয়ুব ভাবিল, মরিতে কষ্ট পাইবে সে-ই বেশি; কাবুলিদের যা প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড নৌকার মতো পা, তাতে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়াই মরিতে পারিবে—মাটিতে পড়িবে না। কাবুলি দোভাষী গম্ভীরভাবে বলিলেন, আংরেজি মেশিন (machine), তাই বিগড়ায়। যেদিন আফগান মেশিন বানাইবে, সেদিন দুনিয়ার মোটর বাজারের তলব তাহারাই পূর্ণ করিবে। দুই ঘণ্টা কাটিয়া গেল। পাঞ্জাবি শোফার হিকমত সিং তাহার সব হিকমত খরচ করিয়াও গাড়ি মেরামত করিতে পারিল না। কপালক্রমে আরেকখানা খালি ডাকের লরি আসিতেছিল। তাহারা জনপ্রতি পাঁচ আফগানির বিনিময়ে দশ মাইল দূরের একটি সরাই পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিতে রাজি হইল। হিকমত সিংয়ের হিকমত না থাকিলেও হিসাব ঠিক ছিল। বলিল, সঙ্গে যাইবে না। রাত্রিতে গাড়ি মেরামত করিয়া পরদিন ভোরে সরাইয়ে হাজির হইবে। যদি চোর–ডাকু আসে তো পরমাত্মা কি মর্জি। আফগানিস্তানে কাম করিতে যখন তৈয়ার হইয়াছে, তখন জান তো বাড়িতে রাখিয়া আসিয়াছে। কাবুলি দোভাষীটি বলিলেন, সাহেব, বিছানাটা সঙ্গে নাও, সরাইয়ে চারপাই পাইবে (ছারপোকা পাইবে বলিলেন না)। আইয়ুব হোল্ডঅল ডাক লরিতে চাপাইয়া তাহার উপরে বসিল। লরিতে ছাদ নাই—আইয়ুবের ছাতা নাই। সে গরমে খোদা পানাহ। ভাবিল, খোদা কত দূরেই না রুটি রাখিয়াছিলেন। এই গরমে সেখানে পৌঁছালেই হয়, তা না হইলে এত যে তকলিফের রুটি, সে অন্যে বাটিয়া খাইবে। স্বাধীন দেশের রুটি না খাইয়া মরিলে বেহেশতের দ্বারি যদি কাবুলি হয়, আলবত ঢুকিতে দিবে না।

সংগ্রহ ও ভূমিকা: সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

সৈয়দ মুজতবা আলীর এই লেখা বেরোয় সিলেটের কিছু তরুণ সাহিত্যানুরাগীর উদ্যোগ কিশোর নামে হাতে লেখা এক ম্যাগাজিনে, ১৩৪৯ বঙ্গাব্দের (১৯৪২ সাল) গ্রীষ্ম সংখ্যায়। একসময় বিভিন্ন বাড়িতে হাতে লেখা ম্যাগাজিনের কদর ছিল, বিশেষ করে যেসব পরিবারে স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের আধিক্য ছিল। ম্যাগাজিনটি সম্পাদনা করেছিলেন আমার বাবা সৈয়দ আমীরুল ইসলাম এবং তাঁর সহযোগী ছিলেন আমার দুই মামা, মুজতবা আলীর দুই বোনের দুই ছেলে আবু মোহাম্মদ আবদুল কাদির ও আবু নুমান মোহাম্মদ সুলেমান। এ লেখাটি মুজতবা আলী স্পষ্টতই অনুরুদ্ধ হয়ে লিখেছিলেন, এটি ক্রমশ বাকি সংখ্যাগুলোতে বেরোবার কথা ছিল। কিন্তু আমার সংগ্রহে থাকা কিশোর পত্রিকার চতুর্থ সংখ্যায় লেখাটি নেই, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যায় আছে কি না, এখন আর আমার জানার উপায়ও নেই। 

১৯৪২ সালে লেখা এই রচনা পঠিত হয়েছিল নিতান্ত পারিবারিক গণ্ডিতে। আমার জানামতে, এটি মুজতবা আলীর রচনাবলিতে পাওয়া যায়নি। সে হিসেবে একে মুজতবার অপ্রকাশিত রচনাই বলা চলে। তবে লেখাটি যে ছয় বছর পর প্রকাশিত দেশে-বিদেশের একটি অগ্রিম মুসাবিদা, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। সাধুরীতিতে রচিত এ লেখা প্রকাশের সময় এখানে সমকালীন বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে।