একজন সুন্দর মানুষ

কাইয়ুম চৌধুরী ছিলেন সুন্দরের সাধক। ছবি: অন্য আলো
কাইয়ুম চৌধুরী ছিলেন সুন্দরের সাধক। ছবি: অন্য আলো

কাইয়ুম চৌধুরী ছিলেন আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর মানুষদের একজন। ছিপছিপে দীঘল শরীর, কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা সরল-সটান চুল, সাদায়-কালোয় মেশানো সে চুলের ফ্রেমে বাঁধা সুতীক্ষ্ণ চেহারা, পোশাক-আশাকের সংযত রুচি—সব মিলিয়ে অপূর্ব এক বাহ্যিক অবয়ব। এ সৌন্দর্য আমাদের দৃষ্টির অনুভূতিকে মুগ্ধ করে রাখত। কিন্তু এ তো নিছক বহিরঙ্গ। কাইয়ুম চৌধুরীর আসল সৌন্দর্য ছিল তাঁর মাধুর্যময় মনের দীপ্তিতে। সে সৌন্দর্য তাঁর অভিব্যক্তিতে, দেহভঙ্গিমায়, আচরণে ঠিকরে বেরোত। তাঁর বহিরঙ্গ ছিল সে মনটিরই স্বচ্ছ এক প্রতিফলন। তাঁর উপস্থিতিতে আমাদের মন সহজ ও নির্মল আনন্দে ছাপিয়ে যেত। 

মুগ্ধ চোখে কাইয়ুম চৌধুরীকে প্রথম দেখার স্মৃতি এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে। সময়টা ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের একুশের বইমেলা তখনো অনেক ঘরোয়া, উষ্ণ ও নিরাড়ম্বর। সেই আড়ম্বরহীনতার মধ্যে তাই আলাদা করে চোখে পড়ে সন্ধানী প্রকাশনীর স্টল। স্টলটি দেখলে কারও বুঝতে না পারার কথা নয় কার মনের মাধুরী ওর মধ্যে মিশে আছে। কাইয়ুম চৌধুরীর পরিকল্পনায় স্বাতন্ত্র্য মিশে থাকত এতটাই। তাঁরই জলরঙে আঁকা প্রচ্ছদে সন্ধানী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী গাজী শাহাবুদ্দিন সেবারের বইমেলায় চারটি কবিতার বই এনেছিলেন। অন্য বইগুলো কাদের বা কী, তা এখন আর মনে নেই। মনে আছে শুধু শামসুর রাহমানের বইটির কথা। তাঁর মধ্যপর্বের সেরা কাব্যগ্রন্থ প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে বেরিয়েছিল সেবার। প্রচ্ছদে তখনো ব্লকের যুগ চলছে। সে সময়ে জলরঙে আঁকা খরুচে অফসেটে ছাপা প্রচ্ছদ আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল। 

সেই স্টলের সামনে, সে বইটি হাতেই কাইয়ুম চৌধুরীকে প্রথম দেখেছিলাম। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন শামসুর রাহমান আর গাজী শাহাবুদ্দিন। কাইয়ুম চৌধুরীর নাম তখন কিংবদন্তিতুল্য। আর তিনি দাঁড়িয়েও ছিলেন যেন একেবারে তাঁর যথাযথ পটভূমিতে। মন অবশ করে দিয়েছিল সে সৌন্দর্য, শিল্পের স্নিগ্ধ সৌন্দর্য। 

কাইয়ুম চৌধুরী শিল্পী ছিলেন, এ কথা নতুন করে বলা বাহুল্য ও অর্থহীন। শিল্পকর্মে নিজের কল্পনা বিনিয়োগ করেছিলেন বলেই তিনি শিল্পী ছিলেন না, শিল্পী ছিলেন নিজের জীবনে শিল্পকে উদ্​যাপন করেছিলেন বলে। আজীবন তিনি ছিলেন রূপের অনুসন্ধানী। এই দেশ, দেশের মানুষ—তাদের যাপনের প্রহর, বেঁচে থাকার আনন্দ ও স্বপ্ন নিজের কল্পনায় রঞ্জিত করে রঙে ও রেখায় তিনি আজীবন রূপ দিয়ে এসেছেন। কিন্তু এটুকুই তাঁর সবটা নয়। শিল্পী হিসেবে কাইয়ুম চৌধুরীর বিচিত্র কৌতূহল ও সক্রিয়তা কেবলই চারুশিল্পের সীমানার মধ্যে আটকে থাকেনি। সেই সুনির্দিষ্ট সীমানাটি ছাপিয়ে তা বেরিয়ে এসেছিল মানুষের জীবনযাপনের আঙিনার ভেতরে। গ্রন্থসজ্জা, পোস্টার-পরিকল্পনা, লোগো বা নেমোনিক রচনা, কোনো সাংস্কৃতিক মেলার পরিসর-ভাবনা বা স্টল নির্মাণ, পরিধেয়-পরিকল্পনা ইত্যাদি ব্যবহারিক জীবনের নানা দৃশ্যবস্তু তাঁর হাতের ছোঁয়ায় রুচিময় হয়ে উঠত। ছয় দশকের বেশি সময় ধরে এসবে ছিল কাইয়ুম চৌধুরীর প্রত্যক্ষ অবদান। বলতে গেলে, বাংলাদেশের নাগরিক দৃশ্যরুচির বিকাশে তাঁর ভূমিকাই ছিল প্রধান। তিনিই যে এ দেশের জনশিল্পের প্রধানতম অগ্রদূত, সে কথা এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। 

রঙিন মুদ্রণযন্ত্রের প্রসারের আগে, সেই ব্লক তৈরি করে প্রচ্ছদ ছাপানোর যুগে, শুধু সৃষ্টিশীল কল্পনাশক্তির জোরে সীমিত উপকরণ ও আয়োজনের মধ্যেও অপূর্ব সব মার্জিত পুস্তক তাঁর হাত দিয়ে বেরিয়েছে। বাংলা অক্ষরচিত্রণে তাঁর পটুত্ব ছিল অসামান্য। শুধু অক্ষরচিত্রণের বৈচিত্র্যেই তিনি একেকটি প্রচ্ছদের আলাদা আলাদা চরিত্র গড়ে তুলতে পারতেন। কিন্তু বই তাঁর কাছে প্রচ্ছদমাত্র ছিল না, ছিল একটা সমগ্র। ফলে প্রচ্ছদের পাশাপাশি বইয়ের বাঁধাই, পুস্তানি, পুট বা মেরুদণ্ড, ইনার বা প্রারম্ভিক কয়েকটি পৃষ্ঠা, তাতে হরফের ধরন, আকার, সজ্জা—সবই ছিল তাঁর বিশেষ মনোযোগের বিষয়। 

কাইয়ুম চৌধুরী রূপ অনুসন্ধান করেছেন এবং বিচিত্র রূপবন্ধ রচনা করেছেন। রূপের এই অন্বেষণের পেছনে ছিল তাঁর রসের জন্য তৃষ্ণার্ত একটি মন। রূপের সাধক ছিলেন বলে এই রস তিনি কেবল চারুশিল্প থেকে আহরণ করেননি। এই ক্ষেত্রে তাঁর মন ছিল একেবারে উন্মুক্ত। সাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র—প্রতিটি বিষয়েই তিনি ছিলেন তীব্রভাবে উন্মুখ। 

শিল্প-সাহিত্যের কল্পনামুখর জগতের দিকে কাইয়ুম চৌধুরীর কৈশোর উন্মীলিত হওয়ার পেছনে তাঁর বাবা আবদুল কুদ্দুস চৌধুরীর ভূমিকা ছিল। কলকাতা থেকে তাঁদের বাড়িতে আসত বিচিত্র পত্রপত্রিকা এবং সিগনেট প্রেস, দেব সাহিত্য কুটিরসহ অন্যান্য রুচিশীল প্রকাশনীর বই। সেসব বইপত্রের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ হিসেবে মুদ্রিত উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সমর দে বা প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁকা ছবি তাঁর মধ্যে শিল্পী হওয়ার বাসনা জাগিয়ে তোলে। এগুলোতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধকুমার সান্যাল, হেমেন্দ্রকুমার রায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত বা বুদ্ধদেব বসুর মতো লেখকের গল্প-উপন্যাসও তাঁর চিত্তের উদ্বোধনে মোটেই কম ভূমিকা রাখেনি। 

সংগীতের প্রতিও তাঁর ভালোবাসা ছিল দুর্বার। ১৯২১-২২ সালে কাইয়ুম চৌধুরীর বাবা যখন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র, তখন ত্রিপুরার জমিদার-নন্দন ও বাংলা গানের প্রবাদপুরুষ শচীন দেববর্মন ছিলেন তাঁর সহপাঠী। সেই সূত্রে বালকবয়স থেকেই শচীনকর্তার গানের পথ ধরে ধীরে ধীরে বিচিত্র ধরনের গানে কাইয়ুম চৌধুরীর আগ্রহ গভীর হয়ে ওঠে। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় ছিল গানের এক বিচিত্র ও বিপুল সম্ভার। গানের প্রতি এই তীব্র আবেগ বাংলাদেশে সংগীতের নানা উদ্যোগের সঙ্গেও তাঁকে গভীরভাবে যুক্ত করেছিল। 

চলচ্চিত্রের প্রতিও তাঁর ছিল দারুণ টান। ছবি দেখতেন বিচিত্র রকমের। হলিউডের ১৯৫০-৬০ দশকের স্বর্ণযুগের ছবি খুবই ভালোবাসতেন। অড্রে হেপবার্ন ছিলেন তাঁর প্রিয় অভিনেত্রী। ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানি’জ আর রোমান হলিডের এই অভিনেত্রী বাংলাদেশে বেড়াতে এলে তাঁর সঙ্গে যে আনন্দময় কিছুটা সময় কেটেছিল, সে গল্প বলতেন সলজ্জে। পশ্চিমের চিত্রশিল্পীদের জীবন অবলম্বনে তৈরি চলচ্চিত্র সংগ্রহ করতেন আগ্রহ নিয়ে। তাই বলে চলচ্চিত্রের নিছক দর্শক তিনি ছিলেন না। ঢাকায় চিত্রনির্মাণের প্রায় আদিপর্ব থেকেই—সেই মাটির পাহাড়-এর চিত্রায়ণের সময়—তিনি এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। কাজও করেছেন চিত্রনির্মাণের নানা অংশে—সহকারী পরিচালক হিসেবে, শিল্প নির্দেশনায়, এমনকি চিত্রনাট্য রচনার প্রক্রিয়াতেও। 

ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সূচিত ১৯৫০-এর দশক ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের পথরেখার অমোচনীয় চিহ্নটি আঁকতে শুরু করে। এ সময় থেকে আত্মপরিচয় হিসেবে এ দেশের মানুষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে চরিত্রটি আত্মস্থ করতে শুরু করে, দ্রুতই তা বাংলাদেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে ওঠে। চিত্রকর, সাহিত্যিক, সংগীতশিল্পী, চলচ্চিত্রকার হিসেবে এই দশকের যে তরুণদলের হাতে আত্মপরিচয়ের এ চিহ্ন আঁকা হচ্ছিল, কাইয়ুম চৌধুরী ছিলেন তাঁদের একজন। 

মুক্তিযুদ্ধ ও তার বিজয়ের মধ্য দিয়ে আত্মপরিচয়ের সেই রাজনৈতিক লড়াই একটি ঐতিহাসিক পরিণতি পায়। নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ তার এক সফল পরিণাম। কিন্তু সাংস্কৃতিক নির্মাণের তো সফল পরিণতি বলে কিছু নেই। এ এক অন্তহীন প্রবাহ। সেই সজীব প্রবাহের সঙ্গে কাইয়ুম চৌধুরীর যোগ কখনোই শিথিল হয়নি। 

নানা শিল্পমাধ্যমের প্রতি কাইয়ুম চৌধুরীর আগ্রহের কথা বলেছি। শিল্পের নানা দিকে এই সক্রিয় আগ্রহ তাঁকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। তাঁর আর যে গুণের কথাটি এখনো বলা হয়নি, সে তাঁর লেখালেখি। হাতে ছিল অপূর্ব সুষমাময় এক গদ্য, যেন শিল্পীরই যোগ্য। শেষ জীবনে, খেলাচ্ছলে প্রায় যেন বা পাবলো পিকাসোর মতো, নিজেকে মেলে ধরতে শুরু করেছিলেন কবিতায় ও ছড়ায়। কাইয়ুম চৌধুরী তো সে অর্থে কখনো সাহিত্যিক হওয়ার সাধনা করেননি, কিন্তু বিক্ষিপ্তভাবে লিখে গেছেন আজীবন। নানা প্রসঙ্গ নিয়ে লেখা সেসব গদ্যের বিষয়, এককথায় বলতে গেলে, তাঁর বিচিত্র শিল্প উপভোগ। তিনি লিখেছেন চিত্রকলা, সাহিত্য, গান, চলচ্চিত্র নিয়ে; লিখেছেন এসব শিল্পমাধ্যমে যাঁরা আমাদের মন গড়ে তুলেছেন, আমাদের সাংস্কৃতিক আকুতিকে ভাষা দিয়েছেন, যাঁরা আমাদের নায়ক, তাঁদের নিয়ে; লিখেছেন আমাদের নানা সাংস্কৃতিক উদ্যোগ, আয়োজন ও সংগ্রামের মর্ম নিয়ে। 

সেসব লেখালেখিতে শিল্প ও সংস্কৃতি নিয়ে কাইয়ুম চৌধুরীর যে সংবেদনশীল মনের দেখা পাই, তা নানা কারণে মূল্যবান। কাইয়ুম চৌধুরীকে বোঝার জন্য যেমন, বাংলাদেশের সংস্কৃতির একটি যুগের যাত্রাপথ চিনে নেওয়ার জন্যও এসব লেখার কাছে আমাদের ফিরে ফিরে আসতে হবে। 

কাইয়ুম চৌধুরী অতীতে নানা পত্রিকায় লিখেছেন। কিন্তু মৃত্যুর আগের দেড়টি দশকজুড়ে তাঁর লেখা প্রকাশের প্রায় একমাত্র বাহন ছিল প্রথম আলো। এ পত্রিকায় তাঁর বহু লেখা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। 

বস্তুত প্রকাশনার শুরু থেকে প্রথম আলো আর কাইয়ুম চৌধুরী ছিলেন অবিচ্ছেদ্য। প্রথম আলোর তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এর পাতায় পাতায় তাঁর সৃষ্টিশীল হাতের স্পর্শ লেগে আছে। তিনি এর মূল লোগো এঁকেছেন, পৃষ্ঠাসজ্জার টেম্পলেট তৈরি করেছেন, এর অজস্র লোগো ও নেমোনিক তাঁর হাতে গড়া। তাঁকে ছাড়া প্রথম আলোর কোনো ঈদসংখ্যার প্রচ্ছদ ও পৃষ্ঠাসজ্জার কথা কল্পনাও করা যেত না। প্রথম আলো ও প্রথমা প্রকাশনের নানা প্রচ্ছদ, স্টল, নিমন্ত্রণপত্র, স্টিকার, প্রচারপত্র ইত্যাদিতে তিনিই ছিলেন সর্বেসর্বা। 

 প্রথম আলোতে কাজ করার সুবাদে কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে দীর্ঘ সময় নিবিড়ভাবে কাজ করার সুযোগ হয়। ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে থাকলে কিংবদন্তিতুল্য মানুষদের অনেকেই ধীরে ধীরে ধুলো আর ছাই হয়ে পড়েন। কাইয়ুম চৌধুরীর উজ্জ্বলতা মৃত্যুহীন রয়ে গেল।