মোবারক ভাই

মোবারক হোসেন খান (২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৮—২৪ নভেম্বর ২০১৯)
মোবারক হোসেন খান (২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৮—২৪ নভেম্বর ২০১৯)

সম্প্রতি মারা গেছেন সংগীত–গবেষক ও লেখক মোবারক হোসেন খান। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন তাঁর ভাই সংগীতজ্ঞ শেখ সাদী খান।

জন্মিলে মরিতে হয়, বিধির চিরন্তন রীতি। প্রতিদিনের মতো সকালে হাঁটা শেষ করে বাসায় ফিরে নাশতার টেবিলে বসেছি, ঠিক এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। ফোন পেয়ে হু হু করে উঠল মনটা। আমার সেজ ভাই মোবারক হোসেন খান আর ইহজগতে নেই। খবরটা শোনার পর ভয়াবহ এক শূন্যতার গহ্বরে দাঁড়িয়ে মনে হলো, পৃথিবীটা যেন কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেছে।

মোবারক হোসেন খান; ১৯৩৮ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামের ঐতিহ্যবাহী সংগীত পরিবারে যে মানুষটি জন্মগ্রহণ করেন, তিনি আজ আর নেই। ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ ও উপমহাদেশের সংগীতসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ পরিবারের আরেকজন সন্তান এই মাটির পৃথিবী ছেড়ে গেলেন।

আমাদের পরিবারটি গানের পরিবার। আমার বাবা ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর ছয় পুত্র, তিন কন্যা। মোবারক ভাই ছিলেন ভাইদের মধ্যে তৃতীয়। বড় ভাই ওস্তাদ আবেদ হোসেন খান, ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খান, মোবারক হোসেন খান, শেখ সাদী খান, তানসেন খান, বিটুফেন খান, আর বোনেরা হলেন বেগম আম্বিয়া খানম, মমতা খানম আর ইয়াসমীন খানম। একে একে সবাই চলে গেছেন। এখন আমরা দুই ভাই এক বোন কাছের মানুষ হারানোর বেদনা বহন করে চলেছি।

 আমার অগ্রজ ছিলেন মোবারক ভাই। আমার জীবনে তিনি ছিলেন ছায়ার মতো। বিশেষত আমার কর্মজীবনে তাঁকে সব সময়ই ছায়ার মতো পেয়েছি। তিনি আছেন, এটা ভেবে সব সময় একটা মানসিক শক্তি কাজ করত, বড় একজন আছেন। মোবারক ভাই চলে যাওয়ার পর এখন চারপাশজুড়ে খা খা করা শূন্যতা বিরাজ করছে যেন। কাছের মানুষেরা চলে গেলে বুঝি এমনই হয়।

আমদের ভাইদের মধ্যে মোবারক ভাই ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা একজন মানুষ। তাঁর জীবনযাপন ছিল ছকে বাঁধা; সব কিছুই ছিল মাপা। বোধ করি তাঁকে আদর্শ মানুষই বলা যায়। তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন অল্প কথায় শেষ করা যাবে না।

২৪ নভেম্বর ঘুমের মধ্যেই চলে গেলেন। এখন লিখতে বসে এ কথা ভাবছি যে কেমন মানুষ ছিলেন আমার মোবারক ভাই? তিনি ছিলেন অমায়িক, নির্বিরোধী সংসারে নিবেদিতপ্রাণ। সন্তানদের প্রতি অত্যন্ত দায়িত্বশীল ব্যক্তি এবং আড়াল থেকে সবার জন্য সাধ্যমতো কিছু করার প্রবণতা ছিল তাঁর। সব সময় খানিকটা আড়ালে থাকতেই পছন্দ করতেন।

 ১৯৬২ সালে তদানীন্তন রেডিও পাকিস্তানে চাকরিজীবন শুরু করেন। সেখানে ৩০ বছর কর্মরত ছিলেন। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। কর্মজীবনে সংগীতে অবদানের জন্য তিনি ১৯৮৬ সালে একুশে পদক, ১৯৯৪ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন। সংগীত বিষয়ে লেখালেখিও করতেন মোবারক ভাই। এজন্য ২০০২ সালে পেয়েছিলেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার।

এখন আশ্চর্য হচ্ছি এই ভেবে, তাঁর কথা লিখতে বসে কত কিছুই না মনে পড়ছে, কিন্তু গুছিয়ে লিখতে পারছি না কিছুই! শুধু মনে পড়ছে, স্কুলজীবনে মোবারক ভাইয়ের শাসন আমার জীবন গঠনে ভীষণভাবে সাহায্য করেছে। যদিও আমি তাঁর মতো গোছানো জীবন তৈরি করতে পারিনি, তবে সুস্থ জীবন যাপনের দিকনির্দেশনা পেয়েছি তাঁর কাছ থেকেই।

এই অস্থায়ী যান্ত্রিক জীবনে ভাইবোনের সঙ্গে দেখা কম হলেও একের প্রতি আমাদের যে ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া-মমতা, এর কোনো কমতি ছিল না। জীবন চলার পথে আমাদের পরিবারের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। স্মৃতিগুলো যেমন হাসি-কান্না, বেদনারও বটে।

মোবারক ভাই নেই—আমার শেষ মুরব্বিকে হারালাম। বিশ্বস্ত দায়িত্বশীল একটা ভরসার জায়গাও শূন্য হয়ে গেল। বড় একা লাগছে। দাদা, আপনি যেখানেই থাকুন, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আপনাকে বেহেস্ত দান করুন এই কামনা করি।

লেখার শেষ পর্যায়ে আমার সুরারোপিত সৈয়দ আব্দুল হাদীর একটা গান এখন বড় বেশি মনে পড়ছে:

‘একদিন ক্লান্তিবিহীন চোখের অতলে ঘুম নামবে

সেই ঘুম আর কোনো দিন ভাঙবে না।

জীবন নামের ট্রেন, সেই যে একবার থামবে

সেই ঘুম আর কোনো দিন ভাঙবে না।’

মানুষের জীবনটা এমনই—দুই দিনের খেলাঘর।