শান্তিনিকেতনের গল্প, মূল্যবান দলিল

শান্তিনিকেতনের দিনগুলি বইটি পড়ার পর একটা আক্ষেপ থেকে যায় মনে—সন্​জীদা খাতুন কেন আরও একটু বিস্তারিত লিখলেন না! প্রতিটি অধ্যায় পড়ে মনে হয়, প্রতিটি বিষয়েই যেন আরও অনেক কিছু জানার ছিল। সন্​জীদা খাতুন তাঁর শান্তিনিকেতনের জীবন নিয়ে যা লিখেছেন, তাতে প্রচ্ছন্নভাবে উঠে এসেছে একটা সময় ও সে সময়ের মানুষের কথা। বইটির ভাষা এতটা সরল ও গভীর যে এ দুটোর মিলন বইটিকে বিশিষ্ট করেছে। প্রায় অলংকারবর্জিত বইটি।

সন্​জীদা খাতুন এ দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য নাম। এখনো ছায়ানটের হাল তাঁর হাতে। পাকিস্তান আমলে নানা প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করেছেন সতীর্থদের সঙ্গে। ফলে শান্তিনিকেতনের দিনগুলি বইয়ে তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ধরা পড়ায় তা একটি মূল্যবান দলিলও হয়ে রইল।

বইটি শুরু হয়েছে শৈশবে রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’ কবিতাটির প্রসঙ্গ টেনে। তাঁর মনে হয়েছিল, এই পঙ্​ক্তিগুলো তো তাঁরই লেখার কথা, রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন কেন? রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সখ্যের সূত্র ধরে এরপর এগিয়েছে লেখা। তিনি তাঁর সংগীতচর্চার কথা বলেছেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর সোহরাব হোসেনের গানে মুগ্ধ হয়ে তিনি তাঁর শিষ্যত্ব বরণ করেছেন। টানা তিন বছর গান করেছেন। ১৯৫৪ সালে বাংলায় অনার্স পরীক্ষা শেষ করে তিনি বিশ্বভারতীতে পড়াশোনার জন্য আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলেন, তাতে তাঁর মা (তিনি বলেন আম্মু, মাজেদা খাতুন) খুশি হয়েছিলেন কিন্তু তাঁর বাবা (তিনি বলেন আব্বু, কাজী মোতাহার হোসেন) খুব খুশি হতে পারেননি। পড়াশোনার টাকা কোত্থেকে আসবে, সে প্রশ্ন তোলায় মা সহজেই তার সমাধান করে দিলেন। বাবাকে বললেন, বাবা স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে পড়িয়ে যে টাকা পান, তাতেই সন্​জীদার পড়ার টাকা জোগাড় হয়ে যাবে। 

এরপর পুরোটাই শান্তিনিকেতনের আখ্যান। আমরা বইটি পড়তে পড়তে বিস্মিত হই এই ভেবে যে যাঁদের কথা এখানে লেখা হচ্ছে, তাঁরা সবাই বড় বড় শিল্পী বা ডাকসাইটে অধ্যাপক নন। আমরা লক্ষ করি, শান্তিনিকেতনে স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের সঙ্গে ভারি ভাব হয়ে গেছে এমএ–পড়ুয়া সন্​জীদা খাতুনের। ক্লাস সেভেনের শ্যামলী খাস্তগীর, এইটের রমা, নাইনের ইন্দ্রানী, মহাশ্বেতারা নতুন গান শিখলে গাইত, ওদের ‘মিনুদি’কেও (সন্​জীদা খাতুনের ডাকনাম) গাইতে হতো ওদেরই সঙ্গে। ওদের জন্য কলকাতার নিউমার্কেট থেকে সন্​জীদা খাতুন কিনে এনেছিলেন কাচের ছোট ছোট অনেক কুকুর। নানা রঙের সে কুকুরগুলো খোয়াই–এর ওপর তারা সাজিয়ে রাখত। কথাটা বিশেষভাবে উচ্চারণ করছি এ কথা বলার জন্য, আমরা যে সন্​জীদা খাতুনকে চিনি, তিনি গম্ভীর ও কঠিন এক নারী। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গেলে দুবার ভেবে নিয়ে তারপর বলতে হয়। কিন্তু আপাতকঠিন–কঠোর এই নারীর ভেতরটা যে কতটা কোমল, তা বলার জন্যই এই প্রসঙ্গের অবতারণা। আমরা লক্ষ করি, কাকাবাবুর আলাদা সময়ে করা (প্রবোধ চন্দ্র সেন) দুটো উক্তি সন্​জীদা খাতুনকে হকচকিত করেছিল এবং বাড়ি ফিরে হু হু কান্নায় তিনি ভেঙে পড়েছিলেন। এগুলো সন্​জীদা খাতুনের ভিন্ন একটি রূপ, যা প্রায় সময়ই থাকে আড়ালে, সবাই তার দেখা পায় না। 

বইটি ছোট। কিন্তু আগেই বলেছি, তাতে ছড়ানো ছোট ছোট গল্প পড়ে আরও অনেক কিছু জানতে ইচ্ছে করে। এই স্বল্প পরিসরে শান্তিনিকেতনের জীবনটাকে তো পুরো তুলে আনা যাবে না, তাই ছোট্ট দু–একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করে বইটি পড়ার প্রতি পাঠককে আকৃষ্ট করতে চাইছি।

শান্তিনিকেতনের সংগীত ভবনে থাকা একটি লাল খাতার কথা আছে বইটিতে। সে খাতায় ইন্দিরা দেবীর হস্তাক্ষরেও কিছু পরিমার্জনা ছিল বলে উল্লেখ আছে। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির মূল সুর কী হবে, তা নিয়ে যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল, তারই একটি উত্তর সেখানে পাওয়া যায়। শান্তিনিকেতনে ছাপা বইয়ে ভুলটাকে শুদ্ধ করার বিষয়ে যে অধ্যায়টি আছে, সেটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক, যা থেকে জানা যায়, ভুল সংশোধন করার প্রচেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ‘তুমি রবে নীরবে’ গানটির ‘মম জীবন যৌবন
মম সকল স্বপন’ পঙ্​ক্তিটির ‘সকল’ বদলে দিয়ে ছাপা হয়েছিল ‘সফল’। বারবার বলা সত্ত্বেও সে ভুল শুধরে নেওয়া হয়নি। বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড তাদের এই ভুলেই স্থিত হয়েছিলেন। 

অন্য ধরনের কিছু কথাই বলা হলো বইটি নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে। খ্যাতিমানদের নামগুলো আর উচ্চারণ করা হলো না এখানে। কিন্তু যাঁরা মন দিয়ে বইটি পড়বেন, তাঁরা এমন সব মানুষের নাম এখানে পেয়ে যাবেন এবং তাঁদের নিয়ে এমন কিছু গল্প—যা পড়ে মনে হবে, শান্তিনিকেতনে সন্​জীদা খাতুনের নানা রঙের দিনগুলি একটি অসাধারণ শিল্পকর্ম হিসেবেই স্থায়িত্ব পেয়েছে। আর শুরুতে বলা আক্ষেপটুকু যে আপনাকেও গ্রাস করবে, সে কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

শান্তিনিকেতনের দিনগুলি
সন্​জীদা খাতুন

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: অক্টোবর ২০১৯, ১২০ পৃষ্ঠা, দাম ২২০ টাকা।