মানবাধিকারের অনায়াস ও আকর্ষণীয় পাঠ

মানবাধিকার, আসিফ নজরুল,  প্রচ্ছদ: এরফান উদ্দিন আহমেদ, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ২০১৯, ৯৬ পৃষ্ঠা, দাম ২০০ টাকা।
মানবাধিকার, আসিফ নজরুল, প্রচ্ছদ: এরফান উদ্দিন আহমেদ, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ২০১৯, ৯৬ পৃষ্ঠা, দাম ২০০ টাকা।

সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন ছাড়পত্রবইয়ে: ‘যে শিশু ভূমিষ্ঠ হলো আজ রাত্রে/ তার মুখে খবর পেলুম:/ সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক/ নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার/ জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে।’ সুকান্ত যে অধিকারের কথা বলতে চেয়েছেন, তা মানুষ হিসেবে জন্ম নেওয়ামাত্রই মানুষ দাবি করতে পারে। এই অধিকারকেই আমরা বলি মানবাধিকার। আধুনিক জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের জন্য গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকার খুব গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয়। এর যেকোনো একটি না থাকলে বাকি দুটি অর্থহীন হয়ে পড়ে। এ কারণেই এ ধরনের রাষ্ট্রের পাঠ্যক্রমে প্রাথমিক স্কুল থেকে ছেলেমেয়েদের এ বিষয়ে ধারণা দেওয়া হয়ে থাকে। বাংলাদেশের পাঠ্যক্রমে মানবাধিকার অনেকটাই উপেক্ষিত বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আইন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের মানবাধিকারের সঙ্গে পরিচয় শুরু হয়। যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাননি, তাঁরা যদি মানবাধিকার সম্পর্কে জানতে চান, তাঁদের প্রথম যে সমস্যায় পড়তে হবে, তা হলো এ–সংক্রান্ত সহজপাঠ্য কোনো বাংলা বই বাংলাদেশে নেই। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত আসিফ নজরুলের মানবাধিকারকে তাই আমার কাছে আশার আলো বলে মনে হচ্ছে।

একটি প্রশ্ন দিয়ে আসিফ নজরুল শুরু করেছেন: ‘এমনি কী অধিকার আছে, যেটি পেতে হলে কোনো যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না?’ সেই উত্তর তিনি দিয়েছেন ধাপে ধাপে, উদাহরণ আর বৈশিষ্ট্য দিয়ে, হৃদয়গ্রাহীভাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবাধিকার পড়াতে গিয়ে আমরা প্রথমেই মানবাধিকারের সংজ্ঞার সমস্যায় পড়ি। কোনটি আইনি অধিকার, কোনটি নৈতিক অধিকার আর কোনটি মানবাধিকার, সেই ধন্দে পথহারা হয়ে আমরা সংজ্ঞা এড়িয়ে মানবাধিকারের বৈশিষ্ট্য বলা শুরু করি। আসিফ নজরুল একটি অপ্রচলিত কিন্তু অত্যন্ত কার্যকর সংজ্ঞা দিয়েছেন: ‘বিনা পয়সায় বিনা যোগ্যতায় কিছু অধিকার পাওয়া যায়। সেগুলোকে মানবাধিকার বলে। এসব অধিকার পাওয়ার শর্ত মাত্র একটা। তা হচ্ছে, মানুষ হিসেবে জন্ম নেওয়া। শুধু মানুষ হিসেবে জন্ম নেওয়ার কারণে যেসব অধিকার পৃথিবীর যে কারও প্রাপ্য, সেটাকেই আমরা মানবাধিকার বলি।’

মানবাধিকারের অনেক জটিল বিষয় তিনি অত্যন্ত সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় বইটিতে ফুটিয়ে তুলেছেন। মানবাধিকারের প্রকারভেদ, দেশীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিসরে মানবাধিকার বাস্তবায়নের বিভিন্ন পদ্ধতি সাবলীলভাবে বর্ণনা করেছেন। মোটামুটি মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা আছে এমন কেউ যদি বইটি পড়ে, সে–ও মানবাধিকারের গতি–প্রকৃতি সম্পর্কে অল্প সময়ের মধ্যে ভালো ধারণা পেতে পারে।

কেউ যদি বাংলাদেশের সংবিধানে মানবাধিকারের অবস্থান এবং সে আলোকে এর বাস্তবায়ন সম্পর্কে ধারণা পেতে চায়, তার জন্যও বইটি অতি প্রয়োজনীয়। যাঁরা মানবাধিকার বিষয়ে পণ্ডিত, তাঁদের জন্য অবশ্যই এ বই নয়। তবে মানবাধিকারের বিষয়ে যাঁরা অনেক জানেন, তাঁরা যদি এ বিষয়ে কাউকে জানাতে চান, তবে বইটি অবশ্যই পড়ার মতো। কারণ, এতে আছে মানবাধিকারের দুর্বোধ্য বিষয়গুলো কীভাবে অতি সহজভাবে উপস্থাপন করা যায়, সে কৌশল।

মানবাধিকারবিষয়ক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক চুক্তি, সেগুলোর বাস্তবায়নের পদ্ধতি, মানবাধিকার বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং সে দায়িত্ব উপেক্ষা করলে নাগরিকের করণীয়—এসবই বইটিতে উপজীব্য হয়ে উঠেছে। বইটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, মানবাধিকারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। ব্যাবিলনের রাজা হাম্মুরাবির কোড থেকে শুরু করে ম্যাগনা কার্টা ও আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণা হয়ে জাতিসংঘ সনদে কীভাবে মানবাধিকার জায়গা করে নিল, তা আসিফ নজরুল অত্যন্ত সংক্ষেপে কিন্তু কার্যকরভাবে তুলে ধরেছেন।

বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে, বিশেষ করে নতুন বিশ্বব্যবস্থার সংকটের মধ্যে মানবাধিকার পরিস্থিতি খুব আশাপ্রদ না হলেও, আসিফ নজরুল আশাবাদের মাধ্যমে তাঁর বইয়ের যবনিকা টেনেছেন।

বইটি ছোট পরিসরের। তবু বইটি সংগ্রহে রাখা উচিত মানবাধিকার বিষয়ে নিজেকে এবং অপরকে আলোকিত করার জন্য।