জয় অব লাইফ

মাসরুর আরেফিন
মাসরুর আরেফিন

আলথুসার
মাসরুর আরেফিন
প্রচ্ছদ: সেলিম আহমেদ
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
[‘আলথুসার’ বইয়ের অংশবিশেষ]

আমরা ‘জয় অব লাইফ’ ফাউন্টেনে গিয়ে বসতে বসতে দূরে পশ্চিমে সারপেনটাইন নামের লেক ও কেনসিংটন গার্ডেনস অতিক্রম করে চোখ ওপরে তুললেই দেখা যাচ্ছে সন্ধ্যা পৃথিবীর ওপরে ছেয়ে আসবার জন্য, নামবার জন্য তৈরি হচ্ছে এবং সে আজকে নামবে বেশ ভালোভাবেই, অন্য আরও অনেক দিনের মতো, যেমন বিশেষত বৃষ্টির দিনে বা ঝড়ের দিনে যেটা হয়ে থাকে তেমন করে নয়, তাড়াহুড়ো করে কোনো সিস্টেম ছাড়াভাবে নয়। আমি এরই মধ্যে কথা বলে ফেলেছি আমার ব্যাংকের ট্রাভেল ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে। ওটার দায়িত্বে থাকা অফিসার আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, ‘স্যার, লোকজন বলছে আপনি নাকি আর আসবেন না?’ তার কাছ থেকে, লাইনে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে জানলাম, কাল হয় আমাকে দুপুর ১টা ৪০-এর এমিরেটস নিতে হবে, না হয় সন্ধ্যা ৭টার। দুপুরে সম্ভব না, কাজ আছে আমার। আমি বললাম, টিকিটের তারিখ বদলে আগামীকাল সন্ধ্যা ৭টার ফ্লাইটে আমাকে তুলে দিতে এবং টিকিট আমার ই-মেইল ও হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাতে। অফিসার জানতে চাইল, ‘স্যার, উইন্ডো সিট না আইল?’ আমি উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দিলাম, আর আমার সামনে দাঁড়ানো এক ভারতীয় পরিবারকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনারা যেহেতু পাঞ্জাব থেকে, তো আপনারা কি “ক্যানসার ট্রেন”-এর নাম শুনেছেন? ভাটিন্ডা থেকে ছেড়ে রাজস্থানের বিকানের যায় প্রতি রাতে?’

বড় ছেলে যে লোকটা সে হয়তো আমাকে কোনো কড়া কথা শোনাত, কিন্তু ফারজানাকে দেখে সে থেমে গেল। স্রেফ জানতে চাইল, আমি কী করে জানলাম যে তারা পাঞ্জাবের? আমি বললাম, ‘আপনার বাবার মাথার পাগড়ি দেখে।’ লোকটা বলল, ‘উনি আমার বাবা না। উনি আমার বস, এটা আমার বসের ফ্যামিলি।’

তো, এই তুমি করছ তা হলে লন্ডনে এসে? নিজের বাবা-মাকে বিহারের ধানবাদে কি ঝাড়খন্ডের রাঁচিতে ফেলে রেখে এই তোমার লন্ডনের চাকরি বসের পরিবার নিয়ে হাইড পার্কে প্রিন্সেস ডায়ানা মেমোরিয়াল ফাউন্টেন দেখতে আসা? বোঝা নেই সোঝা নেই কে ডায়ানা, কবে ডায়ানা, কেন ডায়ানা, কার জন্য ডায়ানা, কোন কাজে ডায়ানা, কিন্তু ওদিকে আবার সোজা ‘চলেন বস, দুর্দান্ত ফাউন্টেন বানিয়েছে তারা, প্রিন্সেস ডায়ানার নামে, ভাবী দেখলে অনেক খুশি হবে, আর আপনার বড় মেয়ে ওই যে সেদিন যে দেখলাম কলংকিনী না কী যেন নাম, ও খুব খেলতে পারবে ওইটার পাশে সারপেনটাইন লেকের হাঁসগুলোর সাথে, চলেন বস যাই। আমি ওকে দেখে রাখব হাঁসেরা যেন ওকে না কামড়ায়।’ ভালোই জীবনে উন্নতি হবে তোমার খোকা,আমি ভাবলাম, তুমি চালিয়ে যাও এবং অবশ্যই বসের জুতোর মাপটা জীবনভর মনে রেখো, আর লক্ষ রেখো তার জন্য কেনা জুতো যেন কখনোই গ্রেগরি ব্র্যান্ডের না হয়, যেহেতু ওটা হার্ড, বেশ হার্ড, পরতে রীতিমতো ব্যথা-ব্যথাই লাগে, বসের পায়ে আহা ফোসকা পড়ে যাবে!

সন্ধ্যা নামা শুরু হয়ে গেল। আগের সেই এলমগাছগুলো হাজারে হাজারে ডাচ এলম ডিজিজ থেকে মারা গেলে ওদের জায়গায় লাগানো হয়েছিল যে লাইম ও ম্যাপল, তাদের মাথা বরাবর প্রবর্তিত হলো সন্ধ্যা কোনো বেদবাক্যের মতো, কোনো অক্ষয়পুরাণের মতো যেন। আমি দেখলাম আমরা যে জায়গাটায় এসে দাঁড়িয়েছি, এটা পার্কের অন্য এক জায়গা, মার্বেল আর্চের কোনার সেই জায়গা নয়, যেখানে আমি জানি, রাজত্ব করছে ফ্র্যাগরান্ট অলিভ, ক্যামফর, ইউরোপিয়ান বিচ ও চায়নিজ হর্স-চেস্টনাট। না, এখানে একেবারে অন্য সব গাছ, যার মধ্যে স্রেফ দুটো গাছই দখল করে আছে নব্বই ভাগ জায়গা উইপিং সিলভার লাইম ও সিলভার ম্যাপল। উইপিং সিলভার লাইমগুলো কেমন! তাদের লম্বা খিলান দেওয়া শাখা, নিচ থেকে ওপর দিকে দেখলে ব্যাপারটা ক্যাথেড্রালের গম্বুজের মতো গোল, আর তাতে এই সামারের শুরুতে গুনগুন করছে মৌমাছির দল, তারা জাপটে ধরেছে পাতার নিচের ভাগ, রুপালি সাদা হাজার ছোট ছোট গাছের নিজস্ব চুলে ভরা নিচ দিকটাকে।

অন্যদিকে সিলভার ম্যাপলগুলোর কী সুন্দর দুইরঙা পাতা আর কীভাবে ওরা সিকামোরের চাইতেও বেশি সুভদ্র, অভিজাত দেখি হালকা বাতাসে দুলে দুলে সন্ধ্যার আলো কেড়ে নিয়ে খেলছে তাদের পত্রপল্লবের মধ্যে এবং কীভাবে সেই পাতাদের অভিভাবকেরা ওদের শাখার কাঠ পাতলা ও ভঙ্গুর বলেই প্রায়শ দেখছি ঝুলে পড়েছে বলতে গেলে মানুষের গায়ে, তারা মাটির কাছাকাছি নামিয়ে দিয়েছে প্রতিটা পাতার পাঁচ লতির ধারালো বিন্যাসকে। এই যদি হয় নিচ তো, পৃথিবীর ওপরের দিকে এখন কী? সেখানে মৃদুমন্দ হাওয়া, সেখানে দল বেঁধে পাখিরা উড়ে যাচ্ছে পুব থেকে পশ্চিমে, যেন হাহাকার নিয়ে যে কীভাবে তাদেরকে ভোরের ওই ছোট গোলাপি বলটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে পুরো একটা রাত, অন্ধকারে। অন্ধকারে কেন? আমি তো দেখছি তারা ফুটতে শুরু করেছে আকাশের বিশাল বাগানের এধারে-ওধারে, যেভাবে বরিশালের প্রতিটা বাসার সামনের ড্রেনের পাড় ধরে টপটপ শব্দ করে ফুটত পাঁচ পাপড়ির সাদা আমরুল ও ডাঁটার আগায় ছত্রাকার থোকায় থাকা সাদা-গোলাপি-লাল-বেগুনি ল্যান্টানারা। পার্কের কেন্টাকি ব্লুগ্রাস বা ও রকমই কোনো বিশেষ ঘাসের ওপরে দাঁড়িয়ে থেকে আমরা তিনজন এভাবেই হতভম্ব, এভাবেই আমাদের যার যার মনের ভেতরে এই বোধটা স্পন্দিত যে, দ্যাখো এই স্নিগ্ধ রূপলাবণ্যে ভরা সন্ধ্যাকে দ্যাখো, যখন তারাদের দল একে অন্যের থেকে দূরে দূরে, তবু তারা আলোর সংকেতে নিজেদের মধ্যে হালকা দু-একটা কথা বলতে বলতে আবার তোমাদেরকেই বলছে যে, হে পৃথিবীর পড়শিরা আমাদের, তোমরাও আমাদের মতো নিঃসঙ্গ বটে।

আমরা উঠলাম ওখান থেকে। হাইড পার্ক ব্যান্ডস্ট্যান্ড পার হয়ে রোজ গার্ডেনের দিকে যাচ্ছি, জোসেফ বলল, ‘ভাইয়া ওই যে ওখানে চলেন, “স্ট্যাচু অব অ্যাকিলিস”দেখে আসি।’ সূর্য পশ্চিমে, উল্টো দিকে, হেলে গেছে; গ্রিক বীর অ্যাকিলিসের কালো চিকচিকে ব্রোঞ্জের গায়ে সে তার সন্ধ্যার বহু বর্ণ আলো এমনভাবে প্রতিফলিত করেছে যে অ্যাকিলিসকে ১৮-২০ ফুট উচ্চতার বিশাল অ্যাকিলিসকে, যার বাঁ হাতে একটা ঢাল ও ডান হাতে ছোট তরবারি, তরবারিটা ওঠানো, তরবারিটা জাগানো এবং তার বীরের আলখাল্লা আমার একটু আগের সেই মঞ্চে পরে থাকা কেপের মতো তার শরীরের পেছনে পড়ে আছে তার চিত্তের দুলুনিকে বোঝাতে সেই অ্যাকিলিসকে সন্ধ্যার আবছায়ায় মনে হচ্ছে সে যেন আমাদের বলছে, ‘আমি এর বেশি আর কতটুকুই পারব?’

আমরা তিনজনই আরও সামনে বেদির দিকে এগিয়ে গেলাম, গেলাম তার শরীরের পাশে খুলে মাটিতে রাখা বিরাট বর্মটাকে ভালো করে দেখব বলে। এ রকম খালি গায়ে, নিচেও কাপড় নেই, তার পুরুষাঙ্গ ছোট একটা ডুমুর পাতা দিয়ে ঢাকা, কেন যুদ্ধ করছে অ্যাকিলিস? তাহলে কেউ কি তার তাঁবুতে ঢুকেছিল যখন সে নগ্ন শুয়ে ছিল, সেক্স করছিল কোনো ক্রীতদাসীর সঙ্গে? তো, সারা শরীর উদোম রেখে আলখাল্লা পরে কেউ সেক্স করে নাকি? তিন ধাপ বেদির একদম গায়ের ওপর পৌঁছে গেছি আমরা, তখনই খুলে গেল দরজা, আমরা পৌঁছে গেলাম বরিশালের আমানতগঞ্জ মাঠের পাশে।

আমি জোসেফকে দেখালাম যে ওই যে আমার আমানতগঞ্জের মাঠ, আর ওই যে ভাঙা পুরোনো দালান, ওর কোনায় রেডক্রস বিল্ডিং। ওখানেই জন্ম হয়েছিল আমার এক দুপুরে, পঞ্চাশ বছর আগে, যখন এই পুরো এলাকাটা ছিল চোরকাঁটা, শেয়াল ও বেজিতে ভরা এবং রাত নামলেই ওই যে গাছগুলো এখন পুরোনো, প্রায় মৃত, ওরা শতবর্ষ বাঁচবার বদলে মাত্র সত্তর বছরও বাঁচতে পারছে না, ওরা তখন সব ছিল গা ছমছমে গাছ, কারণ রাত নামলেই ওদের ডালে অশুভের আগমনবার্তা বয়ে এনে কুপ পাখি ডাকত কুউপ-কুউপ শব্দ করে, আর আমি তা শুনতাম রেডক্রস হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে, তখন আমার বয়স মাত্র তিন কি চার দিন, যেহেতু অসুস্থ হয়ে জন্মে§ছিলাম তাই জন্মের পরে প্রায় এক সপ্তাহ আমাকে থাকতে হয়েছিল হাসপাতালে।

ফারজানাকে লক্ষ করলাম আমাদের একটু পেছনে বড় মাঠের পুকুরের পাশে সে আটকে গেছে বড় বড় পদ্মপাতার ওপরে বসে থাকা বেশ কটা বহুবর্ণ গুইসাপ দেখার মধ্যে, যারা কিনা বহুবর্ণ ওই সন্ধ্যার কারণে, মারাত্মক সে সন্ধ্যা, যা আকাশে দিগন্তরেখার সমান্তরালে কমলা ও কমলা-হলুদ রঙের অসংখ্য ছোট টান ছড়িয়ে রেখেছে কোনো সূর্যমুখী ফুলের কেন্দ্র ও তার পাপড়িদের মতো করে, আর সেই টানগুলোর মাঝখান দিয়ে যেন একটু পরপর গড়িয়ে যাচ্ছে আগ্নেয়গিরির তাজা লাল-বর্ণ লাভা, আর গুইসাপগুলো সে লালের ঔজ্জ্বল্য তাদের চামড়ায় ধরে কেমন রংবাহারি এবং তাই ফারজানা, এমন কিছু আগে কখনো দেখেনি বলে, পাথর।

আমরা ঠিক করলাম যে যাই দেখে আসি আমানতগঞ্জের বিলটাকে, মানে আমি বিলটা দেখাই ওদের, যেখানে একদিন বেলে মাছ ধরতে গিয়ে দেখি এক হিলহিলে ঢোঁড়া সাপ কী সুন্দর এঁকেবেঁকে, একদম আমার গায়ের পাশ দিয়ে, চলে যাচ্ছিল মূল নদীর দিকে। আমরা পৌঁছে গেলাম সেখানে, প্রচুর রিকশার টিং টিং পেরিয়ে, আর যেতে যেতেই আমি শুনে নিলাম যে কবি আর নেই, কবি চলে গেছেন কলকাতায়

 আমার সঙ্গে ওই দেখা হয়ে গেল প্রেডিক্টের, প্রেডিক্ট বিশ্বাস, তার এক চোখের পাতা খালি কাঁপে, চোখ খালি বন্ধ হয়ে যায়। আমি প্রেডিক্টের কাছে জানতে চাইলাম, সত্যিই কবি চলে গেছে কি না, তবে তার আগে ওর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম জোসেফ ও ফারজানাকে। প্রেডিক্ট হাফপ্যান্ট পরা, সেই প্যান্টের ঝুলের দিক অসম্ভব ময়লা, মনে হচ্ছে মুরালির লাল ও চটপটির ঝোল মাখা তাতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘প্রেডিক্ট, বল না, কবি নাকি চলে গেছে? কলকাতায়?’ প্রেডিক্ট এক চোখ প্রায় বন্ধ করে বলল, ‘হুনি নাই তো।’

আমানতগঞ্জের সরু রাস্তার পুরোটা জুড়ে, যেখানে রিকশা গ্যারেজে উপুড় করে সারাই করা হচ্ছে একটা পুরোনো রিকশা, অতএব জনা তিরিশেক লোক এই ঝালাইয়ের কাজ দেখছে গোল হয়ে, সেখান থেকে বিরাট আওয়াজ উঠল: ‘পেরেডিক্ট, তুই ব্যাডা জানোছ ছাতা। কবি চইল্লা গ্যাছে, কইলকাতায়। কবি চইল্লা গ্যাছে গা।’