কেয়াপাতায় নৌকা গড়ার দিন

রিজিয়া রহমান
রিজিয়া রহমান

রক্তমাখা স্মৃতির সাগর
রিজিয়া রহমান
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
প্রকাশক: ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা
[‘রক্তমাখা স্মৃতির সাগর’ বইয়ের অংশবিশেষ]

ভোরে কলকাতার শেয়ালদা স্টেশন থেকে ছেড়ে গোয়ালন্দ মেল রাজবাড়ী জংশন স্টেশনে আমাদের নামিয়ে চলে গেছে সময়মতোই। স্টেশনে প্রথম শ্রেণির ওয়েটিং রুমে অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। দুপুরের খাওয়া সেখানেই হয়েছে। মায়ের তত্ত্বাবধানে যথারীতি সঙ্গে আনা হয়েছে ছোট-বড় টিফিন ক্যারিয়ার ভরা খাবার। সেসব সুখাদ্য আমাদের শরীরে ছোটাছুটি, হাঁটাহাঁটির উদ্দীপনা এনে দিয়েছে নিঃসন্দেহে। জাহাঙ্গীরকে বারবার ধরে আনা হচ্ছিল প্ল্যাটফর্মের ভিড়ের মাঝখান থেকে। আমিও কম যাই না। কলকাতা ছেড়ে আসার দুঃখ বেমালুম ভুলে গেছি। অতি–উৎসাহী কৌতূহলে নতুন পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে বারকয়েক বেরিয়ে পড়েছি ওয়েটিং রুম থেকে। তারপরই মায়ের শাসন জারি, খবরদার, রুমের বাইরে যাবে না। স্টেশন দেখতে হলে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখো।

দরজার সামনে দাঁড়িয়েই দেখছি, রাজবাড়ী জংশন স্টেশনের অভূতপূর্ব দৃশ্য। কোনো প্ল্যাটফর্মে ঝমঝম শব্দে এসে দাঁড়াচ্ছে রেলগাড়ি আবার অন্য প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যাচ্ছে আরেক রেলগাড়ি। যাত্রীরা মালপত্তর নিয়ে তাড়াহুড়ো করে উঠছে–নামছে। হই হই, তাড়াহুড়ো, কুলিদের ভিড়, ডাকাডাকি, হাঁকাহাঁকি, ‘চা-গ্রম’ ‘সেদ্ধ ডিম’, কমলা, কলা, মিষ্টির বাক্স, পুরি, আলুর দম, পানি পাঁড়ে—সব মিলিয়ে আমার শিশুদৃষ্টিতে একেবারে আনকোরা নতুন উপভোগ্য দৃশ্য সব। ওয়েটিং রুমের কাছেই টিকিটঘর। তার পাশে আরেকটি ঘরে আধবুড়ো এক লোক টরে-টক্কা, টরে-টক্কা শব্দে একমনে কী এক যন্ত্র টিপে যাচ্ছে। লোকটির নাম যে স্টেশনমাস্টার, সেদিনই বাবার কাছ থেকে জানা হলো। স্টেশনমাস্টারের ঘরের প্রায় কাছেই লম্বা একটি লোহা ঝুলছে। ট্রেন ছাড়ার সময় হলেই সেই লোহায় আরেকটা লোহার ডান্ডা পিটিয়ে ঢং ঢং শব্দ করছে কুলিদের মতো পোশাক পরা এক লোক।

একসময় ফরিদপুরগামী ট্রেন এসে দাঁড়িয়ে গেল প্ল্যাটফর্মের ধারে, উঠে পড়লাম আমরা। ফরিদপুরের যাত্রীদের মধ্যে আমাদের মতো ফিটফাট কলকাতিয়া যাত্রী কমই। গুটিকয়েক বগির ছোট রেলগাড়ির অধিকাংশ যাত্রী গ্রাম্য হাটুরে ধরনের। এমন হাটুরে লোক দেখেছি আমাদের দেশের বাড়ির হাটে। এদের অনেকের পায়েই জুতো নেই। পরনে আধময়লা ধুতি অথবা লুঙ্গি। কারও মাথায় ভারী বস্তা। কারও মাথায় শাকসবজি, ফলমূলের ঝাঁকা। আমাদের কম্পার্টমেন্টে তারা কেউ ওঠেনি। পুরো কামরায় আমরাই—মা-বাবা, বড় ফুফু আর আমরা ক’ভাইবোন।

উঠতি দুপুরে মিটার গেজের লাইন ধরে ফরিদপুরগামী ট্রেন ঝিকঝিক শব্দে এগিয়ে চলল। ঋতু সম্পর্কে স্বচ্ছ জ্ঞান তখনো গড়ে ওঠেনি। এটুকু মনে আছে, তখনো শীত নামেনি। সম্ভবত সেটি ছিল হেমন্তকাল। মনে আছে, রেলগাড়ির দুপাশে দ্রুত সরে যাওয়া ঝোপঝাড়ে ঝিকমিকিয়ে জ্বলছিল নিরুত্তাপ রোদ। শিশিরমাখা ঘন সবুজ ঝোপঝাড়ে ভেজা পাতার রংটি তখনই যেন সারা জীবনের জন্য আঁকা হয়ে গেল মনে। তখন কি জানতাম প্রকৃতির এক অকৃত্রিম উদার ভুবনের বাসিন্দা হতে চলেছি? জানার কথাও নয়। বয়স তখন এসব বোধ তৈরি হওয়ার যোগ্য হয়ে ওঠেনি।

খানখানাপুর, বসন্তপুর আরও চোখে না পড়ার মতো আধঘুমন্ত গ্রাম্য স্টেশন ছাড়িয়ে, কত ঝোপঝাড়, ধানখেত, গ্রাম, সরু খাল আর ছোট ছোট নদীর ওপরে ঝুলে থাকা লোহার পুল ছুটে ছুটে পার হয়ে আমাদের রেলগাড়ি এসে থেমে গেল শেষ স্টেশনটিতে। বাবা বললেন, এই যে এসে গেছি ফরিদপুরে, এসো, নামো সবাই। নেমে পড়লাম আমরা। চারদিকে তাকিয়ে অবাক আমি। এই নাকি ফরিদপুর, যেখানে আসার জন্য মা অধীর হয়েছিলেন, কলকাতা ছেড়ে এখানেই আমরা থাকতে এসেছি। মনটা দমে গেল। হয়তো ভেবেছিলাম কলকাতার শেয়ালদা স্টেশনের মতোই ফরিদপুরের স্টেশন হবে গমগমে, বিরাট, জমজমাট। এ তো রাজবাড়ী স্টেশন থেকেও অনেক ছোট, যেন বিরান মাঠে একাকী দাঁড়িয়ে আছে লাল ইটে তৈরি ছোট এক ডাকঘর (উপমাটা তখন তৈরি হয়নি মনে; তবে অনুভূতিটা এমনই ছিল)। নতুন গন্তব্য সম্পর্কে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলাম বোধ হয়। বাবা বললেন, দাঁড়িয়ে থেকো না, হাঁটো সবাই। হাঁটতে শুরু করলাম সবার সঙ্গে। নরম কম্বলে জড়ানো ছোট্ট মানু মায়ের বুকে। এক হাতে মানুকে চেপে, আরেক হাতে মা আমার হাত ধরলেন। পূর্ণিমা বড় ফুফুর কোলে। মিলুকে কোলে নিয়ে বীথি আর জাহাঙ্গীরকে আরেক হাতে ধরে বাবা এগিয়ে চললেন আগে, তাকে অনুসরণ করছি আমরা। মাথায় মালপত্তর চাপিয়ে কুলিরা হাঁটছে পাশে। টিকিট চেকিংয়ের গেট পেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম আমরা স্টেশনের বাইরে। আমি, জাহাঙ্গীর, বীথি আমাদের কারও মুখেই কথা নেই, যেন অবাক বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি অচেনা এক দেশে প্রবেশের অপেক্ষায়। বাবা গেলেন গাড়ি ভাড়া করতে। প্রথমেই চোখে পড়ল এখানে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের অভাবটি। ধারেকাছে মিটার লাগানো কোনো ট্যাক্সিও চোখে পড়ল না। স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে গোটাকয়েক ঘোড়ার গাড়ি আর তিন চাকার রিকশা। এমন ঘোড়ার গাড়ি শিবপুরে মেজ ফুফুদের শহরে দেখেছি। কিন্তু তিন চাকার রিকশা কখনো দেখিনি। জাহাঙ্গীরকে বললাম, তিন চাকার গাড়িগুলোর নাম কিরে?

নামটা জাহাঙ্গীরেরও জানা নেই। বলল, গরুর গাড়ি।

পাশে দাঁড়ানো কুলিটিই বলে দিল, খোকাবাবু, ওইটা গরুর গাড়ি নয়, রিকশা। রেলগাড়ির প্যাসেঞ্জারের খেপ নেয়। দুটি ঘোড়ার গাড়ি আর দুটি রিকশা ভাড়া করা হয়ে গেল। মালপত্র কিছু উঠল রিকশায়, কিছু ঘোড়ার গাড়ির ছাদে। রিকশায় চড়ার ভারি ইচ্ছে ছিল। মা দিলেন না। হয়তো ভাবলেন, রোগা-পটকা আমি ছিটকে পড়ব রিকশা থেকে। পালকি ঘোড়ার গাড়ির খড়খড়ি তোলা জানালা দিয়ে অচেনা শহরের চেহারা দেখতে দেখতে বাবাকে জিজ্ঞেস করি, ফরিদপুরে ট্রাম চলে না আব্বা? দোতলা বাস নেই এখানে?

বাবা মৃদু হাসলেন। আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যই হয়তো বললেন, ট্রাম নেই, বাস বোধ হয় আছে। বাবার কথায় ভরসা পাওয়ার কারণ ছিল না। আধাগেঁয়ো শহরের লালচে সুরকিঢালা পথে দু-চারটে ঘোড়ার গাড়ি আর রিকশা ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন চোখে পড়েনি তখনো।