বই বের করতে পারি, কিন্তু কেন করব?

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

জীবনে বই বের করেনি, এমন মানুষ কমই আছে। বেঁচে থাকলে সবাইকেই বই বের করতে হয়, আমিও বের করেছি—বইয়ের তাক থেকে। বই বের করেছি স্কুলের ব্যাগ, টেবিলের ড্রয়ার, এমনকি খাটের তলা থেকেও—কখনো গল্পের বই, কখনো কবিতার। যদিও আমার কোনো কোনো বন্ধু পাঠ্যবই ছাড়া কোনো বই বের করেনি কখনো। তবু কেন যেন ওদেরই বেশি পছন্দ করত মা-বাবা। আফসোস করে বলত, ‘ভাবি, আপনার ছেলেটা কী লক্ষ্মী, সারা দিন টেক্সট বুক নিয়ে থাকে! আর আমার ছেলেটা তো একেবারে গেছে। কী সব গল্পের বই নিয়ে পড়ে থাকে!’

মা-বাবার কথা তখন পাত্তা দিইনি। ফলে সেই বন্ধুরা এখন লেখে ব্যাংকের চেক বইয়ের পাতায়। আর আমি লিখি পত্রিকার পাতায়। তাই সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য হলেও অনেকে বলে, ‘তুমি তো লেখো, তা বই বের করো না কেন?’

শুনে এত দিন হিমুর মতো মুচকি হাসতাম। ভাবটা এমন, যেন চাইলেই আমি বই প্রকাশ করতে পারি। কিন্তু এই রাস্তার যানজট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ইরান-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব—এসব নিয়ে ভাবনায় এত ব্যস্ত থাকি, সময়ই পাই না। বলা যায়, আমার ভাবনা অনেকটা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার মতো, বই বের করতে পারি, কিন্তু কেন করব?

বই প্রকাশ করতে দরকার প্রকাশক, যাঁদের অধিকাংশের ধারণা রিকশা–গাড়ির মতো বইয়েরও চাকা আছে। বইও চলে। ইঞ্জিনে ঘাপলা থাকলে স্টলে আটকে থাকে। ফলে লেখকেরা দলে দলে প্রকাশকদের কাছে গেলে তাঁরা বলেন নানাবিধ কথা।

প্রকাশকদের নানা কথা কাহিনির পরও বইমেলায় বিভিন্ন ধরনের বই বেরোচ্ছে প্রতিদিন। পাঠক মেলায় আসছেন। আসছেন লেখকেরাও। লেখকের সংখ্যা কত, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। বইমেলায় যদি পাঁচজনের সঙ্গে আপনি ধাক্কা খান, দেখবেন, প্রতি পাঁচজনের চারজনই লেখক। খেয়াল করলে দেখবেন, প্রতিবছরই একটু একটু করে মেলার আয়তন বাড়াচ্ছে বাংলা একাডেমি। লেখকের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, আয়তন না বাড়িয়ে উপায় কী? এভাবে যদি পাঠকের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ত!

বইমেলা এলেই নতুন বইয়ের বিজ্ঞাপনে ভরে ওঠে পত্রিকার পাতা। কোনো কোনো লেখক–প্রকাশকের বাজেট বেশি। তাঁদের বিজ্ঞাপনও বিশাল। আবার কেউ কেউ এত ছোট বিজ্ঞাপন দেন যে কী লিখেছেন, দেখাই যায় না।

সেদিন এমন একটা অণুবিজ্ঞাপন চোখে পড়ল। ম্যাগনিফায়িং গ্লাস ব্যবহার করে উদ্ধার করলাম লেখকের সঙ্গে যোগাযোগের ঠিকানা। ই–মেইলে লিখলাম, ‘সম্ভবত আমিই এই বিজ্ঞাপনটির একমাত্র পাঠক। সবার বাসায় তো আর ম্যাগনিফায়িং গ্লাস নেই।’ লেখকের কাছ থেকে এখনো কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। কিংবা তিনি হয়তো এত ছোট ফন্টে জবাব দিয়েছেন, চোখেই পড়েনি আমার।

প্রস্তরযুগ, নব্য প্রস্তরযুগের মতো এখন চলছে নব্য প্রচারের যুগ। বই আসার আগেই একজন বললেন—

: ভাই, প্রচার করেন। বলেন তো ৩০০ রিভিউ লেখায় দেই!

: কী কন! বই-ই তো আসে নাই।

: আরে, রিভিউ লিখতে বই আসা লাগে নাকি? এই সব তো করতে হবে। শুধু বই লিখবেন আর ভাববেন পাবলিক কিনবে, তা হয় নাকি?

: সেটাও ঠিক।

: আর ভাই, একটু বেশি দিলে বই একেবারে সাইটের সামনে আনায় দেব। বেস্টসেলার! এই সবই তো হচ্ছে। 

আবার শুনছি ভোটকেন্দ্রের লাইনের মতো লাইনও নাকি হচ্ছে। লাইন ধরে পাঠক কিনছেন বই। কিন্তু জানেন না বইটার লেখক কে! সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন থেকে এই যে মানুষ শিক্ষা নিয়ে বাস্তব জীবনে কাজে লাগাচ্ছে, এটাও তো বিরাট একটা উন্নয়ন।

বইমেলার নতুন বইয়ের প্রচারণাও কিন্তু অনেকটাই নির্বাচনী প্রচারণার মতো। বইমেলার সময় লেখক হয়ে যান মেয়র কিংবা কাউন্সিলর প্রার্থী। পরিচিত কাউকে দেখলেই চকচক করে ওঠে তাঁদের চোখ—ওই বুঝি আমার বইয়ের পটেনশিয়াল ক্রেতা! ফেসবুক পোস্ট, ইনবক্সে ব্যাপক অ্যাকটিভ থাকেন লেখকেরা। সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন, দেখা হলেই করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দেন (যদিও করোনাভাইরাসের কারণে অনেকেই হাত মেলাতে সাহস পাচ্ছেন না)। হেসে বলেন—

‘আরে ভাই, আপনাকে ফেসবুকে দেখি, কখনো কথা হয় না। কেমন আছেন? মেলায় আজকেই আসলেন? তো আপনার বই কোন স্টলে? সেকি, বই আসে নাই? আমার তো আসলো। এবার এত চাপের মধ্যে ছিলাম, লেখার সময় করে উঠতে পারি নাই। কোনোমতে ছয়টা বই করলাম। এর মধ্যে দুইটা উপন্যাস, একটা কিশোর উপন্যাস, একটা প্রবন্ধ, একটা কবিতা আর একটা মোটিভেশনাল বই। আইসেন স্টলে... একটু তাড়া আছে ভাই, দুইটা চ্যানেল দাঁড়ায় আছে ইন্টারভিউ নিতে। আসলে এই সবে আবার আমার আগ্রহ নাই। কিন্তু এমনভাবে ধরল, না করি কীভাবে, বলেন? এরাও না...!’

মেলা শেষে সেই হাসিমুখে হাত মেলানো ফেসবুক বন্ধুটি আপনাকে চিনতেই পারবেন না। নির্বাচনের পর ঠিক যেভাবে প্রার্থীরা ভুলে যান ভোটারদের।

ক্ষেত্র বুঝে পাঠকও বই কিনে ফেসবুকে ছবি দিয়ে ট্যাগ করে দেন লেখককে। ফাইল আটকে রাখা অফিসারদের বই এ জন্যই নাকি বেশি বিক্রি হয়। তা হোক না, আজকাল তো বিক্রিটাই বড় কথা। তাই না?