নিবিড় অনুভবে নারীজনমের সংগ্রাম

কণ্টকাকীর্ণ সব পথঘাট পেরিয়ে জীবনে স্থিরতা পায় মণি। স্বামী-সন্তান নিয়ে সিডনির উপকণ্ঠে ছিমছাম সংসারের নিরুপদ্রব জীবন। কোনো অভিযোগ-অনুযোগ নেই। স্বামী রাকিব আর ছেলে সৌম্যকে নিয়ে গোছালো জীবন। একটা সময় খড়কুটোর মতো ভাসতে ভাসতে রাকিবের কাছেই চূড়ান্ত আশ্রয় খুঁজেছিল মণি। তার বুকেই খুঁজে পেয়েছিল বিশ্বাস-ভালোবাসা ও নিরাপত্তার বিস্তৃত চর। জীবনের বিশ্বস্ততম ঠিকানা হিসেবেই রাকিবকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছিল সে। তাকে নিয়েই এই দূর পরবাসে আসা এবং সুখে-দুঃখে প্রায় তিন দশকের দাম্পত্য জীবন পার করা।

আচমকা এক আঘাত এসে মণিকে তছনছ করে দিতে চায়। সেই বিস্তৃত বিশ্বাসের চরে আছড়ে পড়ে অবিশ্বাস-শঙ্কা আর সন্দেহের ঢেউ। মণি ফিরে যায় অতীতে—আবার সেই ভয়াল-বিকৃত সময়ে, দুর্বিষহ জীবনে। তবে কি সব পুরুষই খল, সবাই বিকৃত? রাকিবও কি তাই! তার ভেতরেও কি বসবাস করে সেই হিংস্র দানব, যা মণির মনোদৈহিক জগৎকে ক্ষতবিক্ষত করেছে দিনের পর দিন। ‘কোলাহল থামার পরে’ উপন্যাসটিতে এমনই এক উৎকণ্ঠিত নারীর আখ্যান বয়ান করেছেন কথাসাহিত্যিক আফসানা বেগম।

সম্প্রতি আমরা যে বিকৃত ও বিপন্ন সমাজের চিত্রটা দেখতে পাই, যেখানে নারী ও শিশুর হেনস্তা এক নৈমিত্তিক বিষয়, মর্মন্তুদ পীড়নের গল্প যেখানে প্রাত্যহিক, সে সমাজেরই এক অতীত আখ্যান চিত্রিত হয়েছে এই উপন্যাসে। গভীর মনোবিশ্লেষী ও প্রাণবন্ত গদ্যের বুননে মণির দুই জীবনের গল্প বলেন আফসানা বেগম। বর্তমানে দ্বিধান্বিত মণি ও অতীতের ভীতবিহ্বল মণির গল্প চলতে থাকে সমান্তরালে। সরল ও সতেজ গদ্যে উত্তম পুরুষে মণির জীবনের ভাষা তরজমা করেন আফসানা বেগম। উত্তম পুরুষে কাহিনি বয়ানের ফলে প্রধান চরিত্র মণির অন্তর্গত পরিস্থিতি, পরিবেশ-প্রতিবেশ ও সংকটাবস্থা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে উত্কলিত হয়। আরামদায়ক গদ্যে গল্প এগোয় জোর কদমে।

মণির স্বামী রাকিব পেশায় একজন প্রকৌশলী, সে সিডনির বড়সড় এক রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে চাকরি করে। চাকরির বয়স নেহাত কম না, ১৫ বছর হতে চলল। এত দীর্ঘকাল পরে হঠাৎ কোম্পানি তার বিরুদ্ধে শিশুকে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলে, কোর্টে কেস হয়। রাকিব কিছুই বলে না মণিকে। কিন্তু চিন্তা আর বিষণ্নতার ভারে নুয়ে আসা রাকিবকে দেখে মণি বুঝতে পারে যে কিছু একটা হয়েছে। সে রাকিবের কাছে জানতে চায়, রাকিব নির্বিকার থাকে, কিছু বলে না বা বলতে পারে না।

একসময় ব্যাপারটা মণি ঠিকই জানতে ও বুঝতে পারে, একদিন কোর্ট থেকে অভিযোগপত্রসহ রাকিবের কাছে চিঠি আসে, সেই চিঠি পড়ে মণি। অফিসে বসে কাজ রেখে উলঙ্গ শিশুদের ছবি দেখত রাকিব। এতে করে কোম্পানি তাকে শিশু নিপীড়ক হিসেবে সন্দেহ করে এবং তারা আশঙ্কা করে যে, সে এই দেশের জন্য বিপজ্জনক। কোর্টের অভিযোগ, রাকিব অতীতে শিশুদের নিপীড়ন করেছে অথবা সে ভবিষ্যতে ভয়ংকর এ কাজটি করবে। তাই তারা তাকে বিচারের মুখোমুখি করতে চায় এবং তাকে চাকরিচ্যুত করে।

চিঠি পড়ে বিমূঢ় হয়ে যায় মণি। সে কিছুই ভাবতে পারে না। রাকিবের সঙ্গে ৩০ বছর সংসার করার পর মণি আবিষ্কার করে যে সে এখন রাকিবকে চিনতে পারছে না। এক অচেনা রাকিবকে নিজের পাশে আবিষ্কার করে। কান্নায় ভেঙে পড়ে মণি। লজ্জায়-ঘৃণায় কুঁকড়ে যায়।
এক কঠিন সংকট তৈরি হয় উপন্যাসের আবর্তনকেন্দ্র প্রধান চরিত্র মণিকে ঘিরে। মণি রাকিবকে পুরোপুরি অবিশ্বাস করতে পারে না। আবার বিশ্বাসই বা করে কী করে? তার অতীত তো এ ধরনের বীভত্সতার সাক্ষ্য বহন করে। সামাজিক পীড়ন আর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বে দীর্ণ মণি নিজের অতীতের কপাট খুলে দেয়।

জন্মের পর থেকেই হিংস্রতা আর নির্মমতার নগ্ন রূপ দেখে আসছে মণি এবং সে হিংস্রতাকেই আত্মরক্ষার একমাত্র উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছিল।
বাবা নামের এক দানবকে প্রায়ই পিশাচের চরিত্রে দেখত। কিছু হলেই মায়ের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালাত মদ্যপ বাবা। তার বর্বরতার হাত থেকে রক্ষা পেত না মণির শিশু ভাই রণিও। একপর্যায়ে নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে আরেকজনের হাত ধরে ঘর ছেড়ে চলে যায় তাদের মা। ফলে ঘরে আসে সৎমা, সঙ্গে আসে সৎমায়ের ভাই সবুজ। মামা মানে সৎমায়ের ভাই সবুজ মামার হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হয় মণি।
নিজেকে এই বিকৃত অত্যাচার থেকে বাঁচাতে আশ্রয় নেয় মায়ের সংসারে। সেখানেও সৎবাবার হাতে ধর্ষণের শিকার হয় সে। কোথাও গিয়ে শান্তি আর স্বস্তি পায় না কিশোরী মণি। সবখানেই হায়েনা, সবখানেই রাক্ষস। একদিন রণচণ্ডী হয়ে ওঠে মণি, দা দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে ধর্ষক সৎবাবাকে। এই নরপশুকে কুপিয়ে অজানায় নেমে পড়ে মণি। তারপর কত কত পথ, দীর্ঘযাত্রা।
পাহাড়সম বাধা ডিঙিয়ে জীবনকে বাগে আনা বিহ্বল মণি তার স্বামী রাকিবকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। রাকিব যে নির্দোষ, এটা সে বুঝতে পারে। সন্দেহ-অবিশ্বাস দূর করে বিশ্বাসের পাচিল আরও শক্ত করে মণি। স্বামীর সঙ্গে কেস লড়তে থাকে সে, থমকে যায় না। সাপের ফণার মতো উদ্যত হাতকে মণি আতঙ্ক আর ধৈর্য দিয়েই মোকাবিলা করে, হয়ে ওঠে অদম্য। এবং এভাবেই নিজের গল্প নিজেই এগিয়ে নিয়ে যায় মণি, সঙ্গে থাকে তার স্বামী ও পুত্র সৌম্য যে কিনা এসব বিহ্বলতা আর শঙ্কাকে থোড়াই কেয়ার করে।
মণির স্বামী রাকিবুল অফিসে বসে বসে বাংলাদেশের গ্রামের বিভিন্ন ছবি দেখত। এর মধ্যে কিছু ছবি ছিল উলঙ্গ শিশুদের এবং এ কারণেই এই ভয়ংকর আপদ আসে। আসলে রাকিব দেশ ও সেসব নিয়ে নস্টালজিক হয়ে এসব ছবি দেখত। কিন্তু কোর্টের দাবি, সে এসব দেখত বিকৃত এক যৌন বাসনা নিয়ে, যা তার ভেতরে অবস্থানকারী ভয়ংকর নিপীড়ক সত্তার বহিঃপ্রকাশ।
রাকিব ও মণি কেস চালিয়ে যায়, লোকাল কোর্টে মামলায় হেরে সুপ্রিম কোর্টে যায়। তবু কুলিয়ে উঠতে কষ্ট হয়। তারা চেষ্টা চালায়, বাড়ি বন্ধক দেয়, অকাতরে টাকা খরচ করে। ধৈর্যের বাঁধ শক্ত করে। তবু আশাহত হয় না। তারা কি শেষতক পারবে? এ সংশয় নিয়েই উপন্যাস অন্তপর্যায়ের দিকে এগোয়।
‘কোলাহল থামার পরে’ আখ্যানটির বহুভুজ বক্তব্য রয়েছে। তা একাধারে একজন নারীর জীবনযুদ্ধের ইতিহাস, অন্যদিকে ভিন্ন সংস্কৃতিতে বসবাসকরী বাঙালি পরিবারের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংকটের ডকুমেন্টেশন। প্রবাসে বসবাসকারী নস্টালজিক মানুষের দেশপ্রেমের ব্যাপারটিও বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে। মণি ও রকিবুল স্বপ্ন দেখে একদিন তাদের মামলা শেষ হবে আর কিছু টাকা জমিয়ে বাংলাদেশ দেখতে যাবে।
জীবনবিস্তারী প্রবল কোলাহলে চলতে থাকে আখ্যান। লেখক এক অধ্যায়ে মণির বর্তমানকে রচনা করেন আর অন্য অধ্যায়ে বর্ণনা করেন অতীতকে। গতিচঞ্চল ও তরঙ্গময় গল্পের বাঁকে বাঁকে সময়সত্য ও সমাজস্থ প্রকট বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতকে আঁকেন সম্মোহনী ভাষা-প্রকরণে। এক নারীর গল্পের ভেতর উঠে আসে হাজারো নারীর নারীজনমের সংগ্রাম ও স্বপ্নের কথা।

কোলাহল থামার পরে
আফসানা বেগম
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২০
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
পৃষ্ঠা: ১৫২
দাম: ৩০০ টাকা।