ভাষা আন্দোলন: উর্দুভাষী লেখকদের লেখা থেকে

ফয়েজ আহমদ ফয়েজ ১৯৬২, করাচি, মস্কো যাওয়ার আগে

আমাদের মহান স্বাধীনতার বীজ রচিত হয়েছিল ভাষা আন্দোলনে। সেই থেকে অধিকারের প্রশ্নে আর কোনো ছাড় দেয়নি বাঙালি।

একাত্তরে আমরা স্বাধীন হই। কিন্তু ইতিহাস বলে স্বাধীনতা অর্জনের পথ কখনো মসৃণ হয় না। এই সত্য আমাদের চেয়ে আর কার বেশি জানা।

শাসকগোষ্ঠীর ক্রমাগত জুলুমের শিকার হতে হয়েছে এ দেশের মানুষের। শাসকেরা থাকতেন ওপারে, পশ্চিম পাকিস্তানে।

জুলুম করতেন এপারে, পূর্ব পাকিস্তানে। শাসকদের মনোভাব তো তাঁদের কর্মেই স্পষ্ট। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ?

লেখক-বুদ্ধিজীবীদের কী ভূমিকা ছিল? লেখক-বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশই সব সময় জুলুমের প্রতিবাদ করেছেন।

কেউ কলম তুলে নিয়েছেন, কেউ বিবৃতি দিয়েছেন। রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে তত্কালীন শাসকগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন।

ইকবালের পর উর্দু ভাষার সবচেয়ে শক্তিমান কবি একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ হওয়া এ দেশের সূর্যসন্তানদের নিয়ে লিখেছেন বিখ্যাত কবিতা ইনতেসাব।

মান্টোর পর উর্দু কথাসাহিত্যের শক্তিমান স্রষ্টা ইনতেজার হুসেইন এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে লিখেছেন গল্প—নিদ, আসির, শেহরে আফসোস।

তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘বাস্তি’র বড় অংশজুড়ে রয়েছে একাত্তর প্রসঙ্গ। এই লেখা থেমে নেই।

তত্কালীন শাসকদের প্রোপাগান্ডার কারণে অনেক লেখক ও সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছিলেন বটে।

এই প্রোপাগান্ডা দূর করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তরুণ লেখকেরাও। অনেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার প্রয়াস চালাচ্ছেন।

এসব লেখা থেকে উর্দু ভাষার লেখকদের মনোভাব আন্দাজ করা যায়। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য তেমন দুটি লেখার নির্বাচিত অংশ তুলে ধরা হলো। লেখা দুটি উর্দু থেকে অনুবাদ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ পাকিস্তানের জন্ম দিয়েছে

মনজুর আহমদ, রোজনামা পাকিস্তান, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭
ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন দুই খণ্ড জনপদ হিসেবে যখন পাকিস্তান অর্জিত হলো তখন কায়েদ–ই–আজম একে মজা করে বললেন, ‘এ হলো ইঁদুরে খাওয়া পাকিস্তান’।

কায়েদ–ই–আজমের মতো প্রাজ্ঞ ও দূরদর্শী নেতা অবাঙালি মুসলিম লীগের খপ্পরে পড়ে এমন এক ভুল করে বসলেন যে শেষপর্যন্ত তা পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করে ছাড়ল।

১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ কায়েদ–ই–আজম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘোষণা দিলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে ‘স্রেফ উর্দু’।

এর মাধ্যমেই পূর্ব বাংলাকে পৃথক করে দেওয়ার বন্দোবস্ত করে দেন। ২৪ মার্চ দ্বিতীয়বার ঢাকা বেতার থেকে রাষ্ট্রভাষার ঘোষণা দিলেন কায়েদ–ই–আজম। বাংলা ভাষার ব্যাপারে কিছুই বললেন না।

এমনকি ফেডারেল পাবলিক সার্ভিস কমিশন পরীক্ষার বিষয় হিসেবে থাকা বাংলাকে বাদ দিয়ে দিল।

ব্যাংক নোট ও মুদ্রা থেকে বাংলা সংখ্যা হটিয়ে দেওয়া হলো। বাঙালিদের মতো সংবেদনশীল ও রাজনৈতিকভাবে দৃঢ় জাতির জন্য ছিল এটি অপমানের।

ভাষার জন্য বাঙালিরা ঝাঁপিয়ে পড়ে, শাহাদত বরণ করে, দ্রোহে ফেটে পড়ে। এমনকি সোহরাওয়ার্দীর আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক-প্রজা পার্টি এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মতো সংবেদনশীল বক্তা পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের বোকামির কারণে প্রথমবারের মতো সামনে আসে।

পাকিস্তানের জন্মের ৯ বছর পর, অর্থাৎ ১৯৫৪ এবং ১৯৫৬ সালে আমাদের নেতাদের মনে এল, ‘পূর্ব বাংলা’কে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ লেখা হোক।

বাংলাকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা বানানো যাক। ঢাকা হোক দ্বিতীয় রাজধানী।

মুদ্রার নোটগুলোতেও বাংলা সংখ্যা লেখা হোক। কিন্তু এই ‘দয়া’ বাঙালিরা এ জন্য পেয়েছেন যে তাঁরা নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রদেশ মনে করেননি, বরং নিজেদের পশ্চিম পাকিস্তানের সমমর্যাদার মনে করেছেন।

অবশ্য এর কারণ হলো পশ্চিম পাকিস্তানের সব প্রদেশ একীভূত করে তাকে একটি ইউনিট বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

করাচি ও লাহোর থেকে নিয়ন্ত্রিত প্রশাসন পূর্ব বাংলার ঘটনাবলি এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কারণ আমাদের শিশুদের পাঠ্যভুক্ত হতে দেয়নি।

আজকের বাংলাদেশ আমাদের পাকিস্তানিদের থেকে অনেক এগিয়ে। শিক্ষায়, অর্থনীতিতে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুনাম অর্জনে—সব দিক থেকে। বাংলাদেশের ডক্টর ইউনুস গ্রামীণ ব্যাংককে সফল মাইক্রো ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন।

বাংলা ভাষা আন্দোলন: ঢাকায় কী ঘটেছিল

ওয়াজাহত মাসউদ, বিবিসি উর্দু, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৬

কায়েদ–ই–আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর একবারমাত্র পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছিলেন।

৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দিতে গিয়ে ‘উর্দু আওর স্রেফ উর্দু’কে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা দেন।


কায়েদ–ই–আজমের প্রতি সীমাহীন ব্যক্তিক শ্রদ্ধাবোধ থাকার পরও বাঙালি ছাত্র–জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।

জিন্নাহর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কোনো সমাবেশে এমন খোলাখুলি বিরোধিতার মুখোমুখি খুব কমই হতে হয়েছে।
পাকিস্তানের মাত্র ৪ শতাংশ মানুষের ভাষা ছিল উর্দু। অন্যদিকে ৫৬ শতাংশ মানুষ কথা বলত বাংলায়।

শিল্প-সাহিত্য ও একাডেমিক জ্ঞানকাণ্ডের ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা ভারতের অন্যতম উন্নত ভাষা হিসেবে বিবেচিত হতো।
ভারতে সাহিত্যে একমাত্র নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বাঙালি সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

অগণিত নদীনালার ঢেউয়ে বোনা বাংলা ভাষার সুর সংগীতের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দাদের সঙ্গে বাংলা ভাষার কেবল সংবেদনশীল অনুরাগের সম্পর্ক ছিল না, বরং তা ছিল তাদের জন্য অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও রাজনৈতিক সুযোগের প্রশ্নও।


ঐতিহাসিকদের মতে, ভাষার এই লড়াইয়ের মূল শিকড় পোঁতা ছিল অবিভক্ত পাকিস্তানের অদ্ভুত মানচিত্রে।

পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল। তাই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করাটা ছিল মুশকিল।

অন্যদিকে উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে যৌথভাবে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করলে অন্যান্য প্রদেশের আঞ্চলিক ভাষাভাষীদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা ছিল।

উর্দু দেশের কোনো অঞ্চলেরই স্থানীয় ভাষা ছিল না। তাছাড়া সরকারি আমলাদের ওপর উর্দু ভাষীদের প্রভাব ছিল।
নীতিনির্ধারকেরা এর সমাধান বের করতে গিয়ে ভাবলেন, উর্দুকে ধর্মীয় লেবাস পরিয়ে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া যাক। ধারণা ছিল, ধর্মের ছদ্মবেশে এই কৃত্রিম সমাধান দিয়ে কোনোরকমে উতরে যাওয়া যাবে। কিন্তু তা আর হলো কই।

ফজল ইলাহী চৌধুরী (পরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি) মাওলানা আবুল কালাম আযাদের সঙ্গে সাক্ষাতের সূত্রে লেখেন, মাওলানা অন্যান্য ইস্যুর বাইরে পরামর্শক হিসেবে বলেন, ভাষা ইস্যুতে যেন পূর্ব পাকিস্তানের আবেগের দিকে লক্ষ্য রাখা হয়।

মাওলানার কথা ছিল বাঙালিদের নিজস্ব ভাষার সঙ্গে কতটা দৃঢ়সম্পর্ক, তা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠীর কোনো ধারণাই নেই।
২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দেয়। ছাত্ররা তিন ঘণ্টা কাঁদানে গ্যাস ও পুলিশের লাঠিচার্জের মোকাবিলা করে।

মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি আসতেই পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। সঙ্গে সঙ্গে পাঁচজন শিক্ষার্থী—রফিক, জব্বার, বরকত, শফিক ও আবদুস সালাম ঘটনাস্থলেই নিহত হন।

বহু ছাত্র আহত হয়। ছাত্র–জনতার ওপর গুলি চালানোর খবরে শহরজুড়ে শোক ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

কয়েক বছর পর ফয়েজ আহমদ ফয়েজ তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘ইনতেসাব’-এ পাকিস্তানের এই সূর্যসন্তানদের স্মরণ করে লেখেন:


সেসব শিক্ষার্থীদের নামে
যারা শক্তিমানদের
দ্বারে কাগজ কলমের
দাবি নিয়ে হাত মেলে ধরে
নিয়ে নিষ্পাপ সরলতা
ছোট্ট প্রদীপে শিখা জ্বালানোর আশা নিয়ে
এসেছে যেখানে
বিলাচ্ছে ঘন অন্ধকার রাতের ছায়া