রূপ সাহার খাল ও সতীশ মিত্রর স্মৃতি

মীর্জানগরের কামান। কামানের উপর উপবিষ্ট সতীশচন্দ্র মিত্র
মীর্জানগরের কামান। কামানের উপর উপবিষ্ট সতীশচন্দ্র মিত্র

নদী সংযুক্ত করতে তিনি খাল খনন করেছিলেন, নাম হলো তার রূপ সাহার খাল। কালের আবর্তে সেই খাল এখন ভৈরবের মূল স্রোত রূপসা নদী। ১৯১৪ সালে বাঙালি এই কীর্তিমানের কাছ থেকে পায় ‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’-এর মতো একটি আকর গ্রন্থ।

১.
অসামান্য গুণটি সংখ্যার আধিপত্যকে হ্রস্ব করতে পারে। প্রতাপের দাপট বদলে দেয় মানচিত্র। মানুষ থেকে প্রকৃতি সবখানেই সে নিয়মের সাযুজ্য। ৩০০ বছর আগে রূপসা নদী ছিল না। এমনকি আড়াই শ বছর আগে মেজর রেনেলের তৈরি গাঙ্গেয় উপদ্বীপের মানচিত্রেও অনুপস্থিত রূপসা। তবে বর্তমান খুলনার জেলখানা ঘাটটি ভৈরব-রূপসার সংযোগস্থানে। প্রায় ৩০০ বছর আগে এ পথ দিয়ে লবণ নিয়ে যাতায়াত করতেন নড়াইলের লবণ ব্যবসায়ী রূপচাঁদ সাহা। কাঁচিপাতা আর ভৈরবের মাঝে সামান্য একটু স্থলভাগ বলে ঘুরে যেতে হতো অনেকটা জলপথ। আপাতপ্রয়োজন মেটাতে তিনি খাল কেটে সংযোগ তৈরি করলেন ভৈরব-কাঁচিপাতার। নাম হলো রূপ সাহার খাল। আর সেই কাঁচিপাতাই এখন পরিচিত কাজিবাছা নামে। সেই খাল এখন ভৈরবের মূল স্রোত রূপসা নদী। ভৈরবের এক অংশ হরণ করা দাপুটে রূপসাকে সাহিত্যে এনেছেন জীবনানন্দ দাশ। ঘোলা জলে এক কিশোরের সাদা ছেঁড়া পালে ডিঙা বেয়ে আসাকে বাংলার প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি হিসেবে কল্পনা করেছিলেন তিনি। যেখানে অন্ধকারে রাঙা মেঘ সাঁতরে তীরে আসে ধবল বক। এই প্রতাপশালী রূপসার পারে থাকতেন অসামান্য এক মানুষ। যিনি হারানো বাঙালি সংস্কৃতির এক বিশাল অধ্যায় উদ্ধার করেছেন। ঐতিহাসিক তথ্যের মধ্য দিয়ে বলতে চেয়েছেন, এ সংস্কৃতির মূলস্রোত হিন্দু-মুসলমান দুই ধর্মীয় ভাবধারাতেই পুষ্ট। ইতিহাসকে চর্চাযোগ্য ও প্রয়োজনীয় করেছেন শত বছর আগে। অথচ প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণবিহীন সে কাজে ছিল না কোনো পৃষ্ঠপোষকতা। যা ছিল তা নিজেকে সম্পূর্ণ নিবেদন।

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের কাছে গিয়েছিলেন গুরুর জীবনী লিখে নিয়ে। আচার্য তাঁকে বললেন মানুষের কাজে লাগে এমন কিছু করতে। যেমন নিজের জনজাতি ও জনপদের ইতিহাস লেখার কাজ। আচার্য তখনো হয়তো আন্দাজ করতে পারেননি, তাঁর বাক্যের অভিঘাত কোথায় পৌঁছাবে। এরপর কয়েক বছর শিষ্যের আর কোনো খবর নেই দেখে আচার্য ভাবলেন, পালিয়েছে। একদিন বিস্তর পাণ্ডুলিপি ও নথিপত্র নিয়ে ফিরলেন শিষ্য। প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বিস্ময়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন সে কাজের দিকে, তারপর বললেন, ভুল আমারই হয়েছে। গুরুর মুখে এমন কথা শুনে শিষ্য ভাবলেন সব অনর্থ তবে! কয়েক বছর ধরে বনে-বাদাড়ে নিজের জীবন বিপন্ন করে তন্ন তন্ন করে খুঁজে আনা এক একটি নতুন আবিষ্কার মূল্যহীন হলো বলে বেদনাহত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন নতমুখে। আচার্য বললেন, এই কাজ আমার প্রত্যাশার বাইরে। ভুল করে সুন্দরবনের ইতিহাস লিখতে বলেছিলাম, বরং ভারতবর্ষের ইতিহাস প্রণয়ন করতে দিলে মানুষ আরও বড় উপকার পেত। কাজটি তুমিই পারতে যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে। আনন্দে-বিস্ময়ে-উৎসাহে শিষ্য শুরু করলেন দ্বিতীয় খণ্ডের জন্য তথ্য সংগ্রহ। ১৯১৪ সালে বাঙালি পেল ‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’-এর মতো একটি আকর গ্রন্থের প্রথম খণ্ড। শতবর্ষী যে গবেষণা এখনো সমকালীন।

৯১ বছরের আবুল হোসেন খাঁ
৯১ বছরের আবুল হোসেন খাঁ

২.
খুলনার সাংবাদিক গৌরাঙ্গ নন্দী আর আমি ভৈরব-রূপসার সংযোগস্থানের সে জেলখানা ঘাট থেকেই নৌকায় উঠেছিলাম। ওপাশে বেলফুলিয়ার দেয়াড়া গ্রাম আমাদের উদ্দেশ্য। ভৈরবের যে অংশে আঠারোবেঁকী নদীর শাখা শুরু, সেখানে সেনহাটি নামে এক বাজার। ধারণা করা হয়, আঁইচগাতি ইউনিয়নের ওই বাজার সেন শাসনামলের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ নদীটি আঠারোটি বাঁক নিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে বলে ভৈরবের ওই অংশের নাম হয়েছে আঠারোবেঁকী। নৌকায় মিনিট দশের পথ। মাঘের সকালে কুয়াশার ভেতর দূরে রূপসা সেতুর সামান্য আভাস। আমাদের নৌকায় পারাপারের নিত্য যাত্রীসহ গৃহপালিত প্রাণীও আছে। ভৈরব হয়ে আঠারোবেঁকীর মুখে নৌকা থামলে কাঠের পাটাতন দিয়ে উঠতে হয় ওপাশে।

১৩২৯ বঙ্গাব্দে ‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় সতীশচন্দ্র মিত্রর স্বাক্ষরের তলায় লেখা বেলফুলতলিয়া থেকে। ১৮ আশ্বিনের সেদিন ছিল লক্ষ্মীপূর্ণিমা। প্রায় শত বছর পর আমরা দুই সংবাদকর্মী নেহাত ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকে চলেছি বেলফুলতলিয়ায় সতীশচন্দ্র মিত্রর স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে দেখতে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, বর্তমানের খুলনার বয়স ৩০০ বছর হলেও নদীর ওপাশে এককালের সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে সাড়ে চার শ বছরের পুরোনো বাড়িও পাওয়া গেল। আবার দেশভাগের মর্মন্তুদ ইতিহাস নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে সাত-আট দশক আগের বসতও। সতীশচন্দ্র মিত্রর নাম এখানে কেউ জানে না। খুলনা জাতীয় জাদুঘর আর উমেশচন্দ্র পাঠাগারে তাঁর প্রৌঢ় বয়সের দুটো ছবি আছে। সেসব হাতে আঁকা। খুলনা শহরের এক সাংবাদিকের সঙ্গে ফোনালাপের মাধ্যমে কিছুটা নির্দেশনা জেনে নিলেন সাংবাদিক গৌরাঙ্গ নন্দী। পাওয়া গেল ২০০ বছরের পুরোনো আবাস ভৌমিকবাড়ি। এ বাড়ির একপাশে বাঁধানো মনসাপুজোতলা। সেখানে কাঁটাঝোপ গাছের ভেতর অসংখ্য সাপ বেরিয়ে আসছে কলস থেকে। বাঁধানো তুলসীতলা অতিক্রম করে বাড়ির সিঁড়িতে প্রবেশ করতেই বেরিয়ে এলেন এক প্রবীণা। আমরা ধারণা করেছিলাম, এখানেই ছিল মিত্তিরবাড়ি। প্রবীণার মুখেই শুনলাম, সতীশচন্দ্র মিত্রকে তিনি দেখেননি তবে, তাঁর কাকাশ্বশুরের সঙ্গে ছিল দারুণ সখ্য। প্রায়ই এ বাড়িতে সতীশ মিত্র আসতেন বটে তবে, তাঁদের বাড়ি আরও খানিকটা দূরে। এই ভৌমিকেরা ২০০ বছর আগে ফরিদপুর থেকে এখানে এসেছিলেন বনকেন্দ্রিক ব্যবসার জীবিকায়। পরের প্রজন্ম অধিকাংশ চলে গিয়েছে ভারতে। তাঁদের কাছ থেকে তথ্য পেলাম আবুল হোসেন খাঁ নামে একজনের। যিনি এ অঞ্চলের সবচেয়ে বর্ষীয়ান এবং এখনো সব স্মৃতি অক্ষত আছে। মানে ভালোই বলতে পারেন দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধের গল্প।

ভৌমিকবাড়ির পশ্চিমেই আবুল হোসেন খাঁ সাহেবের বাড়ি। তাঁদের নয় পুরুষের বাস এখানে। খাঁবাড়ি পৌঁছে দেখলাম, ৯১ বছরের মানুষটি তখন বারান্দার উষ্ণ রোদে বসে আছেন। একপাশে বহুদিনের পুরোনো হেঁশেলে জল গরম হচ্ছে। ভেতর বাড়ির দুটো ঘর দেড় শ বছরেরও বেশি আগের। সেখানে রেললাইনের স্লিপার দেওয়া সিলিং। মুসলমান বাড়ির ভেতরও কুলুঙ্গি প্রদীপ রাখার নকশা। বৃদ্ধ গোসলের জন্য অপেক্ষা করছেন। দোতলার বারান্দায় বসে আছেন তাঁরই মতো আরও একজন। তিনি উৎসুক চোখে চেয়ে দেখছেন আমাদের। হাঁটাচলা করতে পারেন না। জানালেন, বন কেটে বসত করেছিলেন তাঁদের নয় পুরুষ আগের একজন। তখনো এ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বাদাবন। চারপাশে ছিল জংলা। মুর্শিদ কুলি খাঁর সঙ্গে তাঁদের লতায়-পাতায় আত্মীয়তা আছে। তাঁর কাছে জানতে চাই মিত্তিরবাড়ির খোঁজ। মিত্রবাড়ির ডাক স্থানীয়দের মুখে মিত্তির হয়েছে। বললেন, ওই বাড়িটি এখন গাজীবাড়ি। ভৌমিকবাড়ি বাঁয়ে রেখে হাজার খানেক গজ সামনে এগিয়ে হাতের ডানে গাজীবাড়ি। রাস্তা থেকে পুরোনো দোতলা বাড়িটিতে লেখা গাজী ভিলা।

শত বছরের ব্যবধানে সেই ছায়াঢাকা গ্রামের বদলে অনেক বাড়িঘর বসতির মধ্যেও গাজী ভিলার সাইনবোর্ড জ্বলজ্বল করছে, যেখানে ঢাকা পড়ে গেছে একসময়ের মিত্তিরবাড়ি। যে বাড়িতে বাস করতেন সতীশচন্দ্র মিত্র। তাঁদের দেয়াড়ার বাড়ির ছয় বিঘা জমি কিনেছিলেন শহর আলী গাজী। আরও অনেক জমি ছিল। তা বিক্রি, নাকি সতীশ মিত্রর ভাইয়েরা ফেলে গিয়েছিলেন, সেসব তথ্য জানা যায় না। আবুল হোসেনের ভাষ্য, ওটাই ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র মিত্রর বাড়ি। গাছপাতার আবরণের ভেতর অবহেলায় লুকিয়ে থাকা দুটো পুরোনো ভাঙা কালভার্ট এখনো ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে। এটুকু ছাড়া সেই পুরোনো বাড়ির আর কোনো চিহ্ন নেই। সতীশ মিত্রর নিজের লেখা থেকে পাওয়া যায়, এখানে নদীর ভাঙনের মুখে একবার নিশ্চিহ্ন হয়েছিল বসত। ধারণা করি, শত বছর আগে ভৈরবের যাতায়াতমুখ আরও খানিকটা এদিক ঘেঁষা ছিল।

সতীশচন্দ্র মিত্রকে নিয়ে লেখা শুরু হয়েছিল একটি সাদাকালো ছবির সূত্র ধরে। ২০০১ সালে প্রকাশিত ‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থের সংস্করণের ১ হাজার ৯০ পৃষ্ঠায় ছবিটি আছে। মির্জানগরে একটি কামানের ওপর আধশোয়া ভঙ্গিমায় বসেছেন মিত্র। মাথার ওপর রাজছত্র ধরে আছেন একজন পেয়াদা। ছবিটি বিংশ শতকের গোড়ার দিকে তোলা। বাংলা ১৩২১ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের প্রথম সংস্করণেও এই ছবি সংযুক্ত ছিল কি না, তা আর এখন জানার উপায় নেই। শতবর্ষ আগের এই ইতিহাসবিদের দুটো মাত্র আলোকচিত্র পাওয়া যায়। তারই একটি এটি। এ ছবিটি তিনি দ্বিতীয় খণ্ডের জন্য তথ্য উপাত্ত সংগ্রহকালে তুলেছিলেন। ছবি দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এ শৌখিন আলোকচিত্র। তথ্য সংগ্রহের সময় শ্বাপদসংকুল বনবাদাড়ে পকেটের পয়সা বাঁচিয়ে ক্রোশের পর ক্রোশ পদব্রজে চলাকালে এমন একটি ছবি দেখে বিস্মিত হতে হয়। ধারণা করি, এ ছিল লেখকের কাজের সাফল্যের উদ্‌যাপন। অথচ যে কাজটি শুরু হয়েছিল শুধু গুরুর একটি বাক্যে। প্রথমে কোন দিকনির্দেশনা ছিল না। ছিল না ইতিহাস সংগ্রহের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা।

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রকে লেখা এক চিঠিতে উল্লেখ আছে, একবার তিনি এমনই বসন্তে আক্রান্ত হয়েছিলেন যে তাঁর মৃত্যুর খবর প্রচারিত হয়েছিল আর আত্মীয়রা উপস্থিত হয়েছিলেন তাঁর শেষকৃত্যের জন্য। সেখান থেকে বেঁচে উঠে শুরু করেছিলেন, ‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডের কাজ। সেই পত্রেই পাওয়া যায়, কোন ধরনের আর্থিক সহায়তা ছাড়া একক প্রচেষ্টায় কয়েক বছর ধরে সুন্দরবনের ভেতর থেকে ঈশ্বরীপুর, মির্জানগর থেকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার প্রতি ইঞ্চি জমি, প্রতিটি প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন তিনি স্পর্শ করে দেখেছেন সে ইতিহাস। তাই বলিষ্ঠ কণ্ঠে সমালোচনাও করতে পেরেছেন সাহিত্যে উপস্থিত ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে। বলেছেন, ঔপন্যাসিক হলেই নিরঙ্কুশ হয়ে সত্যের অপলাপ করার অধিকার নেই। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’–এর প্রতিক্রিয়ায় লেখা সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর ‘রায়নন্দিনী’ নিয়ে সতীশচন্দ্র মিত্রর আক্ষেপ ছিল, ঐতিহাসিক অসামঞ্জস্য ও অমূলক কলঙ্কারোপ দোষে দুষ্ট। এসব ইতিহাস বঙ্গ তথা ভারতীয় ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে ভিত্তি পত্তনে বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ থাকে। অনিরপেক্ষ এবং প্রস্তুতিবিহীন উপন্যাস যে ইতিহাসের জন্যও ক্ষতিকর, সে কথা তিনি উল্লেখ করেছেন রাজা সীতারাম রায় পরিচ্ছেদে। মিত্র বলছেন, ‘উপন্যাস ও ইতিহাসের বিস্তর প্রভেদ। সুখপ্রিয় বাঙ্গালীর দেশে উপন্যাসের আদর এতই বৃদ্ধি পাইয়াছে এবং উপন্যাসের কৃত্রিম কৌশলে অনেক চিত্র এতই বিকৃত হইয়া পড়িয়াছে যে, এক্ষণে ইতিহাসের সত্যবার্তাও কাল্পনিক বলিয়া উপেক্ষিত হইতেছে।’ ঐতিহাসিক উপন্যাসে অসহিষ্ণুতার প্রমাণ আছে বলে খেদ ছিল সতীশ মিত্রর। এসব কারণে নিজেও সমালোচনার মুখে পড়েছেন অনেকের। ‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’ আকর গ্রন্থ নিয়ে তাই পাঠকের উদ্দেশ্যে স্বগতোক্তি, ‘পুস্তকে যাহা কিছু লিখিত হইয়াছে, তাহা ঐতিহাসিক মর্যাদা রক্ষার জন্য। কোন প্রকার স্বার্থ, স্বজাতিপ্রীতি, ভীতি বা অসূয়া কর্তব্যভ্রষ্ট করিতে পারে নাই।’

যশোহর খুলনার ইতিহাস
যশোহর খুলনার ইতিহাস

বছরখানেক আগে সুন্দরবনের আড়পাঙ্গাশিয়া, খোলপেটুয়া নদীর কাছে ১ হাজার ২০০ বছর আগের জনবসতির স্থাপনা পাওয়া গিয়েছে। ইসমে আজম নামে এক স্থপতি খুঁজে পেয়ে জানালেন, নিত্য জোয়ার-ভাটার এ অঞ্চলে এককালে ছিল সমৃদ্ধ মানববসতি। জলের তলায় খুঁজে পাওয়া সেসব স্থাপনার ইটগুলো বলছে, এসব পাল আমলের চিহ্ন। বনের গভীরে পাওয়া গিয়েছে বসতির নিদর্শন। এই তথ্য আমাদের অবাক করেছিল সন্দেহ নেই। বিভিন্ন গণমাধ্যম ছুটে গিয়েছে সুন্দরবনে জলের তলায় আবিষ্কার হওয়া প্রাচীন নগরীর স্মারক দেখতে। যতই পৃথিবীর সভ্যতার গল্প বরাবর এমনই হোক, নিজের চোখে দেখা অমন উত্তাল সমুদ্রের ভেতর একটা সমৃদ্ধ নগরী-জনবসতি কল্পনা করা সহজ নয়।

আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, ইতিহাস ধরে পেছনে গেলে দেখা যায়, সভ্যতার এই গল্প আরও শত বছর আগে সংগ্রহ করেছেন সতীশচন্দ্র মিত্র। তিনি নিজেই উনিশ শতকের শেষ দিকে কাজ শুরুর আগে সংগ্রহ করতেন সুন্দরবন অঞ্চলের প্রাচীন প্রত্নতত্ত্ব। মিত্র বলছেন, এখানে সভ্যতার গল্প অষ্টম শতকের পাল বংশীয় নয়, মৌর্য ও গুপ্ত যুগের। মহাভারতীয় যুগের নারাচী পুত্র কপিলমুনি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বাসুদেবের চক্রান্তে বিতাড়িত হয়ে সুদূর উপবঙ্গের খুলনা জেলার কপোতাক্ষ নদের তীরে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। সুন্দরবনের ভেতর তৈরি করেছিলেন আশ্রম। আদি হিন্দুযুগের ধেনুকর্ণের পুত্র কণ্ঠহার পেয়েছিলেন বঙ্গভূষণ উপাধি। এই বঙ্গভূষণ বর্তমান যশোরের উত্তর অংশ। এখন যে স্থানের নাম ভূষণা। রাজা লক্ষ্মণ সেনের সময়েও ছিল ধেনুকর্ণের মন্দির। এর পরপরই ডুবে যায় এ অঞ্চল।

বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তিতে যেসব তথ্য সহজে সংগ্রহ সম্ভব তা শত বছর আগে অকল্পনীয় ছিল। সতীশচন্দ্র মিত্র সুন্দরবন অঞ্চলের যেসব তথ্য নিদর্শন সংগ্রহ করেছেন, তা এখনো ইতিহাসবিদদের কাছে বিস্ময়ের। ‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের প্রকাশ ১০৬ বছর আগে। দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম প্রকাশ ১০০ বছর আগে।

পরিবর্তন দৃশ্যমান হতে সময়কেও সময় দিতে হয়। ইতিহাস সময়কালের অনুভব বদলে বদলে দেয়। মুঘল সাম্রাজ্যের এক অস্পষ্ট ইতিহাস পাঠ, ৭০০ থেকে ৮০০ বছরকেও দূরবর্তী করে তুলতে পারে। আবার এ অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস নিয়ে একটি গভীর লেখা দুই হাজার বছরও খুব সহজে অনুমেয় করে তোলে। সতীশচন্দ্র মিত্র গোটা সুন্দরবন অঞ্চলের দুই হাজার বছরের ইতিহাস দুখণ্ডের দেড় হাজার পাতার ভেতর সাজিয়ে রেখেছেন পাঠকের জন্য। এরপর দেশভাগের ফলে সুন্দরবন ভাগ হয়েছে। ইতিহাসবিদদের গবেষণাকাজেও তার ছাপ পড়েছে। অনেক রকম করে এ অঞ্চলের ইতিহাস লেখা হলেও এখন পর্যন্ত সতীশচন্দ্র মিত্রর কাজটিই আকর গ্রন্থ। এ অঞ্চলের ইতিহাস, ভূগোল নিয়ে শিশুদের জন্য বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করলেও তাঁর বড় কাজ এই একটি। আর ওই একটি কাজই অসামান্য। শত বছর আগের সেই সাদা-কালো ছবিটি তাই পাঠকের কাছে আরও বেশি অসামান্য হয়ে ধরা দেয়। যেমন রূপসা নামের একটি ছোট্ট খালের ইতিহাস বিস্মিত করে এই নদীপথের যাত্রীদের। ভৈরব-রূপসার সংযোগস্থান থেকে সতীশচন্দ্র মিত্রর স্মৃতিচিহ্ন খুঁজতে যাওয়া তাই আমাদের জন্যও ছিল পুণ্যযাত্রাসমান।