ধীরে চলা

(নবম কিস্তি) 


ভেরা ঘুমিয়ে আছে। আমি বাগানের দিকের জানালাটা খুলি। ভাবতে থাকি মাদাম দে টি এবং তরুণ শেভালিয়ের অভিসার নিয়ে। তারা প্রাসাদ ছেড়ে বাইরে গেল, তিনটা পর্বে ভাগ করা একটা যাত্রা সম্পন্ন করল।
তারা হাতে হাতে রেখে চলে, তারা কথা বলে, লনে একটা বেঞ্চ ছিল, তারা তাতে বসে। তারা গল্প করতেই থাকে। চাঁদের আলোয় ভরা রাত। তারা হাতে হাতে রেখে গল্প করেই চলে। সিন নদীর দিকে নেমে গেছে বাগানের চত্বরগুলো। নদীর কল্লোলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে পাতার মর্মর। আসুন, আমরা তাদের কথোপকথনের কিছু কিছু অংশ তুলে নিই। শেভালিয়ে একটা চুমু চায়। মাদাম জবাব দেয়, ‘আমিও চাইছি। আমি যদি প্রত্যাখ্যান করি, তাহলে তুমি পুরোটাই বৃথা হয়ে যাবে। তোমার আত্মমর্যাদা তোমাকে ভাবাবে যে আমি তোমাকে ভয় পাই।’
মাদাম দে টি যা বলেন, তার সবই শিল্পপ্রসূত। কথা বলার শিল্প। মন্তব্য ছাড়া কোনো আচরণ নয়। কাজ আর কথার মিল অবশ্য নাও থাকতে পারে। যেমন ধরা যাক, শেভালিয়ে চুমু চাইল। মাদাম তা বরাদ্দ করলেন। কিন্তু তা করলেন এ বিষয়ে নিজের ব্যাখ্যা চাপিয়ে দেওয়ার পর। আবার তা এমন যেন শেভালিয়ের গর্ব ব্যাহত না হয়।
বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়াস দিয়ে যখন মাদাম একটা চুম্বনকে পরিণত করে প্রতিরোধের একটা অংশ হিসেবে, কেউই কিন্তু ঠকে না। শেভালিয়েও না। কিন্তু শেভালিয়েও মাদামের কথাগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে, কারণ তারা একটা মানসিক প্রক্রিয়ার ভেতরে আছে, যে প্রক্রিয়া আরেকজনের মানসিক প্রক্রিয়াকে প্রত্যুত্তরে প্রত্যাশা করে। কথোপকথন সময়কে পার করার একটা উপায় নয়, কথোপকথন হলো সময়কে সুন্দরভাবে বিন্যস্ত করে তোলে, সময়কে শাসন করে, নিজের আইন জারি করে, যা মান্য করা উচিত সশ্রদ্ধভাবে।
ওই অভিসারের রাত্রির প্রথম পর্বের শেষে কী হয়? মাদাম যে চুমুটা বরাদ্দ করেছিল শেভালিয়ের জন্য, যাতে সে নিজেকে বৃথা মনে না করে, আরেকটা চুমু ডেকে আনে। আরও আরও চুমু। আরও চুমু খুব জরুরি, কথাকে কর্তন করে, কথাকে সরিয়ে দিয়ে। তারপর হঠাৎ করে মাদাম দাঁড়ায় আর সিদ্ধান্ত নেয় ঘুরে দাঁড়ানোর।
আহ! কী মঞ্চকলা! অনুভূতির প্রাথমিক দ্বিধার শেষে এটা দেখানো দরকার হয়ে পড়েছিল যে ভালোবাসার আনন্দ এখনো পাকা ফলের মতো হয়ে ওঠেনি। এর দাম বাড়াতে হবে। এটাকে আরও কাম্য করে তুলতে হবে। একটা বাধা আসতে হবে। একটা উত্তেজনা দরকার হবে। একটা সাসপেন্স। প্রাসাদে ফেরার সময়টাতে মাদাম একটা ভান করে যে তারা কিছুই করবে না। আসলে সে জানে যে সে এই পরিস্থিতিটা পুরো পাল্টে ফেলার ক্ষমতা রাখে। তাদের এই মিলনমুহূর্তটিকে সে শুধু একটু দীর্ঘায়িত করতে চাইছে। যা লাগবে, তা হলো একটি কথা, একটি কথার দ্বিধা থরথর চূড়া, শত বছরের পুরোনো শত কথার ভেতর থেকে। কিন্তু কথা আর কাজের স্রোতের মধ্যে, প্রেরণার অপ্রত্যাশিত অভাবের মধ্যে, তার মনে একটা কথাও আসছে না। তার অবস্থা হলো সেই অভিনেতার মতো, যে কিনা তার নাটকের সংলাপ ভুলে গেছে। আসলেই তাকে নাটকের পাণ্ডুলিপিটা মনে করতে পারতে হবে। এটা তো আজকের যুগের মতো নয়। আজকের দিনে কী হয়, একটা মেয়ে একটা ছেলেকে বলে, ‘তুমিও এটা চাও, আমিও এটা চাই, সময় নষ্ট না করে এসো কাজটা সেরে ফেলি।’ তাদের দুজনের খোলামেলা মনোভাব এখনো একটা পর্দায় ঢাকা, যে পর্দা তারা ছিঁড়ে ফেলতে পারে না। যদিও তারা নিজেদের মনে করে সংস্কারমুক্ত। মুক্তমনা। তারা তাদের হেঁটে চলার জন্য যদি কোনো কথা খুঁজে না পায়, এটা হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে তারা তাদের প্রাসাদে ফিরে যাবে নীরবতার যুক্তির স্বাভাবিক টানে। তারপর তারা পরস্পর থেকে বিদায় নেবে। তারা যতই অনুভব করছে একটা কথা খুঁজে পাওয়ার, আর জোরে তা বলার, ততই তাদের মুখ কে যেন সেলাই করে দিচ্ছে। আহা, এই দুজনকে কথা জোগাও। অথচ কথারা পালিয়ে যাচ্ছে। যেন তাদেরকে সাহায্য করা দরকার। তারা যখন প্রাসাদের দরজায় পৌঁছাল, উপন্যাসে কথক বর্ণনা করছে, ‘তখন পারস্পরিক তাড়না থেকে, আমাদের চলা ধীর হয়ে এল।’
ভাগ্য ভালো, সেই সময়ে নাটকের প্রম্পটার মাদামের মুখের সংলাপ ধরিয়ে দিল। মাদাম শেভালিয়ে আক্রমণ করল, ‘আমি তোমার ওপরে বেজায় অখুশি।’ অবশেষে! অবশেষে। বাঁচা গেল। মাদাম রাগান্বিত। এই কপট রাগ তাঁদের হাঁটাটাকে দীর্ঘায়িত করবে। মাদাম তো ছেলেটির সঙ্গে খোলাখুলিভাবে মিশছেন। তাহলে শেভালিয়ে কেন তাকে বলেনি যে তার প্রেমিকা আছে, সে হলো কমতেস! জলদি জলদি! এটা হলো কথা চালিয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ। তাদের অবশ্যই কথা চালিয়ে যেতে হবে। আবারও কথা শুরু হলো। কথা চলতেই থাকল। তারা প্রাসাদের গেট থেকে উল্টো দিকে হাঁটতে লাগল। তারা এবার ভালোবাসার বন্ধনহীন গ্রন্থিতে গিয়ে পৌঁছাল।

[হায়, প্রিয় পাঠক, ভেরা ঘুমিয়ে আছে। আর লেখক জানালা খুললেন। ভেরা ঘুমিয়েই আছে। আর লেখক চলে গেলেন মাদাম আর শেভালিয়ের সেই প্রাচীন উপন্যাসের বর্ণনায়। একেই কি বলে উপন্যাস?]