ধীরে চলা

(১১ কিস্তি)
১১
মাদাম দে টির শারীরিক অবয়বের বর্ণনা দেননি দেনো। তবে একটা বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়, মাদাম ক্ষীণাঙ্গি ছিলেন না। আমার কল্পনায় তাঁর ছিল সুগোল সুষম কটিদেশ, ল্যাকলোর উপন্যাস ‘ডেঞ্জারাস লিয়াজোঁ’য় আকর্ষণীয় নারীশরীরের যে বিবরণ আছে, সে রকম করে যদি বলি। আর সেই শারীরিক গোলাকৃতি তাঁর চলায়-বলায় ভঙ্গিতে একটা গোল গোল ভাব; একটা ধীরতা নিশ্চয়ই দেয়, একটা ধীরতা উদ্ভাসিত হয়। সুস্থিরতার প্রজ্ঞা আছে তাঁর, সবকিছুকে ধীর করে ফেলার সমস্ত কৌশল তিনি প্রয়োগ করেন। এই কৌশল তিনি প্রয়োগ করেন রাতের দ্বিতীয় ভাগে, যখন তাঁরা ছিলেন চালাঘরে, তাঁরা সেই ঘরে ঢুকলেন, তাঁরা পরস্পরকে আলিঙ্গন করলেন, তাঁরা বিছানায় ঢলে পড়লেন, তাঁরা মিলিত হলেন। কিন্তু ‘এসবই ঘটল একটু বেশি তাড়াহুড়া করে। আমরা আমাদের ভুল বুঝতে পারলাম...আমরা যখন বেশি অনুরক্ত হয়ে পড়ি, আমরা তখন সূক্ষ্মতা হারাই। আমরা ইন্দ্রিয় পুলকের পেছনে ছুটি, ফলটি দাঁড়ায়, আমরা পথের বহু আনন্দকে ঝাপসা করে ফেলি।’


যে তাড়াহুড়া করতে গিয়ে তাঁরা ধীরতা হারালেন, সেটাকে তাঁরা দুজনেই ভুল বলে স্বীকার করেন। কিন্তু আমি মনে করি না যে মাদাম দে টির জন্য কোনো চমক ছিল। বরং তিনি জানতেন যে এই ভুল অনিবার্য, এ রকমটা ঘটতে বাধ্য, তিনি এমনটাই প্রত্যাশা করছিলেন, এই জন্যই তিনি চালাঘরের পর্বটাকে একটা গতিনিরোধক হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন, ঘটনার দ্রুত ঘটে যাওয়াতে বিরতি দিতে, তাকে মার্জিত করতে, যা কিছু ঘটবেই, যা কিছু ঘটে গেছে, তাকে ধীরতা দিতে। যখন তৃতীয় পর্ব এল, নতুন একটা পরিবেশে, তখন তাঁরা রাত্রিটাকে যাপন করলেন চমৎকার ধীরতা মন্থরতা দিয়ে।

চালাঘরে তিনি মিলনে বিরতি নেন। শেভালিয়েকে নিয়ে আরও খানিকটা হাঁটেন। লনের মাঝখানে বেঞ্চে বসেন। আবারও গল্প জুড়ে দেন। তারপর তাঁকে প্রাসাদঘরে নিয়ে যান। তার নিজের বাসগৃহের পাশে একটা গোপন ঘরে তাঁরা যান। এটা তাঁর স্বামী জাদুকরি প্রেমের মন্দির হিসেবে সাজিয়ে রেখেছেন। শেভালিয়ের দরজার মুখে থামে, ঝলকানিতে অন্ধ হওয়ার উপক্রম তার, চারদিকে অনেক আয়না, দেয়াল জোড়া আয়নার মধ্যে অগণন জুটি পরস্পরকে আলিঙ্গন করছে। কিন্তু এখানে তাঁরা মিলিত হলেন না। মাদাম চান যে তাঁদের কামনা উত্তেজনা দীর্ঘস্থায়ী হোক। তাঁরা গেলেন পাশের আরেকটা ঘরে। গুহার মতো অন্ধকার। নরম গদি। সেখানেই তাঁরা সংগম করেন। ধীরে ধীরে। অনেকক্ষণ ধরে। দিনের অবসান পর্যন্ত।

রাতের এই অধ্যায়গুলোকে ধীরতা দিয়ে, এগুলোকে বিভিন্ন পর্বে ভাগ করে নিয়ে, একটা পর্বের থেকে আরেকটাকে আলাদা করে রেখে, মাদাম টি একটু ক্ষুদ্র সময়পর্বকে চমৎকার ছোট্ট স্থাপত্যর্কীর্তিতে উন্নীত করতে সমর্থ হন। একটা সময়খণ্ডের ওপরে একটা গড়ন চাপিয়ে দেওয়া কেবল সৌন্দর্যের চাওয়া নয়, এটা মানুষের স্মৃতিরও দাবি। যার কোনো গঠনশৈলী নেই, তাকে তুমি তো ধরতে পারবে না, তাকে স্মৃতিতেও ধরে রাখতে পারবে না। তাঁদের এই মিলনটাকে একটা গড়ন দেওয়া তাঁদের জন্য খুবই মূল্যবান, কারণ তাঁদের এই নিশীথের কোনো পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। এই একটা রাত কেবল স্মৃতিতেই ফিরে পাওয়া সম্ভব।

ধীরতার সঙ্গে স্মৃতির সম্পর্ক আছে। ভুলে যাওয়ার সঙ্গে সম্পর্ক আছে গতির। একটা খুব সাধারণ ঘটনার কথাই ধরি। একটা লোক রাস্তায় হাঁটছে। সে একটা কিছু মনে করতে চায়। কিন্তু মনে পড়ছে না। তখন সে তার হাঁটার গতি কমিয়ে দেবে। আরেকজন একটা ঘটনা ভুলে যেতে চাইছে। তখন সে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেবে। যেন সে চেষ্টা করছে তাঁর স্মৃতি থেকেই দূরে সরে যেতে, যত তাড়াতাড়ি পারা যায়।

অস্তিত্ববাদী গণিতে, এই অভিজ্ঞতা দুটো মৌলিক সূত্র দিয়ে প্রকাশ করা যায়: স্মৃতির গভীরতা ধীরতার সমানুপাতিক। ভুলে যাওয়ার হার গতির সঙ্গে সমানুপাতিক।

[আমরা ভেরাকে ভুলে গেছি। হোটেল রুমকে ভুলে গেছি। জানালা দিয়ে বাগান দেখতে গিয়ে সাহিত্য ও দর্শন আলোচনা করছি। সুবিধা হলো, এটা করতে আমাদের ভালো লাগছে। এই আলোচনাটা আমরা উপভোগ করছি।]

আরও পড়ুন: