ধীরে চলা

১৪

এই গল্প আমাকে আরেকটা ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। গুজা তাঁর অ্যাপার্টমেন্টের প্রত্যেকটা দেয়াল বানিয়ে রেখেছেন লাইব্রেরি। একদিন যখন আমার রাগ কোনো কারণে তাঁর সামনে প্রকাশ করে ফেলছিলাম, তিনি তাঁর লাইব্রেরির একটা তাক দেখালেন, যেটাতে তিনি ফলক লিখে রেখেছেন, ‘অনিচ্ছায় ঘটে যাওয়া রসিকতাসমূহের মাস্টারপিস’। এক নারী সাংবাদিকের বই, ১৯৭২ সালে প্রকাশিত, কিসিঞ্জারের জন্য ভালোবাসা নিয়ে লেখা, আপনারা যদি কিসিঞ্জারের নাম মনে রেখে থাকেন, তিনি ছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের উপদেষ্টা, যিনি ভিয়েতনাম-আমেরিকার মধ্যে শান্তি স্থাপন করেছিলেন।

গল্পটা এ রকম।
নারীটি কিসিঞ্জারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। প্রথমে একটা ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে। তারপর একটা টেলিভিশনের হয়ে। তাঁরা কয়েকবার বৈঠক করেন, কিন্তু সবই হয়েছিল পেশাদারির সীমা কঠোরভাবে মান্য করে। একটা–দুটো নৈশভোজ, তা ছিল টেলিভিশনে প্রচারের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য, হোয়াইট হাউসে দু–তিনবার যাওয়া, বাড়িতে যাওয়া কখনো একা, কখনো সঙ্গে ক্রুদের নিয়ে। কিসিঞ্জার তাকে অপছন্দই করতেন। তিনি তো আর বোকা ছিলেন না। মেয়েটিকে দূরে রাখার জন্য তাকে তিনি শোনালেন সেই সব গল্প, যে কী করে মেয়েরা ক্ষমতার কাছাকাছি আসে, কেমন করে তার পেশাগত জীবন তাকে ব্যক্তিগত জীবনকে দূরে দূরে রাখে।

নারীটি এই সমস্তই খুব সুন্দরভাবে বর্ণনা করেন, কিন্তু এই সব কথায় তাঁর ভালোবাসা কমে না, তিনি নিরুৎসাহিত না হয়ে বরং স্থির করে ফেলেন যে তাঁরা দুজনে দুজনার। কিসিঞ্জারকে কি মনে হচ্ছিল একটু সাবধান এবং অবিশ্বস্ত? নারীটি তা নিয়ে বিস্মিত নন। এর আগে যেসমস্ত মেয়ের সঙ্গে কিসিঞ্জারের দেখা হয়েছিল, তারা তো আসলে তাঁর যোগ্য ছিল না। মেয়েটি বিশ্বাস করতে শুরু করে, একবার যদি কিসিঞ্জার বুঝতে পারেন সে তাঁকে কত বেশি ভালোবাসে, তাহলেই তিনি তাঁর খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসবেন, তাঁর দুর্ভাবনা থেকে প্রতিরোধ থেকে সরে আসবেন। আহা, নিজের ভালোবাসার পবিত্রতা নিয়ে নারীটি কী নিশ্চিতই না ছিল! সে কসম কেটে বলতে পারে, তার দিকে থেকে এই সম্পর্কের মধ্যে কোনো যৌনতা ছিল না। ‘যৌনতা? তিনি আমাকে শীতল করে ফেলতেন।’ সে লিখেছিল। একজন মেয়ের মতোই স্যাডিজম নিয়ে সে লেখে, বারবার, যে তিনি খুব খারাপ কাপড়চোপড় পরেন। তাঁর নারীরুচি খুব খারাপ। তিনি হ্যান্ডসাম নন। তিনি অবশ্যই প্রেমিক হিসেবে খুব খারাপ! তাপরেও সে তাঁকে আরও বেশি করে ভালোবাসতে থাকে। মেয়েটির দুই সন্তান, কিসিঞ্জারেরও তাই। সে একসঙ্গে ছুটিতে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে পারে, তিনি পারেন না। মেয়েটি কোট দি আজু যেতে চায় ছুটিতে একসঙ্গে। মেয়েটি খুশি, তাহলে দুই ছোট কিসিঞ্জার ফরাসি ভাষাটা খানিক চর্চা করতে পারবে।

একদিন মেয়েটি তার ক্যামেরা ক্রুদের পাঠিয়ে দেয় কিসিঞ্জারের বাড়িতে। কিসিঞ্জার আর সহ্য করতে পারেন না। লোকগুলোকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেন। আরেক দিন তিনি মেয়েটিকে তাঁর অফিসে ডেকে পাঠান। তার কণ্ঠস্বর ছিল ছিল কঠিন, শীতল। তিনি তাকে জানিয়ে দেন, অনেক হয়েছে, তার এই সব রহস্যময় আচরণ তিনি আর সহ্য করবেন না। মেয়েটি প্রথমে খুব হতাশ হয়। এরপর সে ব্যাপারটা বুঝতে পারে। মেয়েটি কিসিঞ্জারের জন্য রাজনৈতিক বিপদ ডেকে আনতে পারে। কিসিঞ্জারের গোয়েন্দারা নিশ্চয়ই তাঁকে এ ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছেন। যে রুমে তাঁরা দেখা করছেন, সেই রুমেই তো আছে অনেক ক্যামেরা অনেক মাইক্রোফোন। পুলিশ সব দেখছে–শুনছে। কাজেই কিসিঞ্জারের তো এই ভাবেই কথা বলা উচিত। মেয়েটি তাঁর দিকে করুণভাবে হাসিমুখে তাকায়। তার মনে হয়, ট্র্যাজেডির আলো জ্বলে উঠেছে। আর কিসিঞ্জারের অসহায় চাউনিতেও নিশ্চয়ই ভালোবাসার নিবেদনই ফুটে উঠেছে।

গুজা হাসেন। কিন্তু আমি তাঁকে বলি, মেয়েটির ফ্যান্টাসির মধ্যে যে স্পষ্ট সত্যটা লুকিয়ে আছে, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই সত্য খুবই তুচ্ছ, আক্ষরিক সত্য। যা আসল জিনিসটাকে আড়াল করছে। তাহলো এই বইটা। এই বইয়ের সত্য মহান, সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। তাঁরা দুইজন যখন একটা টেবিলের দুধারে বসে ছিলেন, তখন এই দুজনের মধ্যে ছিল এই অদৃশ্য বইটা। মেয়েটি এরপর যা করবে তার আসল উদ্দেশ্য ছিল এই বইটাই। এই বইটা কেন? কিসিঞ্জারের জীবনকাহিনি বলার জন্য। কক্ষনো না। মেয়েটি তার নিজের প্রতি নিজের যে ভালোবাসা তাকেই তুলে ধরতে চেয়েছে। সে তো বলেইছে যে প্রেমিক হিসেবে কিসিঞ্জার ভালো না। কিসিঞ্জারের শরীরের প্রতি তার কোনো প্রেম ছিল না। তাকে তার নিজের জীবনের সত্যই তাকে আকর্ষণ করেছিল। সে তার সামান্য জীবনকে অসামান্য করতে চেয়েছিল, এটাকে আলোয় আলোয় উজ্জ্বল করতে চেয়েছিল। মেয়েটি কিসিঞ্জারকে ভেবেছিল রূপকথার পঙ্ক্ষীরাজ ঘোড়া, যে তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে আকাশে।

গুজা কথা সংক্ষেপ করতে আমার মুখের দিকে ব্যঙ্গভরা চোখে তাকিয়ে বলল, মেয়েটি একটা বোকা।

‘না না। আরও সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে, যারা বলছে মেয়েটি বোকা নয়। এটা বোকামোর থেকে আলাদা। মেয়েটি নিজেকে একজন “নির্বাচিত” বলেই কল্পনা করতে শুরু করেছিল।’
(চলবে)

আরও পড়ুন: