ধীরে চলা

(তেরো কিস্তি) 

১৩
অবশ্য পঁতেভিঁ একটা ঘটনা জানেন না। যদি জানতেন, তাহলে বার্কের প্রতি তিনি এতটা রূঢ় হতেন না। বার্কের একজন সহপাঠিনী ছিল। একই স্কুলে পড়ত। তার নাম তিনি দিয়েছিলেন ইমাকুলাতা। তাকে পছন্দ করতেন বার্ক। এই নারী বেশ যন্ত্রণা দিয়েছে বার্ককে।
বিশ বছর পরে একদিন ইমাকুলাতা টেলিভিশনের পর্দায় দেখল বার্ককে। দেখল বার্ক একজন কালো ছোট বালিকার মুখ থেকে মাছি তাড়াচ্ছেন। এই দৃশ্য আলো জ্বালাল ইমাকুলাতার হৃদয়ে। সঙ্গে সঙ্গে তার উপলব্ধি হলো যে বার্ককে সে চিরটাকাল ভালোবেসে এসেছে। ওই দিনই সে একটা চিঠি লিখল বার্ককে, বহু আগের নিষ্পাপ প্রেমের কথা সে স্মরণ করল। কিন্তু বার্কের মনে আছে, তাঁদের প্রেম মোটেও নিষ্পাপ ছিল না। তাঁর প্রেমে ছিল কামনার আগুন। কিন্তু মেয়েটি তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল। এই কারণে বার্ক তাঁদের পর্তুগিজ মা-বাবার গৃহপরিচারিকার নামে এই মেয়ের নাম রেখেছিলেন ইমাকুলাতা, যার মানে হচ্ছে দাগবিহীন। এই চিঠি বার্কের মনে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল মারাত্মক। কিন্তু তিনি চিঠির জবাব দিলেন না।
তাঁর নীরবতা মহিলাকে ব্যথিত করে তুলল। পরের চিঠিতে সে বার্ককে স্মরণ করিয়ে দিল কত কত প্রেমপত্র বার্ক লিখেছিলেন এই মেয়েটিকে। স্মরণ করিয়ে দিল, বার্ক তার নাম দিয়েছিলেন ‘স্বপ্নসংহারী রাতের পাখি’। এই রকম আহাম্মকের মতো কথা লিখেছিলাম নাকি, বার্ক ভাবলেন। এই মেয়েকে তো নিবৃত্ত করা দরকার।
তাঁর মনে হলো, এই মেয়ে কেন এটা তাঁকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, এ তো সৌজন্যের পরিচায়ক নয়। পরে তাঁর কানে যেসব জনশ্রুতি এসে পৌঁছাচ্ছিল, তা থেকে তিনি জানতে পারেন, যতবার এই মহিলা তাঁকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছে, ততবারই নৈশভোজের সময় অনেক বেশি কথা বলেছে। সে কথা বলেছে বার্ক সম্পর্কে, যিনি কিনা এই মেয়েটির জীবনে দাগ লাগাতে পারেননি, অথচ মেয়েটিকে ভেবে তাঁর রাতের ঘুম দুঃস্বপ্নে নষ্ট হয়েছে। বার্কের মনে হলো, তিনি উদোম হয়ে পড়েছেন, তাঁর কোনো রক্ষাকবচ নেই। এই প্রথম তিনি তাঁর জীবনে অনুভব করলেন যে খুব ভালো হতো, যদি তাঁর কোনো নাম-পরিচয়ই না থাকত!

তৃতীয় চিঠিতে ভদ্রমহিলা একটা সাহায্য চাইল, তার নিজের জন্য নয়, তার কোনো এক পড়শিনীর জন্য। তাঁর এক গরিব অসহায় পড়শিনী হাসপাতালে যথাযথ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছিল, এমনকি মরতে বসেছিল, তাকে চেতনানাশক দেওয়ার সময় ডাক্তাররা ভুল করেছিল। এখন পড়শিনীটি কোনো ক্ষতিপূরণও পাচ্ছে না। বার্ক কি একবার এই মহিলার কাছে যেতে পারেন? তিনি তো আফ্রিকার শিশুদের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। এখন একজন ফরাসি দুস্থ নারীর কাছে কি তিনি যেতে পারেন না? অবশ্য এখানে কোনো টেলিভিশন ক্যামেরা থাকবে না।

এই গরিব মহিলা শেষে নিজেই চিঠি লেখে। চিঠিতে সে ইমাকুলাতার কথা রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করে। বলে, এই হচ্ছে সেই দাগবিহীন কুমারী বালিকা, যে কিনা আপনার ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন হয়ে জ্বালাতন করত। এও কি সম্ভব? এ কি সম্ভব? নিজের ফ্ল্যাটে বার্ক এক মাথা থেকে আরেক মাথা পায়চারি করেন। তারপর চিঠিটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে কুটি কুটি করেন। তিনি চিৎকার করেন, রাগে ফেটে পড়েন। চিঠির টুকরোগুলোয় থুতু ছোড়েন। সেগুলোকে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দেন।

একদিন এক টেলিভিশন চ্যানেলের প্রধানের কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন এক প্রযোজিকা তাঁর জীবনকাহিনি নির্মাণ করতে চায়। বার্ক খুবই মুশকিলে পড়েন। কারণ, তিনি নিজে টেলিভিশনে আবির্ভূত হতে চান। নিজের জীবনকে শিল্পে উন্নীত করতে চান। কিন্তু টেলিভিশনের প্রযোজিকা আর কেউ নয়, ইমাকুলাতা নিজে। এখন তিনি কী করবেন? ঘটনা তো একটা কমেডিতে পরিণত হলো। তিনি তখন টেলিভিশনের প্রধানকে বললেন, না, না, আমার তো বয়স কম, এই ধরনের একটা অনুষ্ঠানে যাওয়ার বয়স আমার হয়নি। টেলিভিশন প্রধান বার্কের বিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন।
(চলবে)