ধীরে চলা

(বারো কিস্তি)
১২
ভিভাঁ দেনোঁর জীবদ্দশায় হয়তো খুব অল্প কজন বন্ধু জানতেন যে তিনি ‘পয়েন্ট দে লেদেঁরমেঁ’-র রচয়িতা। তাঁর মৃত্যুর পর অনেক দিন পর্যন্ত কথাটা গোপনই ছিল। ফলে এই বইটির নিজের ইতিহাস এ বইয়ে বলা কাহিনির সঙ্গে মিলে যায়। ছায়ান্ধকার ঘোমটার আড়ালে ছিল এটা। গোপনীয়তা, বিচ্ছিন্নতা, রহস্যমেদুরতা, নামহীনতার উপচ্ছায়া ঘিরে ছিলে এই বইটাকে।

দেনোঁ ছিলেন খোদাইকারী, নকশাকারী, কূটনীতিবিদ, পর্যটক, শিল্পের সমঝদার, গুনিন, একটা চমৎকার পেশাগত জীবনের অধিকারী। কিন্তু তিনি কোনো দিনও এই উপন্যাসিকাটির শৈল্পিক পিতৃত্ব দাবি করেননি। এমন না যে তিনি খ্যাতিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সময়ে খ্যাতির অন্যতর মানে ছিল। আমি কল্পনা করতে পারি, তিনি যে পাঠকদের গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন, যাদের মনে করতেন চমৎকার, তারা আজকের লেখকদের ঈপ্সিত অজানা পাঠকবর্গ নয়, বরং যে অল্প কজন মানুষকে তিনি নিজে চিনতেন জানতেন শ্রদ্ধা করতেন, তারা। একটা সেলুনে কয়েকজন মানুষের সামনে নিজেকে উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তিনি কয়েকজন মাত্র পাঠককে নিয়ে সেই একই রকম আনন্দই পেতেন।

আলোকচিত্র আবিষ্কৃত হওয়ার আগের খ্যাতি আর পরের খ্যাতি এক নয়। চেক রাজা ওয়েনসেসলস চতুর্দশ শতাব্দীতে প্রাগে ছদ্মবেশে সাধারণ প্রজাদের সঙ্গে গল্প করতেন। তাঁর ছিল ক্ষমতা, খ্যাতি, স্বাধীনতা। কিন্তু ইংল্যান্ডের প্রিন্স চার্লসের কোনো ক্ষমতা নেই, কোনো স্বাধীনতা নেই। কিন্তু আছে অপরিসীম খ্যাতি। কোনো মনুষ্যশূন্য অরণ্যে কিংবা মাটির সতেরোতলা নিচের কোনো বাথটাবে তিনি নিজেকে লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে রাখতে পারবেন না। খ্যাতি তাঁর স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। এখন তিনি জানেন, সম্পূর্ণ অসচেতন জনতা সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় সেলিব্রেটিদের প্রতিটা খুঁটিনাটি বিষয় অনুসরণ করাটাকে অনুমোদন করে।

আপনি বলতে পারেন, যদিও খ্যাতির ধরন বদলে গেছে, তবুও এটা শুধু কতিপয় সুবিধাভোগী মানুষেরই চিন্তার বিষয়। আপনি ভুল করছেন। খ্যাতি কেবল একজন বিখ্যাত মানুষের বিষয় নয়, এটা আপনার আমার প্রত্যেকের বিষয়। আজকালকার দুনিয়ায় খ্যাতিমানেরা আছেন টেলিভিশনে, আছেন পত্রপত্রিকায়। তাঁরা আমাদের কল্পনাকে দখল করে নেন। প্রত্যকে চায়, স্বপ্ন দেখে তাদের মতো বিখ্যাত হওয়ার। প্রত্যেকে এই সম্ভাবনা বিবেচনা করে দেখে। (অবশ্য চেক রাজা চেক রাজা ওয়েনসেসলসের খ্যাতি নয়, যিনি গরিব মহল্লায় ঢুকে গরিবের সঙ্গে কথা বলছেন, মানুষ চায় প্রিন্স চার্লস হতে, যিনি কিনা সতেরোতলা মাটির নিচের বাথটাবে লুকিয়ে থাকবেন)। এ সম্ভাবনা প্রতিটি মানুষের ওপরে ছায়াপাত করে, তাদের জীবনাচার বদলে দেয়। এটা অস্তিত্ববাদী গণিতের আরেকটা সুপরিচিত উপপাদ্য। অস্তিত্ব যখনই কোনো নতুন সম্ভাবনা অর্জন করে, তা অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রতিটা জিনিসকে বদলে দেয়।
(চলবে)

আরও পড়ুন: