জীবনব্যাপী জ্ঞানসাধনায় নিবেদিত

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর (৯ জানুয়ারি ১৯৩৬—২৩ মার্চ ২০২০)
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর (৯ জানুয়ারি ১৯৩৬—২৩ মার্চ ২০২০)
>কবি, কথাশিল্পী ও শিল্পসমালোচক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর মারা গেছেন ২৩ মার্চ। পঞ্চাশ দশকের এই উজ্জ্বল কবির প্রতি শ্রদ্ধা

৮৪ বছর বয়স অতিক্রম করে জীবন থেকে বিদায় নিলেন বাংলাদেশের মননচর্চার জগতের এক অবিসংবাদিত ব্যক্তিত্ব বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর (১৯৩৬–২০২০)। চাঁদপুরের এক প্রতিভাবান পরিবারের সদস্য হিসেবে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় নিয়োজিত হয়েছিলেন, এটি তাঁর পরিচয়ের ক্ষুদ্র অংশমাত্র। যদি বলি, তিনি কবি ছিলেন, কথাশিল্পী ছিলেন, প্রাবন্ধিক ছিলেন, গবেষক ছিলেন, শিল্পসমালোচক ছিলেন, উচ্চমানের মননশীল পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন—তাহলেও কি তাঁকে পূর্ণতরভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব? কবিতা রচনার মাধ্যমে সাহিত্য পরিমণ্ডলে তাঁর অভিষেক হয়েছিল, এটা ঠিক। সেই কিশোর বয়সে, ১৯৫০ সালে, একটি জাতীয় কবিতা সংকলনে সর্বকনিষ্ঠ কবি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল তাঁর কবিতা; নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা এটি। ১৯৪৭-উত্তরকালে একটি নতুন দেশে প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্ব যখন তীব্র, তখন তিনি প্রগতির পথ বেছে নিয়েছিলেন, এটি আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি ছিলেন প্রগতি লেখক সংঘের সক্রিয় কর্মী ও নেতা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের বছরটিতে তিনি কলেজপাঠ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছিলেন। সাহিত্যচর্চার মধ্যেও পাঠের বিষয় হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান। এ তো পরিস্থিতিরই দাবি। অতঃপর সাহিত্যচর্চা যেমন ছিল তাঁর আমৃত্যু সাধনার বিষয়, তেমনি প্রগতির ধারায় রাজনীতিসচেতনতাও। 

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এ দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে এবং সৃজনশীলতা ও মননশীলতার ক্ষেত্রে যে নবজাগরণ ঘটিয়েছিল, তিনি ছিলেন তারই এক উজ্জ্বল প্রতিনিধি। রাজনীতি-বিজ্ঞানের ছাত্র-অধ্যাপক-গবেষক হয়েও তিনি সাহিত্যচর্চা থেকে এক মুহূর্তও বিরত থাকেননি। শুধু তা–ই নয়, বিস্তৃত করেছেন দৃষ্টি ও সৃষ্টির পরিধি। সৃজনশীলতা থেকে মননশীলতায় তাঁর পরিভ্রমণের মধ্যেই পঞ্চাশের দশকেই যুক্ত হয়েছেন শিল্পসমালোচনায়। আমাদের প্রথম প্রজন্মের চিত্রশিল্পীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব, তাঁদের বিদেশ শিক্ষা সূত্রে বিশ্ব শিল্পের আধুনিকতা সম্পর্কে জ্ঞানলাভ প্রভৃতি তাঁকে শিল্পসমালোচনার ক্ষেত্রে প্রাগ্রসরতায় প্রদীপ্ত রেখেছে। এ ক্ষেত্রে পালন করেছেন পথিকৃতের ভূমিকা। তিনি এ দেশের প্রধান প্রধান শিল্পীদের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে লিখেছেন তা চিত্রশিল্প: বাংলাদেশের গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। এ ছাড়া জয়নুল, কামরুল, সুলতান আর শাহাবুদ্দিনকে নিয়ে রচনা করেছেন পৃথক পৃথক গ্রন্থ; কারও কারও ক্ষেত্রে একাধিক। এই শিল্পীদের বিশ্লেষণে তিনি অনেক মৌলিক কথা বলেছেন, নতুন পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। শিল্পের বিশ্বমানের পটভূমিতে এবং জাতীয় আবেষ্টনে তাঁদের আধুনিকতার বৈশিষ্ট্যসকল চিহ্নিত করেছেন। 

শিল্পসমালোচনার পাশাপাশি তিনি ব্যাপৃত থেকেছেন সাহিত্য-সমালোচনায়। তিনি বাংলা সাহিত্যের তিন প্রধান লেখক—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়—এঁদের প্রত্যেককে নিয়ে স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন। আগেই বলেছি, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিটি আধুনিকতা ও প্রগতির উদারচিন্তায় ঋদ্ধ ও মানবিক। রেনেসাঁ-উদ্ভূত আধুনিকতার বৈশিষ্ট্যসকল তিনি লক্ষ করেছেন মাইকেলের সৃষ্টিতে। তাঁর রচনায় দেখেছেন বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার প্রথম রূপ ও স্বরূপ। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে লক্ষ করেছেন আরও পরবর্তীকালের অর্থাৎ উনিশ ও বিশ শতকীয় আধুনিকতার বীজমন্ত্র। তাঁর মূল্যায়নে লক্ষণীয়, সমকালীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনবোধের সব ধারাকে আত্মস্থ করেই সমৃদ্ধ হয়েছে রাবীন্দ্রিক আধুনিকতার চেতনা। আর মানিক, যিনি ধারণ করেছেন বিশ শতকীয় আধুনিকতার দুই প্রবল ধারা—ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণ আর মার্ক্সীয় সমাজতাত্ত্বিক বীক্ষণকে। ফলে তাঁর জীবনবোধের সবচেয়ে নিকটাত্মীয় মানিকের সাহিত্যকে সামগ্রিক দৃষ্টিতে বিচার-বিশ্লেষণে সক্ষম হয়েছেন তিনি। 

এসব মননশীল চর্চার পাশাপাশি কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস রচনা যেমন অব্যাহত গতিতে অগ্রসর হয়েছে, তেমনি অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রে গবেষণা-জ্ঞানচর্চাও কখনো বাধাপ্রাপ্ত হয়নি। তিনি ছিলেন মূলত রেনেসাঁ-পরিস্রুত এক আধুনিক মানুষ; সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বিশ শতকীয় প্রগতিচিন্তা, ধনতন্ত্রের প্রতি বিরূপতা আর নিম্নবর্গের প্রতি মানবিক দৃষ্টি। রেনেসাঁ-মানব হিসেবে তিনি সেক্যুলারিজমের পাশাপাশি আস্থাশীল ছিলেন ওই আদর্শে যে, ‘জ্ঞানই শক্তি’। অতঃপর সমগ্র জীবনকেই নিবেদন করেছিলেন জ্ঞানচর্চায়। তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের সংকট। দীর্ঘদিন ধরে তিনি সম্পাদনা করেছেন সমাজ নিরীক্ষণ নামে একটি উন্নতমানের পত্রিকা। তাঁর এই জ্ঞানানুশীলনে ছিল সততা ও আন্তরিকতার সংশ্লেষ; তাতে ছিল না কোনো পদমোহ কিংবা জাগতিক উন্নতিসাধনের আকাঙ্ক্ষা। তবু একবার সরকার তাঁকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য নিযুক্ত করলে তিনি ওই পদে অধিষ্ঠিত হয়ে জ্ঞানচর্চার পথকেই প্রশস্ত করে তোলেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজ-শিক্ষকদের জন্য তিনি এমন উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন, যা হয়ে আছে দৃষ্টান্তস্থানীয়। 

জীবনব্যাপী জ্ঞানসাধনায় আত্মনিবেদনের মধ্যেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন আনন্দ। এই আনন্দই তাঁর পাঠের পরিধিকে করেছে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন সমসাময়িকদের তুলনায় বেশ অগ্রসর। সর্বদাই সমকালীন বা সর্বশেষ জাতীয় ও বৈশ্বিক চিন্তাধারার সঙ্গে নিজ চেতনাকে হালনাগাদ রাখতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। ফলে আধুনিকতা ও উত্তর-আধুনিকতার সব অনুষঙ্গের সঙ্গে ঘটেছিল তাঁর নিবিড় আত্মীয়তা। এই যে প্রতিনিয়ত নিজেকে বিশ্বের নতুন চিন্তা আর বোধের সঙ্গে সমান্তরাল রাখার প্রয়াস, এখানেই তাঁর সবচেয়ে বিশিষ্টতা, সবচেয়ে স্বতন্ত্রতা। বাংলাদেশের মতো জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে প্রকট দীনতার এই দেশে তাঁর মতো একজন নিষ্ঠাবান নিরবচ্ছিন্ন সাহিত্যিক ও জ্ঞানসাধককে হারানোর ক্ষতি যে কত অপূরণীয় তা বলাই বাহুল্য।