তাঁর জীবনদর্শন ও সাহিত্যবৈশিষ্ট্য

আশরাফ সিদ্দিকী (১ মার্চ ১৯২৭—১৯ মার্চ ২০২০)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম, ২০১২
আশরাফ সিদ্দিকী (১ মার্চ ১৯২৭—১৯ মার্চ ২০২০)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম, ২০১২
>সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন কবি ও লোকসংস্কৃতিবিদ আশরাফ সিদ্দিকী। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা

আশরাফ সিদ্দিকী কবি, কথাশিল্পী ও লোকসাহিত্যবিদ। তাঁর সাহিত্যজীবনের পরিসর তিনটি কালপর্বের পটভূমিতে গুরুত্ববহ ও আলোচিত—এক. সাতচল্লিশ-পূর্ব চল্লিশের দশকের সাম্যবাদী কাব্য আন্দোলনের কালে, দুই. দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তানি শাসনামলে, তিন. ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে।

কালপর্ব যা–ই হোক না কেন, শ্যামল বাংলার ঋতুবৈচিত্র্যের প্রকৃতি এবং বাংলার ঐতিহ্য আশরাফ সিদ্দিকীর সাহিত্য সৃষ্টিতে উৎসাহ ও প্রেরণা জোগায়। আর মানুষ তাঁর সাহিত্যের কেন্দ্রে নানা সময়ে নানাভাবে উঠে এসেছে। তবে তাঁর মানুষও সহানুভূতি পেয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে, মানবিক দায়বোধে, লোক–ঐতিহ্য ও বাংলার প্রকৃতির তাৎপর্যপূর্ণতায়।

কবিতা লেখার মাধ্যমেই তিনি মধ্যচল্লিশের দশকে সাহিত্যে আবির্ভূত হন। যদিও স্কুলজীবন থেকেই তাঁর কবিতা লেখা শুরু। ১৯৫০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ তালেব মাস্টার ও অন্যান্য কবিতা।

লোক–ঐতিহ্যপ্রীতির বৈশিষ্ট্য আশরাফ সিদ্দিকীর প্রতিটি কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস, গল্প ও লোকসাহিত্যের গবেষণার প্রতিটি কাজে পরিব্যাপ্ত। লোক–ঐতিহ্য তাঁর মানস গঠনে বাল্যকালেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রবীন্দ্রবলয় থেকে বেরিয়ে আসা ত্রিশের আধুনিকতা পেরিয়ে চল্লিশের দশকের যে সাম্যবাদী চেতনাসমৃদ্ধ কাব্যাঙ্গন—এখানে দাঁড়িয়েই কাব্যপ্রতিভাকে বাংলা সাহিত্যে মেলে ধরলেন তিনি । কিন্তু প্রথম কাব্যগ্রন্থেই তিনটি পর্ব বিন্যাসে তিন ধরনের বন্দনা উপস্থাপন করেছেন, যা আমাদের লোক–ঐতিহ্যের ধারাকে আধুনিক ফর্মে যুগোপযোগী করে তুলেছেন।

যেমন ‘স্বপ্ন’—এই পর্বের কবিতার শুরুতে বন্দনার নমুনা—‘মনে হয়: সে মেয়েরে কোথা যেন দেখিয়াছি/ ডালিমকুমারী নাম তার/ ...হয়তো অকস্মাৎ স্বপ্নের মতন/ সে মেয়েরে পেতে পারি ডালিমকুমারী মেয়ে: কথা কয়’। এইভাবে ‘সংগীত’ ও ‘সংগ্রাম’ পর্বেও বন্দনা রয়েছে।

আশরাফ সিদ্দিকীর এই যে কবিতায় পরিভ্রমণ, পরিভ্রমণের আশ্রয় বাংলার লোক–ঐতিহ্যের বিস্তারে। আশরাফ সিদ্দিকীর জীবনদর্শন ও সাহিত্যবৈশিষ্ট্য উপলব্ধির ক্ষেত্রে তাঁর একটি মন্তব্য উল্লেখযোগ্য, ‘প্রসঙ্গত সম্ভবত বলা অশোভন হবে না। কবির সৃষ্টিই তার জীবন–ইতিহাস, জীবন-বেদ, মানস-দর্পণ, সমাজ-দর্পণ । যে পরিবেশে আমার বাল্যজীবন কেটেছে তা’ হ’ল উচ্ছল নদী মেখলা চিরন্তনী লোকায়ত বাংলা, বিভিন্ন রসের লোকগীতি, কথা, যাত্রা, কথকতা, জারী, সারী, পল্লী-মেলা, উৎসব-অনুষ্ঠান, হিন্দু মুসলমানের প্রেম-প্রীতি-পূর্ণ সহ–অবস্থান-এর লোকায়ত বাংলা।’ তালেব মাস্টার ও অন্যান্য কবিতা নামের কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও তাঁর রয়েছে সাত ভাই চম্পা, বিষকন্যা, উত্তর আকাশের তারা, কুচবরণের কন্যে প্রভৃতি। ‘তালেব মাস্টার’ তাঁর উল্লেখযোগ্য কবিতা । এই কবিতায় একটি পরিবারের অসহায়ত্বের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে এসেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, মন্বন্তর, স্বদেশি আন্দোলন থেকে শুরু করে মহাত্মার অনশনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। সমকালের কঠিন ও কঠোর বাস্তবতাকে তিনি এই কবিতায় চিত্রিত করে কালজয়ী হয়েছেন। কবিতার কয়েকটি পঙ্‌ক্তি উদ্বৃত করছি: ‘আমি সেই তালসোনাপুরের তালেব মাষ্টার/ .../ নিরীহ তালেব মাস্টারের বুকেও বজ্র পড়ল! কলেরায়/ ছেলেটি মারা গেল বিনা পথ্যে বিনা শুশ্রূষায়!/ .../ মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছিলাম পলাশতলী/ .../ দড়ি কলসী বেঁধে পুকুরের জলে ডুবে মরেছিল একদিন সন্ধ্যায়/ .../ আলো দিয়ে বেড়াই পথে পথে কিন্তু/ নিজের জীবনই অন্ধকারমালা।’

ত্রিশের আধুনিকতার বাইরে যেমন জসীমউদ্‌দীন একক, তেমনি চল্লিশের সাম্যবাদী কাব্যধারা স্পর্শ করেও একক ধারায় নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছেন তিনি। পঞ্চাশের দশকে নতুন কবিতা শিরোনামে যে কাব্যসংকলন প্রকাশিত হয়েছিল সেখানে রয়েছে তাঁর কৃতিত্ব। গ্রন্থটি সম্পাদনায় ছিলেন তিনি ও আবদুর রশীদ খান।

কবিতার পাশাপাশি ‘ছোটগল্প’ সৃষ্টিতেও তিনি তাঁর শিল্পীসত্তার অস্তিত্বকে রূঢ় বাস্তবতা ও গভীর জীবনবোধে প্রমাণ করতে পেরেছেন। তাঁর দুটি গল্পগ্রন্থের মধ্যে গলির ধারের ছেলেটি (১৯৮১) শিরোনামের গল্পগ্রন্থটি প্রথমে রাবেয়া আপা (১৯৫৫) নামে প্রকাশিত হয়। শেষ নালিশ প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। ‘গলির ধারের ছেলেটি’ গল্পের ডুমুরের ফুল নামে চলচ্চিত্রে রূপায়ণ করেন চিত্রপরিচালক সুভাষ দত্ত। গল্পটির অন্যতম বিশেষত্ব হচ্ছে, একটি অসহায় শারীরিক প্রতিবন্ধী কিশোরের হাসপাতালে আশ্রয়কে কেন্দ্র করে অসামান্য জীবনঘনিষ্ঠতা এবং লোক–ঐতিহ্যের জীবনবোধ। আশ্রয় বলতে কেবল বাঁচা নয়, নার্সের অকৃত্রিম আদর অন্যতম। উপন্যাসের ক্ষেত্রেও তিনি লোক–ঐতিহ্যকে উপস্থাপন করেছেন আধুনিকতার গঠনশৈলীতে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় গুণীন (১৯৮৯) উপন্যাসের কথা।

আশরাফ সিদ্দিকীর অন্যতম কীর্তি লোকসাহিত্যকে তাঁর গবেষণার বিষয় করা। লোকসাহিত্য নিয়ে তাঁর প্রচুর কাজ রয়েছে। তিনি ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন লোকসাহিত্য বিষয়ে। তিনি তাঁর লোকসাহিত্য গ্রন্থে লোকসাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়ের যেমন লোককথা, লোককাহিনি, ছড়া, লোকপুরাণ, গীতিকা, গীতি প্রভৃতির ব্যাপক ও তুলনামূলক পর্যালোচনা করেছেন। অবশ্য ফোকলোর বা লোকবিজ্ঞান বিষয়ে একটি তথ্যবহুল আলোচনা তিনি তাঁর লোকসাহিত্য গ্রন্থে করলেও বিশেষজ্ঞ হিসেবে কেবল লোকসাহিত্যকেই বেছে নেন। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত তাঁর সম্পাদনায় কিশোরগঞ্জের লোককাহিনী কিংবা কিংবদন্তির বাংলা মূলত লোকসাহিত্যেরই কাজের বহিঃপ্রকাশ।