বাড়িতে বসে কীভাবে লিখবেন

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে থেকে হারুকি মুরাকামি সবাই–ই নিয়ম মেনে লিখতে বলেছেন। ছবিটি প্রতীকী
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে থেকে হারুকি মুরাকামি সবাই–ই নিয়ম মেনে লিখতে বলেছেন। ছবিটি প্রতীকী
>করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে কোয়ারেন্টিনে আছেন বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা দেশের অজস্র মানুষ। স্বেচ্ছাবন্দিত্বে আছেন কবি-লেখকেরাও। এ প্রেক্ষাপটে লেখকেরা বাড়িতে বসে কীভাবে কাজ করতে পারেন, তা নিয়ে ১৮ মার্চ একটি লেখা ছেপেছে দ্য গার্ডিয়ান। ওই পত্রিকার প্রতিবেদক ব্রিগিড ডেলানির লেখাটি সংক্ষেপিত করে বাংলায় রূপান্তর করেছেন হুমায়ূন শফিক

করোনাভাইরাসের কারণে এ মুহূর্তে বাড়ি থেকে বের হওয়া নিরাপদ নয়। বাড়ি থেকে কাজের ব্যাপারে বিশেষ একটি দল পারদর্শী—তাঁরা লেখক। এই লেখককুলের মধ্য থেকে এমন কয়েকজন আছেন, লেখার ব্যাপারে যাঁদের ডেডলাইন দেওয়া থাকে। এ ডেডলাইন মেনে সময়কে কাজে লাগিয়ে তাঁরা লেখেন দারুণ সব গল্প, উপন্যাস, কবিতা বা প্রবন্ধ। ফলে এ সময় অনেকে নিজেই নিজের কাজটি শেষ করার জন্য স্বেচ্ছাবন্দিত্ব বেছে নেন। নিজের জন্য খাদ্য মজুত করে, অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়ে একটি নির্দিষ্ট রুটিনমাফিক কাজ করেন লেখকেরা।

আজকের করোনাকালের বাস্তবতায় সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে বাড়িতে বসে কবি-লেখকেরা কী কী করতে পারেন, তা নিয়ে কিছু পরামর্শ থাকল এখানে। বিভিন্ন সময়ে সে কালের আর্নেস্ট হেমিংওয়ে থেকে এ কালের হারুকি মুরাকামি পর্যন্ত লেখালেখির ক্ষেত্রে লেখকেরা যেসব নিয়ম মেনে চলেছেন, তার আলোকেই দেওয়া হয়েছে পরামর্শ।

 কঠিন কাজগুলো প্রথমেই করুন

মার্কিন কথাসাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে প্রতিদিন সকাল ছয়টায় লেখা শুরু করতেন। এবং চলতেন মাঝারি স্তরের একজন অ্যাকাউন্ট্যান্টের মতো রুটিন করে। প্যারিস রিভিউ-এ এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘যখন আমি কোনো বই বা গল্প নিয়ে কাজ শুরু করি, তখন কাজের শুরুটা হয় প্রতিদিন সকাল থেকেই। কেউ বিরক্ত করার নেই। ঠান্ডা পরিবেশ। নীরব। আপনি লেখাটাকে উপভোগ করতে পারবেন এই সময়টাতে।’

যদি বাড়িতে বসেই কাজ করা লাগে, তাহলে সবার আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটাই করা উচিত। আপনার উচিত হবে প্রেজেন্টেশন বা রিপোর্টগুলো যত দ্রুত সম্ভব, করে ফেলা। অনেক সময় ই–মেইল চেক করাও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তখন মেইলটা আগে চেক করে নেবেন, হয়তো সেখানেই আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কোনো কিছু অপেক্ষা করছে। হেমিংওয়ের মতো অবশ্যই সকাল সকাল কাজ শুরু করে দিতে হবে। না হলে সারা দিনে খুব অল্প সময়ই পাবেন কাজটা শেষ করার জন্য।

 রুটিন মেনে চলুন

একটি রুটিন তৈরি করে ফেলুন এবং সে অনুযায়ী কাজ করুন। লেখকদের উচিত সেনাবাহিনীর সৈনিকদের মতো সময়ানুবর্তী হয়ে সময়কে ব্যবহার করা। তাদের প্রতিদিন একই সময়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠার অভ্যাস করার পাশাপাশি প্রতিদিন কতগুলো শব্দ লিখবেন, তা ঠিক করে ফেলা উচিত। একটানা কত ঘণ্টা লিখবেন, নির্দিষ্ট করা উচিত সেটাও। এ ছাড়া সবকিছুই ঘড়ি দেখে দেখে করা দরকার। এমনকি কারও সঙ্গে দেখা করা লাগলেও সেটাও যেন রুটিনে থাকে। ইংরেজ ঔপন্যাসিক হেনরি গ্রাহাম গ্রিন বলেছেন, ‘আমি যখন তরুণ ছিলাম, তখনো কোনো প্রেমের সম্পর্ক নিজের রুটিন থেকে আমাকে বিচ্যুত করতে পারেনি। যার সঙ্গে আমার প্রেমের সম্পর্ক ছিল, তার সঙ্গে দেখার করার সময় ছিল ঠিক দুপুরের খাবার খাওয়ার পর।’

আপনার পরিকল্পনা ঠিকমতো এগোচ্ছে কি না, সেদিকে আপনার মনোযোগ থাকা চাই। প্রতিদিন আপনি যদি দিনের বেলা লেখেন, তাহলে শুধু দিনেই লিখবেন। আবার যদি রাতের বেলা লিখতে চান, তবে শুধু রাতেই। কারণ, লেখার বাইরেও তো লেখকের প্রচুর কাজ থাকে। আপনাকে বিস্তর পড়তে হবে। ব্যায়াম করতে হবে। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করতে হবে। সব দিক বিবেচনা করেই কাজগুলো এগিয়ে নেবেন।

মার্কিন লেখক কার্ট ভনেগাট নিজের স্ত্রীকে (তাঁর রুটিন নিয়ে) একটি চিঠিতে লিখেছেন, ‘সকাল সাড়ে পাঁচটায় আমি ঘুম থেকে উঠি। একটানা আটটা পর্যন্ত কাজ করি। সকালের নাশতা খাই বাড়িতেই। তারপরে একটানা ১০টা পর্যন্ত কাজ। পরে শহরের ভেতরেই একটু হাঁটাহাঁটি করি। খবর দেখি। এরপর সুইমিং পুলে যাই সাঁতার কাটতে, এগুলো আমি নিজেই করি। এবং আধা ঘণ্টা সাঁতার কাটি। বাড়িতে ফিরি দুপুর পৌনে ১২টায়। মেইলগুলো পড়ি। দুপুরের খাবার খাই। বিকেলে স্কুলের বিভিন্ন কাজ করি, কিছু শেখাই বা নিজেই শিখি।’

 প্রতিদিন অবশ্যই ব্যায়াম করবেন

জাপানি ঔপন্যাসিক হারুকি মুরাকামি দৌড়বিষয়ক একটি বই লিখেছেন। দৌড় যে তাঁর জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ, এখানে সেটা বলেছেন তিনি। ২০০৪ সালের একটি সাক্ষাৎকারে এই লেখক বলেন, ‘যখন মনে হয় একটি উপন্যাসের প্লট মাথায় এসেছে, ভোর চারটায় ঘুম থেকে উঠে পড়ি এবং একটানা পাঁচ-ছয় ঘণ্টা কাজ করি। বিকেলে ১০ কিলোমিটার দৌড়াই অথবা দেড় হাজার মিটার সাঁতার কাটি (অনেক সময় দুটোই করি), এরপর পড়ি কিছুক্ষণ এবং গান শুনি। নয়টায় বিছানায় যাই। এই রুটিন অনুযায়ীই প্রতিদিন চলি। কোনো দিন এর হেরফের হয় না। পুনরাবৃত্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এটা একধরনের সম্মোহন। আমি নিজেই নিজেকে সম্মোহন করি, কারণ, আমি আমার মনের গভীরে চলে যেতে চাই।’

এমন যদি হয়, আপনি খুব ছোট একটি ফ্ল্যাটে থাকেন এবং ওই বাসায় থেকেই আপনাকে কাজ করতে হবে, তবে শরীর-মন ভালো রাখার জন্য অবশ্যই আপনাকে ব্যায়াম করতে হবে। অবরুদ্ধতার কালে, লকডাউনের সময়ে দারুণ একটা খবর জেনে রাখুন, উহানের এক ম্যারাথন দৌড়বিদ লকডাউনের সময় তাঁর ডাইনিং রুমেই ৩১ মাইল দৌড়েছেন।

 ইন্টারনেট আপনার শত্রু

ইন্টারনেট ছাড়া এখন একমুহূর্তও আমাদের চলে না। এই মহামারির দিনে ঘর থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু বন্ধু–আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ ঠিকই হচ্ছে। এমনকি বিদেশে যাঁরা আছেন, তাঁদের সঙ্গেও। হয়তোবা এখন আমি বারবার ফেসবুকে ঢুকে করোনার খবর নিচ্ছি। বা অনলাইনে কোনো নিউজ পোর্টালে ঢুকে দেখছি পৃথিবীর কী খবর!

কিন্তু আপনি যদি এ সময়টা কাজে লাগাতে পারেন, দারুণ কিছু করে ফেলতে পারবেন হয়তো। তবে ইন্টারনেট আপনাকে দারুণ কিছু করতে বাধা দেবে। যখন মাথায় একটা প্লট আসবে, দেখবেন মেসেঞ্জারে কোনো মেসেজ এসেছে। আপনি অবশ্যই ওই মেসেজটা সঙ্গে সঙ্গে দেখতে যাবেন এবং আপনার প্লটটা ওলট-পালট হয়ে যাবে।

ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক জ্যাডি স্মিথের কোনো স্মার্টফোন নেই। আমেরিকান লেখক জোনাথন ফ্রানজিন যে ঘরে বসে লেখেন, সেখানে কোনো ওয়াই-ফাই নেই। কম্পিউটারের সঙ্গে নেই কোনো ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবস্থাও। ওম্যান অব দ্য আওয়ার পোডকাস্টকে স্মিথ বলেন, ‘আমি যদি অনলাইনে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম, যদি সাড়ে চার ঘণ্টা গুগলে না ঢুকে থাকতে পারতাম, তাহলে কোনো সমস্যাই হতো না। কিন্তু আমি ঠিক করেছি, আমি শুধু লিখবই। আমাকে লেখাটা শেষ করতে হবে। অন্য সবকিছু পেছনে রেখে আমাকে লিখে যেতে হবে।’