ভাইরাস ও লালন ফকিরের গল্প

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা লালনের ছবি।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা লালনের ছবি।

‘বল স্বরূপ কোথায় আমার সাধের প্যারী
যার জন্য হয়েছিরে দণ্ডধারী...’
—লালন ফকির

রূপ আর স্বরূপের যে ব্যঞ্জনা বাউল সমাজে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে তা বুঝে ওঠা কঠিনই। রূপ-স্বরূপের খেলাটা চলে আত্মা আর পরমাত্মার মধ্যে। আত্মা পবিত্র, অবিনশ্বর—পৃথিবীর কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করে না বলেই জনশ্রুতি। আর আমাদের মতো অবোধ ‘জীবাত্মা’র পাপ পঙ্কিল রোগ ঘিনঘিনে শরীর পরমাত্মার নয়—বলা বাহুল্য। সে কারণেই অদৃশ্য ভাইরাস যুগে যুগে জীবাত্মাতেই তার স্বরূপের প্রকাশ ঘটিয়েছে, আত্মা বা পরমাত্মার নাগালও পায়নি। পৃথিবীর মানুষ নামের অবোধ জীবাত্মারা এখন করোনাভাইরাস নামের এক অদৃশ্য অণুজীবের স্বরূপ দেখছে।

মহাত্মা লালন ফকিরও তেমনি একটি ভাইরাসের ভয়ংকর স্বরূপ দেখেছিলেন নিজের শরীরে এবং সারা জীবন সে সংক্রমণের স্মৃতি বয়ে বেড়িয়েছেন। একটু অন্যভাবে বলা যায়, আপাত-অদৃশ্য ভাইরাসের কারণে জন্ম হয়েছিল বাউলকুলশিরোমণি লালন ফকিরের। সে বিষয়ে বিস্তারিত বলার আগে বলে রাখা ভালো, লালন ফকিরের জীবনী নিয়ে গবেষকেরা একমত হতে পারেননি। গবেষকদের এসব মতানৈক্য কিংবা চাপান-উতোর আমাদের আগ্রহের বিষয় নয়। তবে বিভিন্নজনের লেখা লালন জীবনীতে, তাঁকে নিয়ে অভিনীত যাত্রাপালায়, আখ্যানে, চলচ্চিত্রে লালন ফকিরের বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে সঙ্গীদের কাছ থেকে পরিত্যক্ত হওয়ার ঘটনা পাওয়া যায়। উল্লেখ করে রাখি, বসন্ত রোগ দুই ধরনের এবং দুটিই ভাইরাসঘটিত রোগ। একটির নাম গুটিবসন্ত, যাকে আমরা চিনি স্মলপক্স নামে, অন্যটির নাম জলবসন্ত, যাকে সবাই চেনে চিকেন পক্স নামে। জলবসন্তের ভাইরাসের নাম ভ্যারিসেলা জুস্টার ভাইরাস।

কয়েক শ বছর ধরে গুটিবসন্ত ছিল পুরো পৃথিবীর মানুষের কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। কলেরায় যেমন গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে গেছে একসময়, গুটিবসন্তও তাই করেছে, স্রেফ গায়েব করে ফেলেছে জনপদের পর জনপদ। বহু শতাব্দী আগের তথ্যের প্রয়োজন নেই। গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে, ১৯৫৭-৫৯ এই তিন বছরে ১ লাখ ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষ গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ৮৬ হাজার মানুষ মারা যায়। আর পুরো পৃথিবীতে শুধু বিশ শতকেই এ রোগে মারা যায় আনুমানিক ৩০ কোটি মানুষ! তবে আশার কথা, ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশকে গুটিবসন্ত জীবাণুমুক্ত দেশ হিসেবে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়। কারণ, তত দিনে এর প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়ে গিয়েছিল পৃথিবীতে। গুটিবসন্ত থেকে যাঁরা বেঁচে গেছেন, তাঁরা সারা জীবন তার চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন নিজেদের শরীরে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অন্ধত্ব, পঙ্গুত্ব এবং পুরো শরীরে বিশেষ করে মুখে ছোট ছোট গর্তের মতো দাগ—‘বসন্ত খাটি’ বলে স্থানীয়ভাবে মানুষ যাকে জানে।

লালন ফকিরের জীবনের যে ‘টার্নিং পয়েন্ট’ তার মূলে আছে গুটিবসন্ত বা স্মল পক্স নামের ভয়ংকর রোগটি। এ রোগের কারণ ভেরিওলা মেজর নামের ভাইরাসের সংক্রমণ। লালনের জন্মসাল নিয়ে মতভেদ থাকলেও তিনি যে গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তা সবাই স্বীকার করেছেন। তবে এই মহাত্মা ঠিক কবে, কোন বয়সে, কত সালে গুটিবসন্তের কবলে পড়েছিলেন, সেটি সঠিকভাবে উল্লেখ করা দুরূহ। এ বিষয়ে তাঁর জীবনীকারদের মধ্যেই মতদ্বৈততা বিদ্যমান। লালন জীবনীকার বসন্তকুমার পাল লিখেছেন, ‘ইনি নাকি তীর্থ গমন কালে পথে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হইয়া সঙ্গীগণ কর্ত্তৃক পরিত্যক্ত হয়েন। ...ইঁহার মুখে বসন্ত রোগের দাগ বিদ্যমান ছিল।’ প্রকৃতির কী দারুণ লীলাখেলা! গুটিবসন্তে আক্রান্ত লালন ফকিরের প্রথম জীবনীকারের নাম শ্রী বসন্তকুমার পাল। এবার লালনের সেই গল্পটি বলা যাক।

সময়টা আঠারো শতকের শেষ বা উনিশ শতকের প্রারাম্ভ। ‘সাঁইজি’ হয়ে ওঠার আগে একবার তীর্থযাত্রা করেছিলেন লালন। এই তীর্থযাত্রা শেষ করে ফেরার পথে তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। ক্রমে রোগের প্রকোপ এতটাই বৃদ্ধি পায় যে তাঁর সঙ্গীরা তাঁকে মৃত মনে করে পথে ফেলে যান; কেউ বলেন, নদীতে ভাসিয়ে দেন। যা হোক, তিনি পরিত্যক্ত হন সঙ্গীদের কাছ থেকে। কিন্তু প্রকৃতির অপার অনুগ্রহে লালন মরলেন না। তিনি অচেতন অবস্থায় পথের পাশে পড়ে থাকেন কিংবা ভাসতে ভাসতে নদীর তীরে চলে আসেন। ‘শ্রান্ত দিবাকর অস্তাচল গমনোন্মুখ’, এ সময় দৃশ্যপটে প্রবেশ করেন এক নারী। তিনি ছিলেন মুসলমান এবং তাঁতি পরিবারের মানুষ। এই নারী রোগাক্রান্ত লালনকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে সেবাশুশ্রূষা করে সুস্থ করে তুললেন। রোগ থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে লালন ফিরে গেলেন নিজ গ্রামে। কিন্তু যে মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তাকে সমাজে গ্রহণ করা যায় না। ‘সমাজের চাপে’ ভীষণ অভিমানে বাড়ি ছাড়েন লালন। চলে যান সিরাজ সাঁইয়ের কাছে। দীক্ষিত হন বাউলমতে। তারপর লালন হয়ে ওঠেন ‘লালন ফকির’, কারও কাছে সাঁইজি।

এরপরের ইতিহাসে লালন ফকিরের ছেঁউড়িয়া ফিরে আসা, বাউলদর্শনের চর্চা, সংগীত সৃষ্টি, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হওয়া না হওয়ার বিতর্ক (ইত্যাদি) এসব রয়েছে। এগুলো বহুশ্রুত বলে এখানে উল্লেখ করলাম না।

ভেরিওলা মেজর ভাইরাসের সংক্রমণে গুটিবসন্ত বা স্মল পক্সে আক্রান্ত না হলে সঙ্গীদের কাছ থেকে পরিত্যক্ত হওয়া, পথে বা নদীতে তাঁকে ফেলে যাওয়া, নদীর তীরে বা পথের ধারে তাঁকে খুঁজে পাওয়া, সেবাশুশ্রূষা করে তাঁকে সুস্থ করে তোলা, সুস্থ হয়ে গ্রামে ফিরে যাওয়া এবং সমাজ কর্তৃক পরিত্যাজ্য হওয়া, তারপর সিরাজ সাঁইয়ের দরবারে উপস্থিত হওয়ার মতো ঘটনাগুলো হয়তো ঘটত না। প্রায় তিন শ বছর পর করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে শুরু হওয়া এক মহামারির কালে বসে পুরো ঘটনা খেয়াল করলে সে রকমই মনে হয়। গুটিবসন্তে আক্রান্ত না হলে লালন কী হতেন, সে প্রশ্ন অবান্তর। ভাইরাস সংক্রমণের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে লালন কী হয়েছেন, সেটাই বরং গুরুত্বপূর্ণ।

লালন ফকিরের সমকালে, ১৭৬৭ সালে, ইউরোপে আর এক মনীষী মোৎসার্ট তাঁর এগারো বছর বয়সে আক্রান্ত হয়েছিলেন গুটিবসন্তে! এ দুই ঘটনার কোনো মহাজাগতিক সংযোগ ছিল কি না, আমাদের জানা নেই। তবে এত দিনে আমাদের এটা জানা হয়ে গেছে, করোনাভাইরাস, ইবোলা কিংবা বেরিজের মতো ভয়ংকর ভাইরাসদের রাজত্ব চললেও ভেরিওলা মেজর লালনদর্শনের পর পৃথিবী থেকে অফিশিয়ালি বিদায় নিয়েছে। তাই লকডাউনময় পৃথিবীতে অদৃশ্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের যুদ্ধে আশায় বুক বাঁধতেই পারি আমরা।

সূত্র: আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত শ্রী বসন্তকুমার পালের ‘মহাত্মা লালন ফকির’ এবং গুটিবসন্তের বিভিন্ন তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে ‘বাংলাপিডিয়া’ থেকে।