'এই পৃথিবী আর আগের মতো রইবে না'

প্রিয় বিশ্ব

যেহেতু আমি ইতালিতে বসে এই চিঠিখানা লিখছি, সেহেতু এই কথাগুলোকে তোমরা অনেকটা ভবিষ‍্যদ্বাণী হিসেবে গ্রহণ করতে পারো। আজ আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে তোমাদের আগমন এখন কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই মহামারির নির্মম লেখচিত্রে আমরা সবাই এখন একই পথের সারথি।

ঠিক যেভাবে এই দৌড়ে উহান শহর আমাদের থেকে কয়েক সপ্তাহ এগিয়ে ছিল, সেভাবে আমরাও তোমাদের থেকে এগিয়ে আছি। তোমরা এখন যা করছ, আমরাও ঠিক সেই কাজগুলো করে এসেছি। তোমাদের মাঝে একদল এই দুর্যোগকে ‘হালকা-সর্দি-কাশি’ বলে উড়িয়ে দিতে চাইবে; অন‍্যদল বুঝতে পারবে মহামারির আসল গভীরতা। এই দুই দলের মধ‍্যবর্তী হাস্যকর ঝগড়া-বিবাদও আমরা দেখে এসেছি।

যেহেতু আমি তোমাদের ভবিষ্যতে বসে আছি, সেহেতু আমি হলফ করে বলতে পারব, তোমাদের সঙ্গে কী হতে যাচ্ছে। অনেক জায়গায় হয়তো ইতিমধ্যেই লকডাউন শুরু হয়ে গেছে। এই ব‍্যাপারটাকে সামাজিক বৈষম্য বলে গালি-গালাজ করে তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো জর্জ ওরয়েল, এমনকি টমাস হবসের মতো লেখকদের উক্তি আওড়ানো শুরু করবে। কিন্তু খুব শিগগির তোমরা বুঝতে পারবে এই লকডাউনের কোনো বিকল্প নেই।

প্রথমত, যে কয়েকটা কাজ লকডাউনের মাঝে তুমি ঠিক আগের মতো করার স্বাধীনতা পাবে, তার মাঝে অন্যতম হলো খাওয়া। তাই তুমি কারণে-অকারণে খাবার নিয়ে বসবে।

তোমার বন্ধুরা তোমাকে হাজারটা ফেসবুক গ্রুপে অ‍্যাড করে প্রোডাকটিভিটির জ্ঞান ঝাড়া শুরু করবে। তুমি প্রথম দু-এক দিন সেগুলোয় চোখ বোলাবে। তারপর সেই পোস্টগুলোকে দেখামাত্রই দ্রুত স্ক্রল করে চলে যাবে।

বিজ্ঞজনের মতো বইয়ের তাক থেকে গুরুগম্ভীর হাজারটা গল্প-উপন্যাস বের করে আলিশানভাবে পড়তে বসবে। দু-এক পাতা পড়া মাত্রই তোমার সকল আগ্রহ-উত্তেজনা হারিয়ে যাবে। তুমি বুঝতে পারবে, কিছুই যেন আর ভালো লাগে না।

অগত্যা তুমি আবার খাবার নিয়ে বসবে। তোমার হয়তো ঠিকমতো ঘুম হবে না। নির্ঘুম চোখে তুমি হয়তো গণতন্ত্রের ভবিষ‍্যৎ নিয়ে কয়েক ঘণ্টা চিন্তা করবে।

মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, স্কাইপ, জুম মিলিয়ে তুমি একটা অবিরাম সামাজিক বন্ধনে জড়িয়ে যাবে। চেষ্টা করেও সেখান থেকে বের হতে পারবে না।

তুমি তোমার প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের অভাব অনুভব করতে শুরু করবে। ‘হয়তো আরেকবার তোমার তাদের সঙ্গে দেখা নাও হতে পারে’—এই চিন্তা তোমাকে রাতের পর রাত জাগিয়ে রাখবে।

পুরোনো ঝগড়া-বিবাদ সবই অর্থহীন হয়ে যাবে। জীবনেও যার চেহারা দেখবে না বলে পণ করেছিলে, ঠিক তাকেই অবশেষে মেসেজ পাঠিয়ে বসবে।

অনেক নারী গৃহনির্যাতনের শিকার হবেন।

যাদের কোনো ঘরবাড়ি নেই, তাদের কথা চিন্তা করে তোমার বেশ মন খারাপ হবে। রাতের বেলা (বিশেষ করে মেয়েদের) বাইরে যেতে ভয় করবে। প্রায়ই চিন্তা করবে, ‘এভাবেই কি সমাজের পতন ঘটে? ব‍্যাপারটা কি এতটাই সহজ?’ যখন এই বেদনার সঙ্গে আর যুদ্ধ করে টিকে থাকতে পারবে না, ঠিক তখন তুমি আবার খেতে বসবে।

তোমার ওজন বাড়বে। তুমি ইউটিউবে ব‍্যায়াম, ইয়োগার ভিডিও দেখা শুরু করবে।

তুমি হাসবে; অট্টহাসিতে ফেটে পড়বে। তোমার যত রস আছে, তাকে চিরতার মতো চিপে চিপে বের করতে চাইবে। এমনকি জগতের সবচেয়ে বাস্তববাদী মানুষটাও জীবন-জগতের অসাড়তার কথা আওড়াবে।

তুমি তোমার ভালোবাসার মানুষটিকে এক পলক দেখতে তার সঙ্গে পরিকল্পনা করে মুদি দোকানে বাজার করতে যাবে। দুই মিটার দূরত্বে দাঁড়িয়ে তোমার চোখজোড়া তার মুখশ্রীটাকে মনের ভেতর আরেকবার এঁকে নেবে।

বাসায় যে জিনিসগুলোর দরকার নেই, তুমি তার লিস্ট করতে বসবে।

বাসার অন‍্য মানুষগুলোর আসল স্বভাব-চরিত্র তুমি অবশেষে বুঝতে পারবে। এই লকডাউনের পর আর কাউকে চিনতে বাকি থাকবে না।

যে সুশীল সমাজ একসময় টেলিভিশনের টক শো কাঁপিয়ে বেড়াত, তারা সবাই আস্তে আস্তে হারিয়ে যাবে। তাদের কেউ কেউ এসে তোমার সামনে মায়া-মমতাহীন এক ভবিষ‍্যতের চিত্র আঁকার চেষ্টা করবে। একসময় তুমি বিরক্ত হয়ে তাদের কথা শোনা বন্ধ করে দেবে। অন‍্যদিকে, যাকে সারা জীবন পাত্তা দাওনি, তাকেই তোমার বিশ্বস্ত, সহনশীল এবং ভবিষ‍্যদ্দ্রষ্টা বন্ধু বলে মনে হবে।
.

কিছু পরিবেশবাদী এই সুযোগে ‘পৃথিবী কীভাবে এখন ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে’, তার ব‍্যাখ‍্যা দিয়ে এই দুর্যোগের এক বৃহত্তর স্বার্থের কথা শোনাবে: পৃথিবীর কার্বন নিঃসরণ এখন অর্ধেক হয়ে গেছে, প্রকৃতি এখন ভালোভাবে শ্বাস নিতে পারছে ইত‍্যাদি ইত‍্যাদি। ভালো কথা! কিন্তু আমার আগামী মাসের বাড়িভাড়াটা আসবে কোথা থেকে?

তোমার কাছে এই ‘নতুন সজীব পৃথিবী’র জন্মকে এক নির্মম অভিজ্ঞতা বলে মনে হবে।

তুমি গিটার হাতে গাইতে বসবে। আমরা যখন ইতালির বারান্দায় বসে প্রতিবেশীদের মন ভালো করতে গান গেয়েছি, তখন তোমাদের অনেকেই এটাকে ‘ইতালিয়ানা’ বলে হাসি-তামাশা করেছ। আগামী কয়েক সপ্তাহে সেই তোমরাই বারান্দায় বসে, ফেসবুকের লাইভে এসে গিটার হাতে সুরের মূর্ছনা তুলবে। আর আমরা তখন ইতালির ব‍্যালকনিতে বসে মাথা নেড়ে তোমাদের আচরণকে সায় দিয়ে যাব; ঠিক যেমনটা গত ফেব্রুয়ারি মাসে হুয়ান করেছে আমাদের দিকে তাকিয়ে।

তোমাদের অনেকই প্রতিরাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে নিজের কাছে মনে মনে পণ করবে, ‘লকডাউন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ডিভোর্স ফাইল করব।’

অনেক নবজাতকের জন্ম হবে।

বাচ্চারা অনলাইনে ক্লাস করতে শুরু করবে। তারা তোমার জীবনটাকে একটু অসহ্য করে তুলবে; আবার এরাই তোমাকে বাঁচতে শেখাবে।

বৃদ্ধরা কিশোরীসুলভ আচরণ করা শুরু করবে। তাদেরকে মোটামুটি যুদ্ধ করে ঘরে বসিয়ে রাখতে হবে।

আইসিইউর বিছানায় শুয়ে একা মৃত‍্যুপথযাত্রী মানুষটার কথা চিন্তা করে তোমার খারাপ লাগবে।

ডাক্তারদের হাঁটার রাস্তাটার ওপর গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে দিয়ে আসতে ইচ্ছে করবে।

জীবনে প্রথমবারের মতো সমাজের সবাই নিজ স্বার্থের বাইরে এসে কোনো উদ্দেশ‍্যে একসঙ্গে কাজ করা শুরু করবে। অনেকেই এর মাঝে জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পাবে।

সবশেষে, টাকা হয়ে দাঁড়াবে সবচেয়ে বড় ভাগ‍্যনির্ধারক। বড়লোকের বাড়ির বাগানের আয়েশি লকডাউন আর বস্তির ঝুপড়ি ঘরের ঠাসাঠাসি এক হবে না। বাসায় বসে কাজ করতে অসহ্য লাগবে; আর অসহ্য লাগবে চোখের সামনে নিজের চাকরিটা চলে যেতে দেখে। যে নৌকায় করে আমরা এই মহামারির দুর্যোগ পাড়ি দিচ্ছি, সেটা সবার জন‍্য এক হবে না; কখনো সেটা এক ছিলও না।

একসময় বুঝতে পারবে, তুমি আর এটা নিতে পারছ না। তুমি হয়তো কাছের মানুষের কাছে নিজের ভয়টা স্বীকার করে ফেলবে; অথবা হয়তো তাদের নিদারুণ যাতনার হাত থেকে বাঁচাতে নিজের ব্যথাটা লুকিয়ে রাখবে।

অতঃপর তুমি আবার খেতে বসবে।

ইতালিতে বসে আমরা তোমার এই ভবিষ্যৎই দেখতে পাচ্ছি। তবে এটা খুবই ছোট পরিসরের ভবিষ‍্যদ্বাণী। যদি আমরা একটু দূরের ভবিষ‍্যতের কথা বলতে চাই, সেটা তোমার-আমার দুজনের কাছেই অজানা। শুধু একটা কথাই হলফ করে বলতে পারি, ‘যখন এই সবকিছু শেষ হবে, এই পৃথিবী আর আগের মতো রইবে না।’

ইতি
ফ্রান্সেস্কা মেলান্দ্রি
ইতালীয় ঔপন্যাসিক

ভাষান্তর: শামীর মোন্তাজিদ।

লেখাটি দ‍্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় ৩০ মার্চ প্রকাশিত হয়েছে।