রঙিন 'পথের পাঁচালী' নিয়ে যত কাণ্ড

অনিকেত বোরার করা রঙিন অপু-দুর্গা
অনিকেত বোরার করা রঙিন অপু-দুর্গা
কিছুদিন আগের ঘটনা। সত্যজিৎ রায়ের সাদাকালো ‘পথের পাঁচালী’র কিছু অংশ রঙিন করে সেটি অন্তর্জালে ছেড়ে দিলেন অনিকেত বোরা নামের এক অধ্যাপক। তারপর ঘটল লঙ্কাকাণ্ড। খেপে গেলেন বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে থাকা সত্যজিৎভক্তরা। ফলে অনিকেতও বদলে ফেললেন তাঁর সুর। পড়ুন সেই কাহিনি।


খুব কম বাঙালি আছেন, যিনি সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ দেখেননি। অপু-দুর্গা-হরিহর-সর্বজয়াকে আমরা যেন সঙ্গে নিয়েই চলেছি। কেননা, আমাদের মানসপটে গেঁথে আছে ‘পথের পাঁচালী’ সিনেমার কিছু অসাধারণ দৃশ্য। এখনো চোখ বুজলেই দেখতে পাই দুর্গা আর অপু গ্রামের পথ ধরে দৌড়াচ্ছে। আর সাদা কাশফুলগুলো উড়ছে বাতাসে। দূরে শোনা যাচ্ছে ট্রেনের হুইসেল! ট্রেন আসছে...এমন অনন্য সব দৃশ্য। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের এই দৃশ্যাবলি চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তুলতে কম পরিশ্রম করেননি সত্যজিৎ রায়। তাঁর সেই কঠিন পরিশ্রমের ফসল ‘পথের পাঁচালী’। বলা যায়, চলচ্চিত্রনির্মাতা সত্যজিৎ রায় এবং ‘পথের পাঁচালী’ দুই সত্তারই বিচ্ছুরণ ঘটেছে পাশাপাশি, একই সময়ে।

সম্প্রতি সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত ‘পথের পাঁচালী’কে রঙিন করে তোলা নিয়ে গোটা দুনিয়ার সত্যজিৎভক্তদের মধ্যে প্রতিবাদের ঝড় বইছে। দিনকয়েক আগে অন্তর্জালে ‘পথের পাঁচালী’র রঙিন কিছু ক্লিপে দেখা গেল রঙিন দুর্গার মুখ, রঙিন অপু আর দুর্গাকে।

কিন্তু এ কোন দুর্গা? এই দুর্গাকে তো আমরা চিনি না! কে তিনি? কে ওই রঙিন অপু?

না, তাকেও ঠিক পরিচিত ঠেকল না। ফলে, ঘটনাটি নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। তাতে বেরিয়ে এল বিচিত্র এক তথ্য।

মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক অনিকেত বোরা সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’কে রঙিন করতে এ কাজে হাত দিয়েছেন, যার প্রথম ধাপ হিসেবে এই সিনেমার কিছু অংশ রঙিন করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। অনিকেতের নাকি অনেক দিনের শখ ছিল এই কাজ সম্পাদন করে তাঁর প্রিয় চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের শততম জন্মবার্ষিকীকে আরও রাঙিয়ে তুলবেন! কিন্তু বিধিবাম! উল্টো সমালোচনাই বেশি হচ্ছে এখন। খেপেছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী সত্যজিৎভক্তরা।


সত্যজিৎপুত্র সন্দীপ রায় তো ঘটনাটির তীব্র প্রতিবাদই করেছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘এর আগেও বিদেশে বহুবার এ ধরনের নিরীক্ষা হয়েছে। তার ফল যে সব সময়ে খুব ভালো হয়েছে, এমন নয়। তবে আমার মতে ক্ল্যাসিকগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া না করাই ভালো। এটাকেও তেমনই আরেকটা নিরীক্ষার চেয়ে বেশি কিছু ভাবতে আমি নারাজ।’

সত্যজিতের সেই অপু-দুর্গা
সত্যজিতের সেই অপু-দুর্গা

সন্দেহ নেই, প্রায় ৬৫ বছর আগের বিখ্যাত এই সিনেমাকে রঙিন করে তোলার পরিকল্পনা সাহসের কাজ বৈকি! বিশেষত, ‘পথের পাঁচালী’র মতো একটি সিনেমা, যেখানে চলচ্চিত্রটির সাদাকালো প্রতিটি ফিতায় সিনেমাপ্রেমীদের ভালোবাসা জড়িয়ে আছে। যদিও ইতিমধ্যে কয়েক মিনিটের রঙিন ক্লিপ তৈরি হয়েছে, কিন্তু তাতে কী? সত্যজিৎভক্তরা ইতিমধ্যেই এই ক্লিপকে বর্জন করার ঘোষণা দিয়েছেন। অনেকে একে ‘ধ্রুপদি শিল্পের ওপর মাতব্বরি’ বলেও মন্তব্য করেছেন। তাঁদের মত এমন, শিল্প কোনো গবেষণাগার না যে এখানে কাঁচামাল ঢেলে তার সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদেয় কিছু জুড়ে দেওয়া যেতে পারে।

প্রথম দিকে ওয়াশিংটন মেরিল্যান্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অনিকেত বোরার পরিকল্পনা ছিল সত্যজিতের পুরো ‘পথের পাঁচালী’কে রঙিন করার। প্রাথমিক ধাপ হিসেবে তিনি ছবির কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্লিপ রঙিন করেছিলেন। কিন্তু সত্যজিৎভক্তদের তোপের মুখে এখন পিছু হটেছেন অনিকেত। বদলে ফেলেছেন তাঁর গলার সুরও। এখানে বলা দরকার, অবশেষে প্রতিবাদ ও সমালোচনার মুখে নিজের বক্তব্য খোলাসা করতেই কয়েক দিন আগে মুখ খুলেছেন অনিকেত বোরা। জানিয়েছেন, অন্য সবার মতো তিনি নিজেও সত্যজিতের একজন ভক্ত। তার কোনো মন্দ উদ্দেশ্য নেই এই মহান চলচ্চিত্রের গায়ে রং ছিটিয়ে এর শিল্পসত্তাকে ধ্বংস করার। তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, এই মহৎ শিল্পকর্মটি এইভাবে দেখার কথা নয়। একটা একাডেমিক পরীক্ষা হিসেবেই আমার এই চেষ্টা। অতীতের পশ্চিমি অনেক বিখ্যাত সিনেমা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অনেক গবেষক-অধ্যাপকেরা এই ধরনের পরীক্ষা করেছেন। আমার হৃদয়ের খুব কাছের একটি ছবি নিয়ে আমি পরীক্ষা চালিয়েছি।’

সত্যজিৎ রায় তাঁর নিজের সৃষ্টি ‘পথের পাঁচালী’ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘কাজ যা করেছি, তার জন্য মনে মনে নিজেকেই তারিফ জানাচ্ছিলাম। সত্যি বলতে কি, এ ছবির সঙ্গে ভারতের বা পৃথিবীর কোনো ছবিরই মিল নেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমার ওপরে হলিউডের রেনোয়াঁর কিংবা ডি’সিকার প্রভাব থাকা সত্ত্বেও এ ছবি একেবারে হাড়ে-মজ্জায় ভারতীয়।’

অনিকেত বোরা
অনিকেত বোরা

সেই ‘হাড়ে-মজ্জায় ভারতীয়’ চলচ্চিত্রকে যখন রং ছিটিয়ে রঙিন করা হলো, সেই পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে কবি-সম্পাদক-প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসুর একটি উক্তি ব্যবহার করাই যথার্থ হবে, ‘সভ্যতার চণ্ডালবৃত্তি’। কেন যে আমরা বুঝতে চাই না প্রতিটি সময়ের নিজস্ব একটা আবেদন আছে, আছে শক্তি। প্রতিটি শিল্পেরই রয়েছে নিজস্ব একটি গড়ন ও ভাষা। এখন কেউ যদি পাবলো পিকাসোর ‘গোয়ের্নিকা’কে সাদাকালো থেকে রঙিন করে দেয়, কেমন লাগবে? এসব ভেবে ‘পথের পাঁচালী’র এই রঙিন কাণ্ডের পর অনেকেই বলেছেন, ভাগ্য ভালো ছবিটির ওপর রঙিন ছোপ সত্যজিৎকে তাঁর জীবৎকালে দেখতে হয়নি!


অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]