শুক্রবারের দুপুর ও বড় হয়ে বেকার হওয়ার গল্প

বহু বছর আগের শুক্রবারের এমন অলস দুপুরে আমিও দর–কষাকষির সূত্রে আব্বার দপ্তরবিহীন অফিসে একটা চাকরি করতাম। তাতে পয়সাকড়িও জুটত খানিক। 

আমার আব্বা ছিলেন স্কুলশিক্ষক। দুর্গম মফস্বলের সীমানা পেরিয়ে শহরের শেষপ্রান্তে ছিল তাঁর স্কুল। প্রতিদিন সেই কাকডাকা ভোরে এক থাল পান্তাভাত, বাসি তরকারি, কখনোবা পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে খেয়ে চলে যেতেন স্কুলের উদ্দেশে। আমরা ঘুম থেকে উঠতে উঠতে আব্বার দেখা পেতাম কদাচিৎই। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল শুক্রবার। ছুটির দিন যেহেতু, বাড়িতেই থাকতেন সপ্তাহের এই দিনে। সকাল থেকে ভাইবোনেরা মিলে সারা সপ্তাহে জমে থাকা বাড়ির খুঁটিনাটি কাজ শুরু করে দিতাম আব্বার সঙ্গে।দুপুর হয়ে এলে কাজের ফাঁকে বিরতি দিয়ে আম্মা মুড়ি, নারকেল দিয়ে যেতেন নাশতা হিসেবে। 

কাজ শেষে আব্বার সঙ্গে মহাসমারোহে চলে যেতাম বাড়ির পাশের নদীতে গোসল করতে। এই পর্ব ভয়াবহ। তখনো সাঁতার জানি না। আব্বা আমার বুক আর পেটের তলে দুই হাত রেখে নদীর কম গভীরতায় নিয়ে হাঁটতেন আর হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে সাঁতার কাটতে বলতেন। আমি মহা উৎসাহ নিয়ে আব্বার কোল আর নদীর পানি কাঁপিয়ে সাঁতার কাটতে শিখি। যখনই আমি একটু হাত-পা ছুড়তে থাকি, কোনো এক অদ্ভুত কারণে আব্বা বুকের নিচ থেকে হাত দুটো সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। ভয়ে দিশেহারা আমি ভয়ার্ত চোখে আব্বাকে ঝাপটে ধরি। আব্বাও আমার ভয়ের কারণ কেমনে কেমনে জানি বুঝে ফেলেন, তাঁকে জড়িয়ে ধরার আগে তিনিই আমাকে উল্টো শক্ত করে ধরে ফেলেন। কতটুকু সাঁতার শিখলাম, তা পরখ করার জন্য কতক্ষণ পর আব্বা একটু দূর থেকে ছেড়ে দিয়ে বলতেন, ভাইয়ার কাছে সাঁতরে যেতে। আমি ভাইয়াকে বিশ্বাস করতে পারি না, দুই হাত যেতে না যেতেই সাঁতরে পেছন দিকে আব্বার কোলে চলে আসি। আব্বা ভয় দেখান, সাঁতার না জানলে আমাকে ঢাকায় নেবেন না। ঢাকা গেলে নাকি সাঁতার শিখতেই হবে।

আব্বা আবার বুক আর পেটের তলে দুই হাত রাখেন, আমি হাত-পা ছুড়তে থাকি। আর এমনি করে হাত-পা ছুড়তে ছুড়তেই কেমন করে যেন একদিন সাঁতার শিখে ফেলি। সেই ছোটবেলায়ই একবার আব্বা-আম্মার সঙ্গে ঢাকা যাবার পথে খারাপ আবহাওয়ায় লঞ্চ ডোবার উপক্রম। সেদিনই আসলে বুঝেছিলাম, আব্বা আমায় সাঁতার শিখাতে কেন উদগ্রীব ছিলেন। সে আরেক গল্প। ছোটবেলায় এভাবেই আমাদের ঘষেমেজে গোসল করিয়ে দিতেন।

আমরা গোসল সেরে ঘরে আসতাম। আব্বা সবার মাথায়, গা, হাত-পায়ে সুন্দর করে শর্ষের তেল মাখিয়ে দিতেন। আব্বা একটা কথা সব সময়ই বলতেন, শর্ষের তেল হলো সব ঋতুতে জ্বর, ঠান্ডাসহ ছোটখাটো রোগের মহৌষধ। যদিও শর্ষের তেল ছোটকাল থেকেই আমার কাছে অপ্রিয় জিনিস। যার কারণে বড় হয়েও বেশির ভাগ সময় ঠান্ডায় ভুগি।

>

আব্বার মেজাজ ভেদে প্রতিটি পাকা চুল বাছায় ২০ পয়সা, ২৫ পয়সাও দর উঠত কোনো কোনো সময়। পিতা-পুত্রের সে কী তুমুল দর–কষাকষি! আমি ঠেলে ২৫ পয়সায় ওঠাই, তো আব্বা ১০ পয়সায় নামিয়ে আনেন। 

যখনকার কথা বলছি, সেই সময়ে সারা সপ্তাহের দুপুরের চেয়ে শুক্রবারের দুপুর ছিল আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। সারা সপ্তাহ না হলেও শুক্রবারের দুপুরে আম্মা সপ্তাহের সবচেয়ে ভালো খাবারটি রাঁধতেন। বেশির ভাগ সময়ই সেই ভালো খাবারটি হতো ডিম দিয়ে রান্না করা আলু, বেগুনের তরকারি। মাটিতে মাদুর বিছানো হলে সবার প্রথমে আব্বা বসতেন। তার ডানপাশে গিয়ে বসতাম আমি। অন্য দুই ভাই–বোন বসত আব্বার বাঁ পাশে। সবাই একটা করে ডিম পেলেও আব্বার থালা থেকে নিয়ম করে অর্ধেক ডিম আমার জন্য রক্ষিত থাকত। তা দেখে দুই ভাই–বোন বাঁকা চোখে তাকালেও কিছু বলার সুযোগ পেত না। তার আগেই আম্মা তার থালার অর্ধেকটা ডিম দুজনকে ভাগ করে দিতেন।

খাওয়া শেষে বিছানায় গিয়ে সুখী রাজপুত্রের মতো আব্বার পাশে গিয়ে বসতাম। আব্বা বলতেন, মাথার পাকা চুল বেছে দে! 

আমরা ভাবতাম, আব্বার বয়স বেড়ে যাচ্ছে! মাথায় পাকা চুল থাকলে বড়কর্তারা হয়তো বয়সের অজুহাত দিয়ে চাকরি খেয়ে নেবে।

আমি আবার আগেই দর ঠিক করে নিতাম, প্রতিটি পাকা চুল বাছা বাবদ কত দেবে! 

পাঁচ পয়সা থেকে শুরু। আব্বার মেজাজ ভেদে প্রতিটি পাকা চুল বাছায় ২০ পয়সা, ২৫ পয়সাও দর উঠত কোনো কোনো সময়। পিতা-পুত্রের সে কী তুমুল দর–কষাকষি! আমি ঠেলে ২৫ পয়সায় ওঠাই, তো আব্বা ১০ পয়সায় নামিয়ে আনেন।

শেষমেশ ১৫ পয়সায় রফা হয়। মনঃক্ষুণ্ন হয়ে হালছাড়া মনোভাব নিয়ে বেছে বেছে পাকা চুল তুলি। আব্বা বলেন, ভালো করে তোল, পুরো ২৫ পয়সাই পাবি। 

৮০টা চুল বাছতে পারলে ২০ টাকা।

আহ! চোখের সামনে কচকচে ২০ টাকার নোট ভেসে ওঠে। একটা ২০ টাকার নোট মানে একটা টেপ টেনিস বল কিনে ফেলা। পাড়ার মাঠে কয়েকটা বিকেল রাজত্ব করার ক্ষমতা অর্জন করা। বাবার আশ্বাসে দ্বিগুণ উৎসাহে কাজে লেগে যাই। মিনিট ১০ কি ১৫; বাবা ঘুমিয়ে পড়েন।

আমি রাজ্য জয় করার আনন্দ নিয়ে ২০ টাকা পকেটে গুঁজে বেরিয়ে পড়ি... 

 এসব স্মৃতি ভাবতে খারাপ লাগে, চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে। আর কখনো বাবার সঙ্গে দর–কষাকষি হবে না, ফেরা হবে না হারিয়ে যাওয়া শৈশবে।

বড় হয়ে গেলাম, আর হয়ে গেলাম বেকার! আহা বাবা! আহা শৈশব, আহা রে! 

ভালো থেকো বাবা... 

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]