করোনা ও বঙ্কিমচন্দ্র

গ্রাফিক্‌স: মনিরুল ইসলাম
গ্রাফিক্‌স: মনিরুল ইসলাম
>

করোনা শব্দটি এখন সবার চেনা। তবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখাতেও করোনার উল্লেখ ছিল, চমকপ্রদ এই তথ্য জানিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রকে নতুনভাবে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে এ লেখায়

করোনাভাইরাসে মানুষের জীবন এখন স্তব্ধ, দৃশ্যত স্থবির। হাতে কাজ নেই, অফিস-আদালত বন্ধ, রাস্তাঘাট ফাঁকা, জনমানুষশূন্য। বিশ্বব্যাপী এমনই ছিল অবস্থা বিগত মার্চ-এপ্রিল থেকে। যত দূর মনে পড়ে, আমাদের দেশে মার্চের শেষে ‘লকডাউন’ শব্দটি প্রথম শোনা গেল। করোনা রোগটা এল চীনের উহান থেকে, আর ‘লকডাউন’ এল পশ্চিমের দেশ থেকে। বরাবরই কৌতূহলী ও রগড়প্রিয় জাতি বাঙালি। বিপদ-আপদেও তাদের কৌতূহল ও রগড়—দুই–ই উসকে ওঠে। করোনার লকডাউন নিয়েও সেটি প্রকাশ পেল। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক।

করোনাকালে লকডাউনের সময় শহুরে এক বন্ধু তার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করছে, দোস্ত, লকডাউন তো হয়ে গেল, ঘরবন্দী অবস্থায় কেমন করে সময় কাটাস? দ্বিতীয় বন্ধুর উত্তর, এই তো, ঘুমাই, ঘুম থেকে উঠে শুয়ে থাকি, আধশোয়া হয়ে শুয়ে থাকি, হেলান দিয়ে শুয়ে থাকি, বসে বসে বেঁকেচুরে শুয়ে থাকি, পায়ের ওপর পা তুলে শুয়ে থাকি, এরপর চিত হয়ে শুয়ে থাকি, কাইত হয়ে শুয়ে থাকি, চিতকাইত হয়ে শুয়ে থাকি, মোবাইল গুঁতাই, টিভি দেখি তারপর উঠে বসি এবং আবারও শুয়ে পড়ি। যাকে বলে সারা দিন হাড়ভাঙা বিশ্রাম।

দুই.

মার্চে করোনার প্রকোপে ঘরবন্দী হয়ে কয়েকটা দিন একটু অস্থিরতা ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়তায় কেটে গেল। তখন মনে পড়ল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুসের ২২ এপ্রিলে সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া একটি বক্তব্যের কথা। তিনি বলেছিলেন, ‘এই ভাইরাস আমাদের সঙ্গে অনেক দিন থাকবে। করোনা মহামারির আগের বিশ্ব যেমন ছিল, তেমন আর থাকবে না।...নতুন এক বাস্তবতা স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।’ এ এক গুরুতর বার্তা। তাই এদিকটায় চোখ রাখলাম গভীরভাবে। করোনায় বিশ্ব পরিস্থিতি ও তার দেশ-বিদেশের সামাজিক-সংস্কৃতিক প্রভাব-প্রতিক্রিয়া লিখে রাখতে শুরু করলাম দিনলিপিতে। কারণ, এই করোনাভাইরাস বিশ্ব ইতিহাসে কতটা ছাপ রেখে যায়, তা আঁচ-অনুমানের জন্য দিনলিপিকে আমি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করছি।

আমরা তো অন্য কাজের কাজি নই। বই-পুস্তক নাড়াচাড়া এবং লেখাপত্র নিয়েই বেঁচেবর্তে আছি। ঠিক করেছি পড়াশোনার ব্যাপারটাই এ সময়ে একটু গুছিয়ে করা যাক। ছাত্রজীবনে বঙ্কিমচন্দ্র পড়েছিলাম পরীক্ষার প্রয়োজনে, এখন একটু ভেবে-বুঝে পড়তে শুরু করেছি। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের পাশাপাশি তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও সমালোচনামূলক লেখাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এসব রচনার মধ্য দিয়ে তিনি বাংলা ভাষার শক্তি, সম্ভাবনা ও প্রকাশক্ষমতার যে নিদর্শন স্থাপন করেছেন, তার গুরুত্ব ঐতিহাসিক। বিদ্যাসাগর ও অক্ষয় দত্তের পর প্রধানত বঙ্কিমচন্দ্রের হাতেই বাংলা গদ্য বিশ্বমানের ভাষায় পরিণত হয়। জটিল বৈজ্ঞানিক বিষয়ের আলোচনায় তাঁর স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ দক্ষতা বিস্ময়কর। তাঁর বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ সংগ্রহ এর অন্তর্ভুক্ত ‘আশ্চর্য সৌরোৎপাত’ প্রবন্ধখানি পড়তে গিয়ে হঠাৎ চমকে উঠি ‘করোনা’ শব্দটি দেখে। না, এটি এখনকার করোনাভাইরাস নয়; বিজ্ঞানের অন্য এক করোনা সেটি। ওই প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘সূর্য্য অতি বৃহৎ তেজোময় গোলক। এই গোলক আমরা অতিক্ষুদ্র দেখি, কিন্তু উহা বাস্তবিক কত বৃহৎ, তাহা পৃথিবীর পরিমাণ না বুঝিলে বোঝা যাইবে না।...ত্রয়োদশ লক্ষটি পৃথিবী একত্র করিলে সূর্য্যের আয়তনের সমান হয়।...সূর্য্যমণ্ডল-মধ্যে যাহা অনুবৎ ক্ষুদ্রাকৃতি দেখি, তাহাও বাস্তবিক অতি বৃহৎ।...কিন্তু সূর্য্য এমনি প্রচণ্ড রশ্মিময় যে তাহার গায়ে বিন্দুবিসর্গ কিছু দেখিবার সম্ভাবনা নাই। সূর্য্যের প্রতি চাহিয়া দেখিলেও অন্ধ হইতে হয়। কেবল সূর্য্যগ্রহণের সময় সূর্য্যতেজঃ চন্দ্রান্তরালে লুক্কায়িত হইলে, তৎপ্রতি দৃষ্টি করা যায়। তখনো সাধারণ লোকে চক্ষুর উপর কালিমাখা কাচ না ধরিয়া, ঋততেজা সূর্য্য প্রতি চাহিতে পারে না।

‘সেই সময়ে যদি কালিমাখা কাচ ত্যাগ করিয়া উত্তম দূরবীক্ষণ যন্ত্রের দ্বারা সূর্য্য প্রতি দৃষ্টি করা যায়, তবে কতকগুলি আশ্চর্য্য ব্যাপার দেখা যায়। পূর্ণগ্রাসের সময়ে অর্থাৎ যখন চন্দ্রান্তরালে সূর্য্যমণ্ডল লুক্কায়িত, তখন দেখা যায়, মণ্ডলের চারিপাশে অপূর্ব্ব জ্যোতির্ম্ময় কিরীটিমণ্ডল তাহাকে ঘেরিয়া রহিয়াছে। ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা ইহাকে করোনা বলেন।...১৮৭১ সালে সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকানিবাসী অদ্বিতীয় জ্যোতির্বিদ ইয়ঙ্গ সাহেব ওই সৌরোৎপাতজনিত বিষয়টিয় সঙ্গে “করোনা” নামটি যুক্ত করেন।’

তবে ওই করোনা আর ২০১৯-এ উদ্ভূত করোনা এক নয়, উৎসমূলে আলাদা। বর্তমান করোনা শব্দটি ইংরেজি ভাষা থেকে নেওয়া, যার আরেকটি অর্থ কোভিড-১৯ (Covid-19)। এটিকে বিস্তৃত করলে পাওয়া যায়: ‘কো’ এসেছে করোনা থেকে, ‘ভি’ অর্থ ভাইরাস, আর ‘ডি’ মানে হলো ডিজিজেস; এবং ২০১৯-এ শুরু বলে এর সঙ্গে ‘১৯’ সংখ্যাটি যুক্ত হয়েছে।

দুই করোনা আলাদা হলেও এক জায়গায় আশ্চর্যজনক মিল দেখতে পাওয়া যায়। করোনার জীবাণুর যে ছবি টিভিতে এখন প্রতিদিনই দেখতে পাই, তার রংও বহুবর্ণিল এবং ইয়ঙ্গ সাহেবের করোনার মতোই উজ্জ্বল রক্তিম, কখনো গোলাপি, কখনোবা নীল কপিশ।

তিন.

বঙ্কিমচন্দ্রের জাতিচিন্তা ও জাতিসত্তগঠন প্রক্রিয়ার বিকাশ ধারা সম্পর্কে যে প্রচলিত ধারণা, তাতে তিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রধান উদ্‌গাতা। কিন্তু তাঁর এই স্বরূপ প্রতিক্রিয়াজাত কি না, সে বিষয়ে আমার মনে কিছু সংশয় আছে। সংশয়ের পেছনে তাঁর কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও আমাদের হাতে আছে। শুরুটা ইতিহাস থেকে উদ্ধার করা যাক।

ষোলো শতকের বাঙালি মুসলমান কবি সৈয়দ সুলতান বাংলায় ধর্মীয় কবিতা লিখেছিলেন ‘ফাতেহা-ঈ দোয়াজ দাহাম’ বিষয়ে। তখন মোগল আমল। সেই আমলের বাংলার অভিজাত মুসলিমরা বাংলায় কথা বলতেন না, বরং একে বিধর্মীর ভাষা জ্ঞান করতেন। তাই সৈয়দ সুলতানকে ‘মোনাফেক’ আখ্যা দেওয়া হয়। সৈয়দ সুলতান কবি, স্বাধীনচেতা মানুষ। তাই তিনি উত্তর দিয়েছিলেন ইতিহাসের ভেতয়ে দাঁড়িয়ে, ‘যাকে যেই ভাসে (ভাষায়) প্রভু করিলেন সৃজন/ সেই ভাস হয় তার অমূল্য রতন।’ এরপরও অভিজাতেরা থামেনি। ফলে শতবর্ষ পরের আরেক কবি আবদুল হাকিমকে বলতে হয়, ‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’এই ইতিহাস মনে রেখে বিচার করলে দেখা যায়, বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিক্রিয়া এত তীব্র নয়, তবে যৌক্তিক ও ইতিহাসনিষ্ঠ। তিনি বলেছেন, বাংলার স্বাধীন সুলতানি আমলে ‘বাঙালির মানসিক দীপ্তি অধিক উজ্জ্বল হইয়াছিল। এই দুই শতাব্দীতে বাঙালির যেরূপ মুখোজ্জ্বল হইয়াছিল সেরূপ তৎপূর্ব্বে বা তৎপরে আর কখনো হয় নাই।’ বঙ্কিমচন্দ্র পরে আরও যা বলেছেন তার মূলকথা হলো, ‘কিন্তু মোগলরা বাঙ্গালার জন্য কিছুই করে নাই, বাঙ্গালার সম্পদ অপহরণ করে দিল্লী ও আগ্রাকে গড়িয়া তুলিয়াছে। তাই মোগলরা বাঙ্গালার শত্রু, পাঠানরা মিত্র।’

কবি সৈয়দ সুলতান ও আবদুল হাকিম প্রায় তাই-ই বলেছেন। আমরা বলেছি, বঙ্কিমচন্দ্র হিন্দু-মুসলমান বাঙালির মিলিত জাতীয়তাবাদ গড়তে চেয়েছিলেন। বাংলার মোগলপন্থী মুসলমান অভিজাতদের জন্য তা হয়নি। বঙ্কিম বলেছেন, ‘বাঙ্গালা হিন্দু-মুসলমানের দেশ—একা হিন্দুর দেশ নহে। কিন্তু হিন্দু-মুসলমান এক্ষণে পৃথক, পরস্পরের সহিত সহৃদয়তা শূন্য। বাঙ্গালার প্রকৃত উন্নতির জন্যে নিতান্ত প্রয়োজনীয় যে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য জন্মে। যতদিন উচ্চশ্রেণির মুসলমানের এমন গর্ব্ব থাকিবে যে, তাহারা ভিন্ন দেশীয়, বাঙ্গালা তাহাদের ভাষা নহে, তাহারা বাঙ্গালা লিখিবেন না, বাঙ্গালা শিখিবেন না, কেবল উর্দু-ফার্সীর চালনা করিবেন, তত দিন সে ঐক্য জম্মিবে না। কারণ জাতীয় ঐক্যের মূল ভাষার একতা।’

অতএব অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতি গড়ে না ওঠার জন্য কারা দায়ী, কবি সৈয়দ সুলতান, আবদুল হাকিম ও বঙ্কিমচন্দ্রের উপর্যুক্ত বক্তব্য পাঠে আমরা সেটি নতুনভাবে চিন্তা করতে পারি। করোনাকালে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘করোনা’ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে গিয়ে কথাগুলো মনে এল। এটি বারান্তরে আরও আলোচনার দাবি রাখে।