মুর্তজা বশীর সঙ্গ ও নৈঃসঙ্গ্য

জন্মদিন: ১৭ আগস্ট ৮৪ বছরে পা দিলেন শিল্পী মুর্তজা বশীর
মুর্তজা বশীর। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
মুর্তজা বশীর। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

জুলাই ১৯৭৪-এর এক বর্ষণসিক্ত সকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে যোগ দিতে সভাপতি রশিদ চৌধুরীর কক্ষে ঢুকে দেখি, দীর্ঘ চুল-দাঁড়ি সজ্জিত মুর্তজা বশীর তাঁর বর্ষাতি দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখে প্রশ্নময় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে। রশিদ চৌধুরী আর শিক্ষক দেবদাস চক্রবর্তী তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি খানিক উদ্ধতভাবে সামান্য মাথা নাড়লেন। তিন মহারথী শিল্পীর সামনে কিছুটা অসহায় বোধ করলাম। দেবদাস চক্রবর্তী স্বভাবসুলভ হইচই করে চা-মিষ্টি আনিয়ে পরিবেশ সহজ করে দিলেন। বয়সের বিরাট ব্যবধান আর তিনজন তিন প্রকৃতির মানুষের সঙ্গেই বেশ কিছুদিন আমাকে একা চলতে হয়েছে। রশিদ চৌধুরী ও দেবদাস চক্রবর্তীকে আগে থেকে চিনতাম। তিনজন কেমন করে জানি না তিন রকম সম্বোধনের পাত্র হলেন—যথাক্রমে রশিদস্যার, দেবুদা আর বশীরভাই। এঁদের মধ্যে আবার অপরিচয় আর দুরধিগম্যতার বেড়া ডিঙিয়ে মুর্তজা বশীরের সঙ্গেই সম্পর্ক ধীরে ধীরে হয়ে উঠল প্রায় বন্ধুপ্রতিম। ১৯৯৮ সালে অবসর গ্রহণ ও কয়েক বছর পর স্থায়ীভাবে ঢাকা চলে যাওয়ার পর যোগাযোগ কমেছে, তবে একেবারে বন্ধ হয়নি।
তাঁর তিরাশিতম জন্মবার্ষিকীতে দৃশ্যশিল্প ও সৃজনকলার বিবিধ এলাকায় বিচরণ করা বশীরভাইকে নানা অনুভবে স্মরণ করি। স্মরণে আনি দীর্ঘ প্রায় আড়াই দশক সহকর্মী হিসেবে তাঁর সাহচর্যের অম্লমধুর স্মৃতি। মুর্তজা বশীর এমন একটি চরিত্র, পছন্দ কিংবা অপছন্দের সীমাকে ডিঙিয়ে যিনি স্মৃতির কোঠায় স্থায়ী ছাপ রেখে যেতে পারেন। বয়সের ভার কিংবা অসুস্থতা নিষ্ক্রিয় করতে পারে, এমন মানুষ তিনি নন। তাই এ শিল্পীর জন্মদিনে শুভকামনার পুষ্পের সঙ্গে পাঠাই প্রত্যাশারও কিছু কুঁড়ি।
প্রথিতযশা পিতার সন্তান হওয়ার সুবিধা ও অসুবিধার মধ্যে বেড়ে উঠেছেন শিল্পী মুর্তজা বশীর। সমাজে তাঁর অবস্থান তাঁকে বাল্যকাল থেকে করে তুলেছে কিছুটা দুর্বিনীত, অননুমেয় মেজাজের, আত্মসচেতন, কিছুটা বা আত্মকেন্দ্রিক। অন্যদিকে, উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি লাভ করেছেন তুঙ্গ স্পর্শ করার অপরিসীম আকাঙ্ক্ষা, সদা-সক্রিয় উন্মুখ মানসিকতা ও নিরলস পরিশ্রমী জীবন। তাঁর সৃজনকলার জগৎও গড়ে উঠেছে এ উভয়বিধ মানসিকতার সংশ্লেষ ও সংঘাতে। নানা বিপরীত বৈশিষ্ট্যের সমাহারপূর্ণ এ মানুষটির সঙ্গে মতের মিলের চেয়ে অমিল হয়েছে অধিক, তবু তাঁর সাহচর্য বিস্মৃত হওয়ার নয়।

মুর্তজা বশীরের তেলরংচিত্র ‘সূর্যমুখী’, ১৯৬৭
মুর্তজা বশীরের তেলরংচিত্র ‘সূর্যমুখী’, ১৯৬৭

বাংলাদেশের শিল্পকলার পরিসরে মুর্তজা বশীর আজ অপরিহার্য ও অবশ্য-উল্লেখ্য নাম। ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের পর সদ্য বিকাশমান এই অঞ্চলের দ্বিধাগ্রস্ত শিল্পকলাকে যাঁরা পর্যাপ্ত আস্থা ও উপাদান জুগিয়েছেন, তিনি অবশ্যই তাঁদের মধ্যে অন্যতম। দৃশ্যশিল্পের বিভিন্ন শাখায় যেমন বিচরণ করেছেন তিনি, তেমনি সৃজনকলার অন্য দুটি মাধ্যম সাহিত্য ও চলচ্চিত্রেও রেখেছেন সৃজন-প্রতিভার স্বাক্ষর। ঢাকার আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে বেরিয়েছেন ১৯৫৪ সালে, জয়নুল-কামরুলের কাছ থেকে যেটি অর্জন করেছিলেন, তার মধ্যে ছিল প্রখর শক্তিশালী ড্রয়িং এবং তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণশক্তি। মুর্তজা বশীর চিত্রকলায় সব সময় স্থাপন করতে চেয়েছেন দার্ঢ্য আর পৌরুষ, ফলে প্রায় সব সময় তেল-মাধ্যমের রঙেই তিনি অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮-তে শিক্ষা লাভ করেছেন ইতালিতে, অতি তরুণ বয়সে পশ্চিমা আধুনিক শিল্পের খোলা জানালা দিয়ে জগৎকে দেখার দৃষ্টি অর্জন করেছেন। মোজাইক ও ছাপচিত্র শিখেছেন পারিতে, ১৯৭১-৭৩ সময়ে।
এসব বিস্তারিত জানানোর আগে পরিচয়ের সূত্রপাতে তাঁর যে প্রতিভাটিতে প্রথম আকৃষ্ট হয়েছিলাম, সেটি তাঁর রেখাঙ্কনের নৈপুণ্য, সামনে বসা যে কারও মুখচ্ছবি হুবহু মিলিয়ে আঁকার বিরল দক্ষতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম। তাঁর সে রেখা বাস্তবিকের প্রতিচ্ছবিতেই শেষ নয়, প্রবহমান রেখার সৃজনশীল উৎকর্ষে সমৃদ্ধ। মুর্তজা বশীরদের প্রজন্মের বিমূর্ততার প্রতি অতি পক্ষপাতের বিরুদ্ধে মন যখন প্রতিবাদী হয়ে উঠছে, তখন দেখলাম দ্বিমাত্রিক চিত্রপটে বস্তুপুঞ্জের মধ্যে সম্পর্ককে কীভাবে একটি জ্যামিতিক বাঁধনের আওতায় আনতে হয়, সে বিষয়ে তাঁর কাছে ছাত্রের মতো শেখার আছে। এটি স্বীকার করতেই হয়, গথিক ভাস্কর্য, বাইজেন্টিনীয় মোজাইক বা ইতালির প্রাগ-রেনেসান্সের চিত্রকলার আপাতপ্রাণহীন স্থবিরতার মধ্যে যে সুঠাম-সমুন্নত শিল্পের ঝলকানি আছে, তা অনুধাবনের চোখ, অন্তত আমার ক্ষেত্রে, তিনিই খুলে দিয়েছিলেন। তত দিনে তিনি হয়ে উঠেছেন ‘বশীরভাই’। তাঁর লেখা গল্পের সঙ্গে আগেই পরিচয় ছিল, পরিচয় ঘটল তাঁর উপন্যাস ও কবিতার সঙ্গে, চলচ্চিত্রে চিত্রনাট্যকার, সহপরিচালক ও সেট-ডিজাইনার হিসেবে তাঁর কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও। আরও পরে মুদ্রাতত্ত্ব বিষয়ে তাঁর গবেষণা তাঁকে এ বিষয়ে উপমহাদেশে পরিচিতি ও খ্যাতি এনে দেয়। কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য হিসেবে জেলও খেটেছেন তিনি। সৃজনশীলতার বহুমাত্রিকতায় সম্ভবত বাংলাদেশের চারুশিল্প পরিমণ্ডলে তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই।

মুর্তজা বশীরের অাঁকা আত্মপ্রতিকৃতি
মুর্তজা বশীরের অাঁকা আত্মপ্রতিকৃতি

এর উল্টো পিঠে আছেন ব্যক্তি মুর্তজা বশীর—এমন আত্মপ্রেমিক মানুষ কমই দেখা যায়। আড্ডায় বা টেবিল-টকে তিনি থাকলে আর কারও কথা বলার অবকাশ নেই। তাঁর কথার ফুলঝুরি অবশ্য কেবলই নিজকে নিয়ে। তবে সজীব ও সরস পরিবেশনার গুণে সেগুলো কখনো আকর্ষণ হারায় না। সেখানে ব্যক্তিগত স্মৃতি থেকে যেমন উঠে আসেন পিতা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বা কমরেড দেবেন শিকদার, তেমনি হাজির হন (পশ্চিম) পাকিস্তানের প্রখ্যাত কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ বা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। আসেন তাঁর বন্ধুরা—হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, আমিনুল ইসলাম, কাইয়ুম চৌধুরী ও অন্য শিল্পীরা। তাঁর চিত্রভাবনা নিয়ে বিভিন্ন কথা তিনি বলেন, তবে তাঁর চিন্তা ও পরিকল্পনার বয়ান যতটা ডানা মেলে বাস্তবে, অনেক ক্ষেত্রে ছবিতে ততটা প্রতিভাত হয় না। আড্ডা জমিয়ে রাখার পারঙ্গমতা আর কথাবার্তায় চৌকস মুর্তজা বশীরকে তবু সব সময় মনে হয়েছে অন্তর্জগতে একজন নিঃসঙ্গ মানুষ।
নানা বৈপরীত্যের সমাহারকে তাঁর বৈশিষ্ট্য হিসেবে মনে হয় তিনি নিজেই নির্মাণ করেছেন। তাঁর জীবনের একটি পর্যায়ে রাজনৈতিক সক্রিয়তা থাকলেও আমরা যে বশীরভাইকে চিনেছি সত্তরের দশক থেকে, তাঁর মধ্যে তেমন কোনো স্পষ্ট রাজনৈতিক অঙ্গীকারের দেখা মেলে না। এর বদলে পাই এ অঞ্চলের ইতিহাস বিষয়ে তাঁর গবেষক-সদৃশ উদ্যম, প্রভূত জ্ঞান ও সচেতনতা, সে সঙ্গে বাঙালির লোককলা ও কারুকর্ম বিষয়ে গভীর আগ্রহ। তবে চিত্ররচনায় এ পর্যায়ে এসে তিনি হয়ে পড়েছেন ব্যক্তিগত ভাব প্রকাশে অধিক আগ্রহী। সমষ্টির প্রতি দায়বোধ বা সমকালের ঘটনাপ্রবাহ অন্তত তাঁর এ সময়ের চিত্ররচনে তেমন প্রভাব ফেলেনি। তাঁর ‘শহীদ শিরোনাম’ (এপিটাফ ফর দ্য মারটায়ার্স) সিরিজচিত্রের কথা মনে রেখেই এটি বলা, এপিটাফ যত না শহীদ যোদ্ধার প্রতি শোক-স্মরণিকা, তার চেয়ে বেশি শিল্পী মুর্তজা বশীরের ব্যক্তিগত শিল্পকাঠামো সন্ধানের ফসল। এ অনুসন্ধানের একটি পর্বে ধর্মভিত্তিক বিষয়ও তাঁর মধ্যে প্রাধান্য পায়, কলেমা-তাবিজ-জায়নামাজ-আরবিলিপি—এসবের মধ্যে তিনি সন্ধান করতে চান তাঁর শিল্পের গড়ন। আবার যখন নতুন করে অবয়বধর্মী কাজে ফিরেছেন, সেখানে দেখি নেহাত মানবরূপের উপস্থাপনেই তিনি সন্তুষ্ট নন, বাংলার লোকচিত্রধারা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে একটি অর্থবহ পথ নির্মাণে তাঁর আগ্রহ। বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া, বীরভূমকে কেন্দ্র করে মূলত পশ্চিমবঙ্গে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে মন্দিরগাত্রে টেরাকোটা অলংকরণের যে একটি বিশিষ্ট রূপ প্রকাশ পেয়েছিল, সে সম্পর্কে গবেষণা করার জন্য মুর্তজা বশীর শারীরিক কষ্টকে অগ্রাহ্য করে যেসব দুর্গম স্থানে গেছেন ও আলোকচিত্র তুলেছেন, সেগুলো দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। অসামান্য সেসব আলোকচিত্রের সমাহারে একটি গ্রন্থ রচনা করার ক্ষমতা তাঁর ছিল। কিন্তু বশীরভাই সেটি আর করলেন না।

.
.
মুর্তজা বশীর চিত্রকলায় সব সময় স্থাপন করতে চেয়েছেন দার্ঢ্য আর পৌরুষ, ফলে প্রায় সব সময় তেল-মাধ্যমের রঙেই তিনি অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন

এর মানে এ নয় যে মুর্তজা বশীরের মধ্যে সচেতন ও যুগ-যন্ত্রণায় আর্ত শিল্পীসত্তাটি নেই। এর শক্তিমান প্রকাশ আমরা দেখি ১৯৬০-৬১ সাল থেকে লাহোরে বসে আঁকা ছবিতে আর ১৯৬৭-৭২ সময়কালে আঁকা তাঁর ‘দেয়াল’ শীর্ষক চিত্রমালায়। ক্ষুব্ধ ও কম্পমান ভঙ্গুর রেখা, প্রশান্ত ও স্নিগ্ধ রঙের স্থলে পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত চীৎকৃত রং, মসৃণ ক্যানভাসের বদলে পুঞ্জ পুঞ্জ টেক্সচার মিলে এ যেন এক ভয়াবহ সময়ের ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের চেহারা। প্রচলিত সৌন্দর্যবোধের বাইরে গিয়ে এ ধরনের শক্তিমান অভিব্যক্তি ওই সময় আর কারও কাজে দেখা গেছে বলে মনে হয় না। ১৯৭৫ থেকে আঁকা ‘শহীদ শিরোনাম’—মুক্তিযুদ্ধে নিহত নাম না জানা শহীদদের উদ্দেশে নিবেদিত চিত্রমালা। সাদা পটভূমিতে বিভিন্ন আকৃতির ভাসমান ফর্ম, ভেতরের আকৃতিগুলো বিভিন্ন মোলায়েম রঙের সূক্ষ্ম পর্দায় পরস্পর-বিলীয়মান। এখানে আকৃতি ও রঙের ব্যবহার কমনীয়।
বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য দেয়ালচিত্র করেছেন মুর্তজা বশীর। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে, ১৯৭৪-এ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে ইটের টুকরোর মোজাইকে করা ‘শহীদ বৃক্ষ’ আমাদের দেয়ালচিত্রের অঙ্গনে একটি ‘মান্টারপিস’ হিসেবে বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। এখানে একেবারে দেশীয় ঐতিহ্যকে বহন করে এমন একটি উপাদান—পোড়ামাটির ইটের ব্যবহারে বশীরভাই আবারও তাঁর চিন্তা ও প্রয়োগে বিশিষ্টতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
নানা বৈপরীত্য সত্ত্বেও ভাবনা ও মননে বশীরভাই সমকালীন জগতেরই বাসিন্দা। চরিত্রগতভাবে তিনি মূলত নিঃসঙ্গ ও বিচ্ছিন্ন এবং অনেকখানি আত্মকেন্দ্রিক। তাঁর গল্প, তাঁর উপন্যাস, এমনকি তাঁর কবিতাও মূলত আত্মজৈবনিক। তাঁর ছবি তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি সার্থক ব্যক্তিক অনুভূতিকে সর্বজনীন বোধের ব্যাপ্তি প্রদানে, তাঁর চিত্রভাবনা অন্য সব সৃজনকর্মের চেয়ে অনেক ব্যাপক ও অনুসন্ধানী। চিত্রকর মুর্তজা বশীরের কাছে সে কারণে এখনো আমাদের প্রত্যাশা জাগরিত আছে, সে কথাটি তাঁর জন্মদিবসে জানিয়ে রাখি।