পাহাড় ঘেঁষে খাদ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এখন তুমি বলতে পার, নিজের স্বামীকে সামলাতে পারেন না, আমাকে এসব বলতে আসার মানে কী, তাই না? ভদ্রতা করে এ কথা মুখের ওপর না বললেও মনে মনে এ রকমই ভাবছ তুমি। আমি কী করে জানি যে তুমি এ রকমই বলতে চাইছ বা মনে মনে ভাবছ? জানি, কারণ এ ধরনের কনভারসেশনে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তোমার মতো শতকরা নব্বই ভাগ মেয়ে এ কথাটাই বলবে। ইটস আ কাউন্টার অ্যাটাক...যাকে বলে পাল্টা মার দেওয়া। মানে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে একটা মানুষের পক্ষে আর তো পিছু হটা সম্ভব হয় না, তখন সে পাল্টা আক্রমণে নামবেই। িক ঠিক বলেছি?
প্রতিপক্ষের দিকে তাকাল আভা। তার কথার তোড়ে কতটা ভাসিয়ে নিতে পারল মেয়েটাকে, কতটা অপ্রস্তুত ও বিব্রত সে এই মুহূর্তে, এটা পরখ করতে গিয়ে একটু হতাশই হলো বোধ হয়। ফারজানা নামের ২২-২৪ বছরের ‘নাবালিকা’টিকে নিজের ব্যক্তিত্ব ও অভিজ্ঞতার জোরে যতটা অসহায় করে তুলবে ভেবেছিল সেটা যে ঠিকঠাকমতো হলো না বুঝতে পেরেছে আভা মোস্তফা কামাল। মানতেই হলো দিন পাল্টেছে, যতটা সে ভেবেছে তার চেয়ে অনেক বেশি। এখনকার মেয়েরা অনেক বেশি স্মার্ট। আফটার অল ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় দেশি-বিদেশি টিভি চ্যানেলে সব সময় কথার যুদ্ধ দেখছে।
এতটুকু উত্তেজিত না হয়ে ঠান্ডা গলায় ফারজানা বলল, আপনার জায়গায় থাকলে আমি হয়তো আরও বাজে ভাবে রিঅ্যাক্ট করতাম। বাট আই হ্যাভ টু অ্যাগ্রি, ইউ আর মোর র্যাশনাল দেন এনি আদার কমন উয়োম্যান।
থ্যাংকউ। থ্যাংকস ফর দ্য কমপ্লিমেন্ট। কিন্তু তুমি আমাকে একটা কথা বল তো, তোমার কী ধারণা কামাল তোমাকে ভালোবাসে?...আই মিন তোমার প্রেমে পড়ে সে হাবুডুবু, ইভন যে কারণে সে তার এত বছরের দাম্পত্যজীবন, অ্যান্ড আ লাভলি চাইল্ড অব টোয়েলভ ইয়ারস...সব ছেড়েছুড়ে দিতে রাজি?
শুনলে আপনি হয়তো কষ্ট পাবেন, ইনফ্যাক্ট ইউ মে ফিল ইনসাল্টেড। কিন্তু আলোচনাটা যখন আপনিই শুরু করলেন, আমি বলতে পারি, ব্যাপারটা কিন্তু এখন অনেকটাই আমার হাতে। কামাল আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। ইফ আই অ্যাগ্রি টু মেরি হিম, হি উইল লিভ এভরিথিং। আমার জন্য কামাল, আই মিন কামাল স্যার ক্যান লিভ হিজ ফ্যামিলি...এ কথাটা সে মানে উনি নিজের মুখে বলেছেন।
তুমিও বাসো?
হ্যাঁ বাসি।
আভার মুখে বিদ্রূপমিশ্রিত হাসির আভাস।
আপনি হাসছেন যে?
হাসছি, কারণ এই বিষয়টা তোমার কাছে নতুন মনে হলেও আমার কাছে কিন্তু তা নয়। তোমার মনে হচ্ছে ‘কামাল অ্যাসোসিয়েটসের’ ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোস্তফা কামাল সব ছেড়েছুড়ে জীবন-যৌবন, ধন-মান সব তোমার হাতে তুলে দিতে রাজি। ব্যাপারটা তো সে রকম নয়। কামালের অতীত সম্পর্কে তুমি আর কিছু খোঁজখবর নাওনি?
মানে?
মানে তোমার মতো স্মার্ট মেয়ে জানে না যে এর আগেও কামালের আরও দুটো একস্ট্রা মেরিটাল রিলেশন ছিল। তারাও মনে করত তাদের জন্য কামাল সব ছেড়েছুড়ে...।
আমি দুই বছর এই অফিসে কাজ করছি। এ রকম কিছু কামাল, আই মিন কামাল স্যার সম্পর্কে শুনিনি। আপনি হয়তো ওর সম্পর্কে একটা বাজে ধারণা দিয়ে আমাকে...।
আভা হাসে। আবার তার হাসিতে বিদ্রূপের আভাস।
মিডএজ ক্রাইসিস বলে একটা কথা আছে, শুনেছ ফারজানা? সাধারণত বিত্তবান মানুষদের বেশি হয়, কারণ এটা তারা এফোর্ড করতে পারে। তোমার বিষয়ে কামালের আগ্রহের ব্যাপারটা অনেকটা মিডএজ ক্রাইসিসই। একই স্ত্রীর সঙ্গে একঘেয়ে একটা সংসার, চার্মলেস সেক্সলাইফ...। তা ছাড়া আমিও তো আর ষোড়শী বা অষ্টাদশী নই...চল্লিশের ওপর বয়স হয়েছে।
মিডএজ ক্রাইসিস! শুধু নতুনত্বের জন্য? সেক্সের জন্য? তাহলে আমাদের অফিসে তো আরও অনেক মেয়ে আছে...। অফিসেই বা কেন কামাল দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ায়...টাকা দিলে সবখানেই ওসব মেলে। তবু কেন? তা ছাড়া আই মাস্ট সে, বয়স হলেও ইউ আর স্টিল আ অ্যাট্রাকটিভ ওম্যান।
থ্যাংকস অ্যাগেইন ফর দ্য কমপ্লিমেন্ট। কিন্তু ধরো আগ্রার তাজমহলটা যদি তোমার নিজের বাড়িও হতো, তুমি কি দিনরাত সেখানে শুয়ে-বসে কাটিয়ে দিতে পারতে? তোমার বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা হতো না? এমনকি দূরের বস্তির ঝুপড়িগুলোর জীবন কেমন সেটা দেখার আগ্রহ বা কৌতূহলও তো হতে পারত, পারত না?
আপনি আমাকে অপমান করার, মানে ছোট করার চেষ্টা করছেন, ম্যাডাম।
না না ছোট করছি না, শুধু একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে চাচ্ছিলাম...
বোঝাতে চাচ্ছিলেন আপনার মতো একটা তাজমহলের সান্নিধ্যে থেকেও নিছক আগ্রহ বা কৌতূহল থেকে কামাল আমার মতো একটা বস্তির ঝুপড়িঘরে উঁকিঝুঁকি মারছে।
বাহ্, মেয়েটা তো শুধু দেখতে সুন্দরী নয়, বুদ্ধিমতীও। উইট হিউমার বোঝার মতো রসবোধও আছে। কিন্তু এখন চেহারা দেখে মনে হচ্ছে প্রচণ্ড রেগে গেছে। বেশ ঠান্ডা মাথায়, নিচুকণ্ঠে জটিল বিষয়ের অবতারণা করেছিল আভা। এখন সেটা কি উত্তেজনার দিকে গড়াচ্ছে?
পাহাড়ের ওপর বাংলোটা, তার ঘাসছাঁটা লনের অর্ধ-বৃত্তাকার প্রান্তে সারি সারি একই উচ্চতার নানা জাতের ফুলগাছ। সীমানা ঘেঁষে লোহা ও কাঁটাতারের ফেন্সিং দেওয়া। প্রাঙ্গণজুড়ে কিছু দূর পর পর প্লাস্টিকের চারটি চেয়ার, একটি টেবিল ও মাথার ওপর বিরাট একটি করে ছাতা। কাঁটাতারের সীমানার ওপাশেই ঢালু হয়ে নেমেছে পাহাড়। খাঁজ কাটা নয়। এখান থেকে পাহাড়ের ঢালটা ধাপে ধাপে না নেমে হঠাৎ করেই যেন অতলে হারিয়ে গেল। বেশ বিপজ্জনক। কাউকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে বা স্বেচ্ছায় ঝাঁপিয়ে পড়ে কেউ আত্মহত্যা করতে চাইলে মৃত্যু অনিবার্য।
মেঘ-পাহাড়, নদী-অরণ্যের এমন মিলেমিশে যাওয়া সৌন্দর্য আর কোথাও খুঁজে পায় না আভা। জীবনে প্রায় অর্ধেক পৃথিবী ঘুরে দেখার সুযোগ হলো। কিন্তু এখানে এলে যে অদ্ভুত রোমাঞ্চের বোধ ছড়িয়ে পড়ে শরীরে-মনে, সে রকম আর কোথাও হয় না।
প্রায় ১৮-১৯ বছর আগে এখানে কামালের সঙ্গে হানিমুন করতে এসেছিল আভা। কামাল তখন সবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে এখানে-ওখানে কপাল ঠুকছে। গরিবের ছেলে আর বড় লোকের মেয়ের ফর্মুলা গল্পের মতো আভার প্রেমে পাগল। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে সামান্য বেতনের িক-না-কি একটা চাকরি জুটল, অমনি আভাকে বিয়ের জন্য মরিয়া।
কম বয়সে কিছু কিছু ছেলেসুলভ পণ্যের মতো নিজের দুঃখটাকে বিক্রি করতে জানে। তখন কামালের ধরনটা ছিল সে রকম। আভার কাছে সে নিজের অসহায় চেহারা আর চিরদুঃখী ইমেজটা বিক্রি করেছিল। নিজের দিক থেকে ব্যাপারটা প্রেম না করুণা বুঝে ওঠার আগেই পরিবারের যাবতীয় বাধা উপেক্ষা করে এই অ্যাডভেঞ্চারে জড়িয়ে পড়েছিল আভা। কামালকে বিয়ে করে পালিয়ে এসেছিল বান্দরবানে। এক বন্ধু আর্মি অফিসার এই অসাধারণ গেস্ট হাউসে মধুচন্দ্রিমা যাপনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আশ্চর্য বাকি জীবনে আর কখনো দেখা হয়নি ভদ্রলোকের সঙ্গে। হাসনাত বা আমজাদ কিছু একটা নাম ছিল তাঁর। তখন এই বাড়ি আর বাড়ি ঘিরে টিলাটার নাম ছিল ‘প্যারাডাইস হিল’। মধুচন্দ্রিমার সেই কয়েকটি দিনের সুখময় স্মৃতি জীবনে আর কখনো ভুলতে পারেনি আভা। কামাল পেরেছে কি না জানে না, নিশ্চয় পেরেছে।
সেই সুখস্মৃতি নিয়ে শহরে ফিরে টাকাপয়সার টানাটানির মধ্যেও কী সুন্দর দিন কেটে যাচ্ছিল। বিত্ত-বৈভবের সংসার থেকে হঠাৎ অভাব-দারিদ্র্যের এক অপরিচিত জগতে এসে দিশেহারা লাগছিল তো বটেই, কিন্তু কী ভালোবাসার উত্তাপে ভরা ছিল সেই দিনগুলো। আজ মনে হয়, ‘জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার/তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার।’
আভা প্রেমে পড়েছিল রোগাপটকা একটা হ্যাভনটের। একটু ভালোবাসার জন্য তার আকুতি দেখে নিজের সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে গিয়েছিল। আর এখন ফারজানা প্রেমে পড়েছে এক সফল বিত্তবান পুরুষের। সামাজিক, অর্থনৈতিক এমনকি বর্তমান চাকরিতে তার অবস্থানের হিসেবে এই পুরুষের সামনে এসে মুখ তুলে তাকানোর যোগ্যতাও তার নেই। কিন্তু মেয়েটি এই মানুষটির দুর্বলতাকে শনাক্ত করতে পেরেছে। এখন সে কনফিডেন্ট। এতটাই কনফিডেন্ট যে তার স্ত্রীর মুখের ওপর কেমন অনায়াসে বলতে পারছে, সে চাইলে লোকটাকে তার সংসার থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে! জীবনকে তুমি কতটা চিনেছ মেয়ে? পুরুষ মানুষকে?
টাকাপয়সা হওয়ার পর ‘প্যারাডাইস হিলটা’ তার প্রবাসী মালিকের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিল কামাল। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী আভাই তার বাংলা নাম রেখেছিল ‘মেঘদূত’। প্রথম দিকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে প্রতিবছর একবার, কখনো দুবারও বেড়াতে আসত কামাল। এখন আর তেমন আসা হয় না। ব্যবসার কাজে ব্যস্ততা বেড়েছে কামালের। মেয়ে নাফিসা পড়ছে অস্ট্রেলিয়ায়, ভ্যাকেশনে দেশে এলে কখনো তিনজন মিলে, কখনো বা শুধু মেয়েকে নিয়ে একা বেড়াতে আসে আভা।
কেয়ারটেকার মুমু মারমাই দেখাশোনা করে। পরিবার নিয়ে মুমু গ্যারেজের পাশে একটি ঘরে থাকে। মুমুর পরিবার মানে মা-মরা একটি মেয়ে। মুমুই লোকজন লাগিয়ে বাড়ি-বাগান সব সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখে। এবার হঠাৎ ‘কামাল অ্যাসোসিয়েটসে’র কয়েকজনকে নিয়ে এখানে আসার পরিকল্পনা করেছে কামাল। ম্যানেজমেন্টের সিনিয়র কয়েকজনকে নিয়ে অনেকটা পিকনিকের মতো। আভাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল, সে-ও আসবে কি না। রাজি হয়ে যাবে ভাবেনি হয়তো। কারণ, কামালের সঙ্গে তার সম্পর্কটা এখন শুধুই একটা আনুষ্ঠানিক সামাজিক সম্পর্ক ছাড়া আর কিছুই তো নয়। এক ছাদের নিচে থাকে, আলাদা ঘরে। কদাচিৎ শারীরিক মিলন যে হয় না, তা-ও নয়। তবে ওইটুকুই। সম্পর্কের সব রং যে কখন চটে গেছে নিজেরাও আর মনে করতে পারে না। এই সম্পর্ক না থাকলেও হয়। কিন্তু আভা নতুন করে অন্য রকম জীবনের জন্যও তেমন উৎসাহ পায় না বলে এটাকেই মেনে নেয়। কামালের ব্যাপারটাও বোধ হয় তাই। কামালের নানা রকম আসক্তির কথা নানা মুখে শোনে। এ নিয়ে ঝামেলা করে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্যমও নেই তার।
আভা ‘মেঘদূতে’ আসতে রাজি হয়েছিল। সিনিয়র ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে ফারজানা নামের ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি কেন এই সফরে আসার সুযোগ পেল এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি, যদিও এই মেয়েটির সঙ্গে কামালের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে কানাঘুষা শুনছে অনেক দিন ধরেই। এই মেয়েকে সফরসঙ্গী করার ব্যাপারে আপত্তি তোলার প্রয়োজন বা সাহস করেনি সহকর্মীরা, আর আভার প্রবৃত্তি হয়নি।
তবু আজ কেন জানি মেয়েটার সঙ্গে অনেকটা সময় যেচে পড়ে আলাপ করে মনে হলো, জীবনকে নিজে যতটা জানে, পুরুষ মানুষকে নিজে যতটা চেনে আভা, তার কিয়দংশ অন্তত তারও জানা দরকার। এটা কী একধরনের প্রতিশোধ স্পৃহা? মনে হয় না। কারণ, স্বামীকে নিয়ে যে ধরনের প্রতিযোগিতা থেকে প্রতিশোধের জন্ম হতে পারত মনে, সে ব্যাপারে, অর্থাৎ কামাল সম্পর্কে নিস্পৃহ সে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু একটু খেলতে ইচ্ছে করছে, স্রেফ একটা খেলা।
খালি পায়ে ঘাসের লনে হাঁটতে আরাম বোধ হচ্ছিল। এখন ফেব্রুয়ারি, মাঘ মাসের শেষ দিক। শীত তেমন তীব্র নয়, তবে হালকা শীতল হাওয়াটা আরাম দিচ্ছে। এখানে সন্ধ্যা নেমে আসে একটু আগেভাগে। গেস্ট হাউসের বারান্দার আলো জ্বলে উঠেছে সবে, তার কিছুটা প্রাঙ্গণটাকেও আলোকিত করেছে। কিন্তু দূরের পাহাড়গুলো দাঁড়িয়ে আছে যেন মুঠো মুঠো অন্ধকার হয়ে।
কামালের অধস্তন সহকর্মীরা একটা টেবিল ঘিরে বসে চা-নাশতার আসর জমিয়ে তুলেছে হাসি-আড্ডায়। বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ সজলই শুধু তার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছে ভ্রমণসঙ্গী করে, বাকিরা এসেছে একা। আসরে ফারজানা নেই। একটু আগে বারান্দায় ছিল, এখন বোধ হয় নিজের কামরায়। চারপাশটা একটু ঘুরে ঘরেই ফিরে এল আভা।
সেখানে একা বসে পান করছিল কামাল। সামনে গিয়ে বসল আভা। কামাল মুখ তুলে তাকিয়েছিল একবার। দ্রব্যগুনে তার চোখ ঈষৎ লাল। হঠাৎ কোনো প্রসঙ্গ ছাড়াই আভা বলল, মুমু মারমার মেয়েটাকে দেখেছ?
চাঁপা না চামেলি না কী যেন নাম...। কদিন আগেও দেখেছি এইটুকুন মেয়ে, হঠাৎ বড় হয়ে গেল।
মেয়েটার নাম চামেলি। খাসা দেখতে।
ও তুমি দেখেছ।
হ্যাঁ।
কামালের রুচির পরিবর্তনটা টের পাচ্ছে বেশ অনেক দিন ধরে। ‘খাসা’ শব্দটির প্রয়োগে তাই অবাক হয়নি আভা, বলল, এই মেয়েকে তো অনায়াসে বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতায় পাঠিয়ে দেওয়া যায়।
জড়ানো গলায় একটু হেসে কামাল বলল, কী বলছ।
ওহ্ ইয়েস। আই মিন ইট। আজ ভোরবেলায় বাড়ির চারপাশে একটু হাঁটছিলাম, দেখি মেয়েটা গোসল করছে কলতলায়। ভেজা শরীর...মাই গড, কী ফিগার!’
কামাল চোখ তুলে তাকাল, নেশাগ্রস্ত চোখে কিছুটা বিভ্রম, বাকিটা অন্য কিছু...।
তুমি এত ডিটেলে লক্ষ্য করলে ওর শরীর?
নো ওয়ে, চোখ ফেরানো যায় না। হেসে বলল আভা।
বেদেনীর হাতের ইশারায় যেমন দুলে ওঠে সাপ, তেমনি এক দুলে ওঠার ছবি যেন দেখতে পেল সে কামালের চোখে। সাপের জিহ্বার মতো কী লকলক করে উঠল লোভ!
খেলার এই পর্বটা এখানে শেষ করল আভা। বাকি খেলায় তার ভূমিকা শুধুই দর্শকের।
প্রলুব্ধ করার চেষ্টায় সে কতটা সফল, তা দেখতে পেল পরদিনই। সকালে নাশতার পর মুমু মারমার হাতে এক তাড়া টাকা দিয়ে বেশ বড়সড় একটা ফর্দ ধরিয়ে দিল কামাল। বান্দরবান শহরের বাজার থেকে এসব মালপত্তর কিনে আনতে হবে। যাওয়া-আসাসহ কম করে হলেও ঘণ্টা দু-তিনেক লেগে যাবে লোকটার ফিরতে।
আভা ফুরফুরে মেজাজে ঘুরছে টিলার প্রান্তে। ওপারের পাহাড়গুলো এখন সূর্যের আলোয় নানা স্তরের সবুজ রঙে বিভক্ত হয়ে আছে। অনেক দূরে নদীর রেখাটাও দৃশ্যমান এখন। পাখির তীব্র শিসে মাঝে মাঝে ভাঙছে পাহাড়ি নীরবতা।
ফারজানার কামরাটার দিকে যাওয়া যায় এবার। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল না, একবার টোকা দেবে ভেবে ঠেলে খুলল একটা পাল্লা। মেয়েটা স্নানঘরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল বোধ হয়। আভা বলল, তুমি কি ব্যস্ত ফারজানা?
না, তবে এখন আপনার সঙ্গে আলাপ করতে ইচ্ছে করছে না। উদ্ধত ভঙ্গিতে বলল।
অপমানটা গায়ে না মেখে আভা বলল, আলাপ নয়, তোমাকে একটা ইনফরমেশন দিতে এলাম।
অবাক হয়ে তাকাল ফারজানা।
এ বাড়ির পেছন দিকটায় গেছ কখনো?
না।
একবার যাও। গ্যারেজের পাশেই কেয়ারটেকারের থাকার ঘরটায় একবার উঁকি দিয়ে এস।
কেন? ওখানে উঁকি দিতে যাব কেন? প্রচণ্ড বিরক্তি ওর চোখেমুখে।
আভা হাসল, তোমাকে বলেছিলাম না এমনকি তাজমহলটাও যদি নিজের বাড়ি হয় বস্তির ঝুপড়ি ঘর দেখার কৌতূহল মানুষের যায় না। যাও না একবার, দেখ উঁকি দিয়ে। দরজা-জানালা কিংবা ফাঁক-ফোকর কিছু একটা পেয়ে যাবে উঁকি দেওয়ার মতো।
বিস্ময় চেপে রেখে রাগী গলায় ফারজানা বলল, যেতে হয় আপনি যান, আমি যাব না।
হেসে ওর দরজা থেকে ফিরে এল আভা। সে জানে, যাবে না বলেও যাবে ফারজানা।

নিশ্চয় গিয়েছিল। ঘণ্টা খানেক পর ফারজানাকে টিলার প্রান্তে কাঁটাতারের ফেন্সিংয়ের পাশে একা আনমনা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যেন নিশ্চিত হওয়া গেল, কেয়ারটেকারের ঘরে উঁকি দিতে গিয়েছিল সে।
নিঃশব্দ পায়ে তার পাশে এসে দাঁড়াল।
দিনটা আজ খুব সুন্দর, না?
কোনো উত্তর দিল না। দূরে তাকিয়ে ছিল, ফিরল না। এবার সস্নেহে ওর পিঠে একটা হাত রাখল আভা। বলল, হিন্দিতে বলে, ‘বাহাদুর আদমি কা কমজোরি কিসসে হোতা হ্যায় জানতে হো?—আওরতসে।’ সবল পুরুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতার নাম নারী।
এবার একটু ভেঙে পড়ল বোধ হয় মেয়েটা, অদ্ভুত যন্ত্রণাময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, সব পুরুষই কি এ রকম, ম্যাডাম?
অন্তত যাদের সাহস ও সামর্থ্য আছে।
তাই বলে যোগ্যতা আছে এমন কোনো পুরুষকেই ট্রাস্ট করা যাবে না?
আবার হাসল আভা, কে জানে, আমি বা তুমি কি দুনিয়ার সব পুরুষকে চিনি বা জানি ফারজানা? তোমার তো বয়স কম, খুঁজে দেখো, পেয়েও যেতে পারো।