একালের লেখকের কলমে সেকালের রূপকথা

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

সিংহ ও শিয়াল

শিকারের পেছনে ছুটতে ছুটতে এক কঠিন মুহূর্তে বনের রাজা সিংহ খেয়াল করলেন, তিনি বেশ বুড়ো হয়ে গেছেন। গায়ে জোর না থাকায় বহুকাল ধরে রপ্ত করা কৌশলগুলো কোনো কাজে আসছে না। গুহায় ফিরে গিয়ে তিনি ভাবতে বসলেন, কী করা যায়! 

পরদিন বনের পশুরা রাজার তরফ থেকে ঢোল-শোহরত শুনল—মহামান্য রাজা অসুস্থ, সবাই যেন সময়-সুযোগমতো রাজগুহায় গিয়ে তাকে দেখে আসে।

সিংহের গুহায় অনেকেই গেল অসুস্থ রাজাকে দেখতে। 

শিয়াল গুহার কাছে গিয়ে খেয়াল করল, পশুদের পায়ের চিহ্ন একমুখী, গুহার দিকে যাওয়ার পদচিহ্ন আছে, কিন্তু ফিরে আসার চিহ্ন নেই। সে গুহার ভেতর ঢুকল না।

পরদিন শিয়াল পথসভা ডাকল। সেখানে সিংহের ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে দিয়ে সবাইকে সে অনুরোধ করল, কেউ যেন রাজগুহায় না ঢোকে এবং নিজের নিজের প্রাণরক্ষায় সতর্ক থাকে।

সবাই শিয়ালের কথা শুনল ঠিকই, কিন্তু তাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হলো নানা রকমের। শিয়ালের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যাদের বিরোধ চলছিল, যেমন মেছো বাঘ, তারা এই ষড়যন্ত্রের কথা অবিশ্বাসের সঙ্গে উড়িয়ে দিল। আরও কেউ কেউ শিয়ালকে অবিশ্বাস করল। যেমন বনকুকুর। তারা ভাবল, শিয়াল রাজার বিরুদ্ধে বনের পশুদের খেপিয়ে তুলতে চাইছে, হয়তো তার মনে কোনো রাজনীতি-বাসনা আছে। 

পথসভার কথা যখন বাঘের কানে পৌঁছাল, বাঘ শিয়ালের কথা বিশ্বাস করল। বনের শান্তিপ্রিয় তৃণভোজী পশু, যেমন হরিণ, মহিষ ও জেব্রা, সিংহের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোকে মানতে পারল না। তারা চায় না শিয়ালের কারণে বনের রাজা তাদের ওপর অসন্তুষ্ট হোক কিংবা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠুক। তারা চিরন্তন নিয়মের ভেতর নিজেদের ভাগ্যের চাকা ঘুরতে দেখে এবং পরমের মহিমাকে পূর্ণতর হতে দেখে বা না-দেখেও সব সময় চায় সুখী হতে। 

বিচক্ষণ পশুদের দু-একজন মন্তব্য করল, ‘শিয়ালের কথা সত্য হতেও পারে, তবে তাকে বিশ্বাস করা মুশকিল।’ যেকোনো গুজবে কান দেয় এমন অতি সতর্ক ও বিশ্বাসপ্রবণ পশুদের কেউই শিয়ালের সভার পর সিংহের গুহার ধারেকাছে গেল না। কৌতূহলী, সরেজমিন তদন্তে উৎসাহী এবং দৃষ্টবাদী পশুদের কেউ কেউ সিংহের গুহার কাছে গিয়ে দেখল, সত্যিই গুহায় ঢোকা পশুদের ফিরে আসার পদচিহ্ন নেই। প্রমাণ ছাড়া কিছুতেই শিয়ালের কথা বিশ্বাস করবে না, এমন কট্টরপন্থী এক পশু, উদবিড়াল, সিংহের গুহায় ঢুকে আর ফিরল না। 

এসব ঘটনার পর পশুদের অনেকেই সতর্ক হলো, তবে অন্যদের সতর্ক করার কথা ভাবল না। কেউ কেউ অবশ্য গল্পচ্ছলে তাদের আশঙ্কার কথা প্রতিবেশীদের জানাতে থাকল। 

দিনে দিনে শিয়ালের কথা ছড়িয়ে গেল বনের আনাচকানাচে। সিংহকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে এমন পশুরা শিয়ালের দাবিকে উড়িয়ে দিলেও বিচক্ষণ দু-একজন শুরু থেকেই ধরে নিয়েছিল, রাজকীয় ব্যাপারে এমন কারসাজি থাকা অসম্ভব নয়। অবশ্য বিশেষজ্ঞ এবং গবেষকদের মধ্যে যারা রাজভক্ত তারা প্রচার করল, এমন ভান করা বা ফন্দি আঁটা সিংহ-স্বভাবের সঙ্গে যায় না। কাজেই, এটা গুজব। শিয়াল বনে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। 

রাজ-আনুকূল্য পাওয়া কিছু পশু—যেমন সাদা বানর, যারা বুদ্ধিজীবী ও পরামর্শক, প্রচার করল, ‘এটা ঠিক যে পশুদের ফিরে আসার পদচিহ্ন নেই। কিন্তু নেই যে তার কারণ, শিয়াল নিজেই চিহ্নগুলো মুছে দিয়েছে। এর পেছনে শিয়ালের কোনো বাসনা থাকতে পারে।’ 

চিতাবাঘদের মধ্যে যাদের ওপর সিংহের প্রভাব বেশি, তারা শিয়ালের প্রচারণাকে নিষ্ক্রিয় করতে পাল্টা প্রচারণা শুরু করল। শুধু রাজক্ষমতার ওপর আস্থা না থাকা নিম্নবর্গরা শিয়ালের কথা শতভাগ বিশ্বাস করে গেল। নানা পক্ষের তৎপরতায় বনজুড়ে ক্রমশ অস্থিরতা চরমে উঠল। 

এদিকে রাজ-অনুচরেরা দিনে দিনে সব কথাই সিংহের কানে পৌঁছে দিচ্ছিল। 

এক ভোরবেলা পূর্বঘোষণা অনুযায়ী সিংহ তার গুহা থেকে বেরিয়ে এলো। কণ্ঠে কিছুটা গাম্ভীর্য এনে বলতে শুরু করলো, ‘সুপ্রভাত! প্রিয় অরণ্যবাসী, আমি সুস্থ হয়ে উঠেছি। এখন থেকে আমার সুস্থ থাকার নিয়মেই বনের কর্মকাণ্ড চলবে...।’ 

সোনার ইঁদুর

আনন্দের বাবা ছিলেন এক গন্ধবণিক। আনন্দ মায়ের গর্ভে থাকার সময় তিনি মারা যান। 

মা অতিকষ্টে তাকে লালন-পালন করেন। 

একদিন টোলের পণ্ডিত আনন্দকে বললেন, ‘বিষ্ণুপুর যাও। সেখানে সোমদেব নামে এক ধনী বণিক আছে। সে তোমাকে ব্যবসাবুদ্ধি দেবে।’

আনন্দ সেই বণিকের বাড়িতে গেল। বণিক বাড়িতেই ছিলেন। গোলাঘরে ইঁদুর বেড়ে যাওয়ায় ছেলেকে নিয়ে ইঁদুর তাড়া করছিলেন। 

বণিকবাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে আনন্দ দেখল, সোমদেবের এক হাতে ঝাড়ু আর অন্য হাতে একটা মরা ইঁদুর। তিনি নিজের ছেলেকে তিরস্কার করে বলছেন, ‘শোনো, নিষ্ঠা থাকলে যে কেউ এই মরা ইঁদুর দিয়েও ধনসম্পদ বানাতে পারে।’

আনন্দ বণিকের কাছ থেকে মরা ইঁদুরটা চেয়ে নিল। 

সে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবল, এই মরা ইঁদুর দিয়ে কী করে ধনসম্পদ বানানো যায়! 

ইঁদুরটাকে সে কাজে লাগানোর কথা ভাবল, কিন্তু এটা দিয়ে কী করবে সে? 

কিছুই ভেবে না পেয়ে আনন্দ এক গৃহস্থের বাড়ি গেল, যিনি বিড়াল পোষেন। মরা ইঁদুরটাকে সে বিড়ালের সামনে দিল। গৃহস্থ খুশি হয়ে তাকে দুমুঠো ছোলা দিলেন। 

আনন্দ বাড়ি গিয়ে সেই ছোলা সেদ্ধ করল। তারপর একটা পরিষ্কার পাত্রে নিয়ে এক জগ পানিসহ বসল রাস্তার ধারে। এক কাঠুরে বন থেকে ফেরার পথে ছোলা খেয়ে তাকে কিছু কাঠ দিলেন। 

আনন্দ কাঠ বিক্রি করে আরও কিছু ছোলা কিনল এবং কাঠুরেদের কাছে সেদ্ধ ছোলা বেচে বেশ কিছু কাঠ পেল। 

এভাবে কাঠ বিক্রি করে টাকা জমিয়ে সে একটা ছোট দোকান দিল। 

ছোট দোকান ধীরে ধীরে বড় হলো। 

এবার আনন্দ একটা নৌকা কিনল। একজন কর্মচারীকে নিয়ে সে বিভিন্ন শহর-নগরে যায় এবং মসলা কেনাবেচা করে। ব্যবসা বাড়তে থাকে। 

কয়েক বছর পর আনন্দ হয়ে উঠল বড় এক গন্ধবণিক। 

একদিন সে একটা সোনার ইঁদুর গড়ল এক স্বর্ণকারকে দিয়ে। তারপর বিষ্ণুপুর গেল বণিক সোমদেবের কাছে। 

গিয়ে দেখল বৃদ্ধ বণিক তার ছেলেকে নিয়ে আক্ষেপ করছেন। আনন্দ তার হাতে সোনার ইঁদুরটা দিয়ে বলল, ‘আপনার জন্য এই উপহার।’

‘কেন?’

‘আপনি আমাকে একটা মরা ইঁদুর দিয়েছিলেন।’

‘মরা ইঁদুর?’

‘হ্যাঁ। বলেছিলেন একটা মরা ইঁদুর দিয়েও ধনসম্পদ বানানো যায়, যদি নিষ্ঠা থাকে।’ 

‘তোমাকে বলেছিলাম?’

‘না, আপনার ছেলেকে বলেছিলেন। তবে কথাটা আমি বিশ্বাস করেছিলাম।’ 

কুলক্ষুণে

একদিন বিক্রমণিপুরের রাজার কাছে গ্রামের কিছু লোক গিয়ে অভিযোগ করল, তাদের গ্রামে শালিবাহন নামে এক তেলি আছে, সে কুলক্ষুণে। গ্রামবাসীর যে কেউ তার মুখ দেখলে বিপদগ্রস্ত হয়। এসব কথা বলে এবং নিজেদের দুঃখ-দুর্দশার কথা জানিয়ে রাজার কাছে তারা শালিবাহনের শাস্তি দাবি করল। 

রাজা শালিবাহনকে ধরে আনতে বললেন। সেপাইরা তাকে গ্রেপ্তার করে কয়েদখানায় রাখল। 

রাজা পরীক্ষা করে দেখতে চাইলেন, লোকটা আসলেই কুলক্ষণে কি না। তিনি পরদিন ভোরবেলা গিয়ে তার মুখ দেখলেন। লোকটার বিষণ্ন মুখ দেখে তিনি চমকে উঠলেন। একটা অমঙ্গলের আশঙ্কায় তার মন ভরে উঠল উদ্বেগে। কিছুটা আনমনা হয়ে পড়লেন রাজা। 

সেদিন অন্যমনস্কভাবে রথে উঠতে গিয়ে রাজা পা পিছলে পড়ে গেলেন এবং তার পা মচকে গেল। 

রাজা বিশ্বাস করলেন, লোকটা আসলেই কুলক্ষণে। বিকেলবেলা তিনি শালিবাহনের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করলেন। 

মন্ত্রী উদ্বিগ্ন হয়ে রাজাকে বললেন, ‘নিরপরাধ লোকটাকে শাস্তি দেবেন?’

রাজা বললেন, ‘তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য। তার মুখ দেখে বেরোনোর পরই আজকে আমার পা মচকে গেছে।’

মন্ত্রী বললেন, ‘রাজামশাই, আমি শুনেছি লোকটা নিজেও দুর্দশাগ্রস্ত।’

‘তাতে কী হয়েছে?’

‘মানে আমি ওর দুর্দশার কারণ নিয়ে ভাবছিলাম।’

‘কী কারণ?’

‘লোকটা নিজেও প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে গ্রামের লোকদেরই দেখে।’

‘তাই দেখে নিশ্চয়,’ রাজা বললেন। 

‘আর আজকে ভোরবেলা সে প্রথমে যার মুখ দেখেছে, সেটা হলেন আপনি এবং আজকেই তার মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হলো।’ 

মন্ত্রীর কথা শুনে রাজার মুখে অন্ধকার নামল। তিনি তড়িঘড়ি করে রাজদরবারে গেলেন এবং হাতে কিছু স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে শালিবাহনকে মুক্ত করে দিলেন।