বাংলা প্রবাদের মধ্যে যেভাবে লুকিয়ে আছে সমাজ–ইতিহাস

মুখের কথায় প্রবাদের স্ফূর্তি। বাংলা প্রবাদও তা–ই। প্রবাদগুলো অতীত ইতিহাস ও পরিবর্তিত সমাজের সাক্ষ্য দেয়। প্রবাদের মধ্যে কেমনভাবে লুকিয়ে আছে সমাজ–ইতিহাস?

নৃত্যলাল দত্তের কাঠখোদাই ‘ময়না’
ছবিটি শ্রীপান্থর লেখা বই বটতলার সৌজন্যে

চাল থেকে যে মুড়ি হয়, তার সঙ্গে সম্পর্ক আছে ‘মুড়মুড়’ শব্দের। ভেজানো চাল শুকিয়ে নিয়ে গরম বালুতে ঢাললে মুড়মুড় শব্দ করে মুড়িতে পরিণত হয়। আর গরম বালুতে ধান রেখে কাঠি দিয়ে নাড়া দিলে পটপট করে খই ফুটতে থাকে। কারও মুখ থেকে পটপট করে কথা বের হতে থাকলে তাই বলা হয় ‘মুখে যেন খই ফুটেছে’। খইয়ে গুড় মাখিয়ে বানানো হয় মুড়কি। মুড়কি নামকরণের সঙ্গে গুড় দিয়ে মোড়ানোর সম্পর্ক আছে কি না, কে জানে। তবে এই মুড়ি আর মুড়কি মিলিয়ে একটা প্রবাদ তৈরি হয়েছে। সমাজে সাধারণ আর জ্ঞানীগুণী লোকের মধ্যে যখন কোনো পার্থক্য করা হয় না, তখন আফসোস করে বলা হয়, ‘এই বাজারে মুড়ি-মুড়কির একদর’! আসলেই তো, সাদা মুড়ি আর গুড় মাখানো খইয়ের দর এক হতে পারে না।

ভাষায় শব্দের অর্থ নির্ভর করে বাক্যে প্রয়োগের ওপর। তবে অভিধানে শব্দের অর্থের যেসব ব্যাখ্যা থাকে, সেগুলো পুরোপুরি প্রামাণ্য না–ও হতে পারে। যেমন ‘মুড়ি’ শব্দের নামকরণের পেছনে ‘মুড়মুড়’ শব্দের যৌক্তিকতা নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলতেই পারি। কিন্তু বাক্যে ব্যবহৃত বাগ্​ধারা বা প্রবাদগুলোর অর্থ খুবই যৌক্তিক ও কার্যকারণযুক্ত হয়। বাগ্​ধারার ক্ষেত্রে শব্দগুচ্ছ, আর প্রবাদের ক্ষেত্রে বাক্যাংশ সাধারণ অর্থকে ছাপিয়ে বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে। যেমন ‘চিনির পুতুল’ বাগ্​ধারা দিয়ে কোনো পুতুল বোঝায় না, বোঝায় বিশেষ ধরনের মানুষকে। আবার ‘ঘুঁটে পোড়ে, গোবর হাসে’—এই প্রবাদ দিয়ে বোঝানো হয়, অন্যের বিপদে খুশি হওয়ার কারণ নেই, খুব দ্রুতই একই রকম পরিণতি নিজের জীবনেও ঘটতে পারে। 

প্রবাদগুলো একটি ক্ষেত্রে বাগ্​ধারার চেয়ে বেশি শক্তি রাখে। প্রবাদগুলো অতীত ইতিহাস ও পরিবর্তিত সমাজের সাক্ষ্য দেয়। এগুলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকে মানুষের দীর্ঘদিনের জীবন-অভিজ্ঞতা ও জীবন-দর্শন। ইতিহাস, বিশ্বাস, নীতি, অভিজ্ঞতা ইত্যাদির স্পষ্ট স্বাক্ষর থাকে প্রবাদে। মুখের কথায় প্রবাদের স্ফূর্তি। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনে এরা চেহারা বদল করে নেয়। ফলে ভাষায় এগুলো বেশ মানিয়ে যায়। প্রবাদের ব্যবহারে ভাষার প্রকাশক্ষমতাও বাড়ে। প্রবাদের শক্তি এর তির্যক বাক্ভঙ্গির কারণে। ‘আমি কি তোমার পাকা ধানে মই দিয়েছি যে তুমি আমার বাড়া ভাতে ছাই দিলে?’—বেশির ভাগ প্রবাদই এ রকম কণ্ঠস্বরের ওঠানামা ঘটিয়ে উচ্চারণ করতে হয়।

প্রবাদ যেহেতু মুখের কথা থেকে জন্মলাভ করে, সেহেতু এর মধ্যে আঞ্চলিক ভাষার ছাপ থাকে; যেমন ‘বেহা মুহে পিডা খায়, নাহে মুহে বিষুম খায়’। অর্থাৎ বাঁকা মুখে পিঠা খেলে নাকে-মুখে বিষম খেতে হয়। তবে প্রবাদের অর্থ এভাবে সাধারণভাবে নিলে হয় না। এর অন্তর্নিহিত অর্থটাই মুখ্য, ‘অযোগ্য লোক কোনো কাজ ঠিকমতো করতে পারে না।’ প্রবাদের মাধ্যমে প্রতিযোগী বা শত্রুকে খোঁচা দেওয়া যায়; যেমন ‘নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা’, ‘খালি কলসি বাজে বেশি’, ‘অতিচালাকের গলায় দড়ি’। কোনো কোনো প্রবাদ তো রীতিমতো নিজের শক্তির দম্ভ প্রকাশ করে, ‘ওস্তাদের মার শেষ রাতে’, ‘সোজা আঙুলে ঘি ওঠে না’—এগুলো এ–জাতীয় প্রবাদ।

যে প্রবাদের জন্ম মানুষের মুখে, সেই প্রবাদ জায়গা করে নেয় লিখিত সাহিত্যেও। হাজার বছর আগে ভুসুকপা লিখেছেন, ‘আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী’। প্রাচীন যুগের চর্যাপদ–এ এ রকম আরও প্রবাদ আছে। মধ্যযুগের আদি নিদর্শন বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন–এ আছে, ‘ললাট লিখন খণ্ডন না যায়’। মধ্যযুগের মধ্যভাগে মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল–এ আছে, পিপীড়ার পাখা ওঠে মরিবার তরে’। মধ্যযুগের শেষভাগে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর অন্নদামঙ্গল–এ লিখেছেন, ‘হাভাতে যদ্যপি চায়, সাগর শুকায়ে যায়’ কিংবা ‘বড়র পিরীতি বালির বাঁধে’র মতো অনেকগুলো প্রবাদ। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক যুগের বিভিন্ন পর্যায়ে এ রকম অজস্র প্রবাদ ছড়িয়ে আছে। কালের পরিক্রমায় অনেক প্রবাদ হারিয়েও গেছে। 

প্রবাদের গুরুত্ব উপলব্ধি করে দেশে দেশে এগুলো সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইউরোপে খ্রিষ্টীয় বারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে প্রবাদ সংগ্রহের ইতিহাস পাওয়া যায়। তবে লোকগান, লোকগল্প, লোকছড়া কিংবা লোকসাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো প্রবাদ সংগ্রহের ইতিহাস মূলত আধুনিক যুগের। আইরিশ পাদরি জেমস লং ১৮৫১ সালে বেঙ্গলি প্রোভার্বস নামে একটি প্রবাদ-সংকলন প্রকাশ করেন। দীনবন্ধু মিত্রের নীল-দর্পণ (১৮৬০) নাটকের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে জেমস লং বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছিলেন ওই সময়ে। আধুনিক যুগের ওই নাটকের সংলাপেও প্রচুর প্রবাদ আছে। জেমস লংয়ের ২১ পৃষ্ঠার প্রবাদ-সংকলনে ১৭৬টি প্রবাদ ও সেগুলোর ব্যাখ্যা ছিল। ১৮৬৮ সালে তিনি প্রবাদ-মালা নামে আরেকটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন, যেখানে ২ হাজার ৩৫৪টি প্রবাদ সংকলিত হয়। ইংরেজি ‘প্রোভার্ব’ শব্দের বাংলা ‘প্রবাদ’ শব্দটিও জেমস লংয়ের দেওয়া। 

পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় সংগৃহীত প্রবাদের শ্রেণীকরণে ‘বিষয়’কে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাংলা প্রবাদে বিষয় হিসেবে পাওয়া যায়—কাক, কলা, গরু, গাধা, মাছ, মই, ভাত, ভূতসহ অনেক কিছু। এর মধ্যে ‘চোর’ বিষয়ে প্রবাদ একেবারে কম নয়: ‘চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনি’, ‘অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ’, ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’, ‘চোরের মার বড় গলা’, ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’ ইত্যাদি। আবার ‘কুকুর’ নিয়েও অনেক প্রবাদ আছে—‘কুকুরের পেটে ঘি সয় না’, ‘কুকুরের লেজ সোজা হয় না’, ‘যেমন কুকুর তেমন মুগুর’, ‘মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল’ ইত্যাদি। 

প্রবাদ সংগ্রহের গুরুত্ব মানুষ উপলব্ধি করেছে; কারণ এগুলোর মধ্য দিয়ে ইতিহাস ও সময়ের বদল বেশ ভালোভাবে ধরা পড়ে। চোখে দেখা সমাজের অনেক বাস্তবতা প্রবাদে প্রতিফলিত হয়; যেমন, ‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল’, ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা’, ‘ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না’ ইত্যাদি। তবে প্রবাদ কোনো কোনো সময়ে ভুল ধারণা তৈরি করতে পারে। যেমন, ‘দুধ-কলা দিয়ে কালসাপ পোষা’ প্রবাদ শুনে মনে হতে পারে সাপ দুধ খায়। নাটক-সিনেমাতেও সাপকে দুধ খেতে দেখা যায়; কিন্তু বাস্তবে এমনটি ঘটে না।

প্রবাদের মধ্যে ইতিহাস প্রচ্ছন্ন থাকে। যেমন ‘পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে’—এই প্রবাদটির সাধারণ অর্থ, নাছোড়বান্দা কারও পাল্লায় পড়ে ঝক্কি পোহানো। মোগলদের হাতে পড়লে এবং খানা খাওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলে ঝক্কি পোহাতেই হবে। কারণ, তাদের খাদ্যতালিকায় ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ হরেক পদ। একে একে সেসব পদের সব কটি খাওয়া মানে শাস্তি ভোগ করা। আবার ‘কোম্পানির মাল দরিয়া মে ঢাল’—এখান থেকে বোঝা যায়, একসময়ে এ অঞ্চলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন ছিল। 

ইতিহাসের পাশাপাশি পুরাণ ও ধর্ম প্রসঙ্গও প্রবাদে জায়গা করে নেয়; যেমন ‘অতি দর্পে হত লঙ্কা’, ‘চেনা বামুনের পৈতা লাগে না’, ‘মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত’ ইত্যাদি। প্রবাদের মধ্যে যে জীবন-দর্শন ও জীবন-অভিজ্ঞতা থাকে, তার শক্তিও কম নয়। যেমন ‘চকচক করলেই সোনা হয় না’, ‘কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোনো’, ‘কয়লা ধুলে ময়লা যায় না’, ‘ঘুঘু দেখেছ ফাঁদ দেখোনি’, ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’, ‘কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশ’, ‘মশা মারতে কামান দাগা’, ‘এক হাতে তালি বাজে না’, ‘সাপের পাঁচ পা দেখা’, ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’ ইত্যাদি।

প্রায়ই কার্যকারণের ওপর ভিত্তি করে কিছু প্রবাদ তৈরি হয়। যেমন ‘পেটে খেলে পিঠে সয়’, ‘কান টানলে মাথা আসে’। আবার বিপরীত ফলের প্রবাদও দেখা যায়। যেমন ‘সুখে থাকলে ভূতে কিলায়’, কিংবা ‘টকের ভয়ে দেশ ছেড়ে তেঁতুলতলায় বাস’। পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় একই রকম প্রবাদ থাকতে পারে। যেমন ‘মেনি আ লিটল মেকস আ মিকেল’—এই ইংরেজি প্রবাদটির মতো বাংলাতেও প্রবাদ আছে, ‘তিলকে তাল করা’। আবার কোনো কোনো প্রবাদের পেছনে লুকিয়ে থাকে গল্প; যেমন ‘বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?’, কিংবা ‘অতি লোভে তাঁতি নষ্ট’। 

প্রবাদে ইতিহাস-কার্যকারণ-গল্প যা–ই থাক, প্রয়োগের সময়ে প্রতিফলিত অর্থটাই মুখ্য হয়। যেমন নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনা বোঝাতে ব্যবহার করা হয় ‘আপন পায়ে কুড়াল মারা’; একই সঙ্গে দুই উদ্দেশ্য পূরণের ক্ষেত্রে বলা হয় ‘রথ দেখা আর কলা বেচা’; বড় কাউকে পাশ কাটিয়ে কাজ করার চেষ্টা করা হলে বলা হয় ‘ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া’; অসৎ উপায়ে পাওয়া অর্থ অকাজে নষ্ট হলে বলা হয় ‘লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায়’। 

তবে প্রবাদ এক জায়গায় থেমে থাকে না। সময়ের বদলে বদল হয় বিভিন্ন উপকরণের এবং মানুষের চিন্তার। দূর অতীতে লেনদেনের ক্ষেত্রে কড়ি ব্যবহৃত হতো। তখনকার সময়ে জন্ম নিয়েছে ‘কড়িতে বাঘের দুধ মেলে’, ‘ফেল কড়ি, মাখো তেল’—এসব প্রবাদ। পরবর্তী সময়ে আনা-পাই মুদ্রা হিসেবে আসে। তখন ‘ষোলো আনা বুঝে নেওয়া’, ‘ফুটো পয়সা দাম নেই’—এই জাতীয় প্রবাদ তৈরি হয়। আজ ‘টাকা’র আমলে প্রবাদ দাঁড়িয়েছে, ‘লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন’, ‘ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা’। 

এ যুগেও কিছু প্রবাদ চিহ্নিত করা যায়, যেগুলো অদূর ভবিষ্যতে ভাষার প্রয়োগ থেকে হারিয়ে যেতে পারে, কিংবা পরিবর্তিত হতে পারে। ‘বামন গেল ঘর, লাঙল তুলে ধর’, ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’, ‘নিজের চরকায় তেল দাও’—এগুলো এ ধরনের কয়েকটি প্রবাদ। কারণ, বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে লাঙল, ঢেঁকি, চরকা এগুলোর পুরোপুরি বিলুপ্তি ঘটবে। ধারণা করা যায়, তখন এ ধরনের প্রবাদও হারিয়ে যাবে, কিংবা ইতিহাসের সাক্ষী হবে।

মুখে মুখে ফেরা প্রবাদগুলো

এক মাঘে শীত যায় না 

অর্থ: প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ কখনো হারায় না, বিপদ শুধু একবারই আসে না

আঙুর ফল টক

অর্থ: ব্যর্থ হয়ে নিজেকে মিথ্যা প্রবোধ দেওয়া

আমও গেল ছালাও গেল

অর্থ: লাভ করতে গিয়ে সবই হারানো

ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়

অর্থ: কারও ক্ষতি করলে পাল্টা বিপদ আসে

শূন্য বনে শিয়াল রাজা

অর্থ: যোগ্য লোকের অভাবে অযোগ্যের সুযোগ লাভ