মুক্তিযুদ্ধের অজানা অধ্যায়

মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী। ছবি: সংগৃহীত

৯৭১ সালের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত ‘শিলিগুড়ি সম্মেলন’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য ছিল একটি নির্ধারক ঘটনা। এ সভায় গৃহীত নীতিমালা ও সিদ্ধান্তের আলোকে পরিচালিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের মূলস্রোত। তবে দীর্ঘদিন এ সম্মেলন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা সম্ভব হয়নি। ২০২২ সালে এ সম্মেলন নিয়ে কিছু ইংরেজি দলিল প্রথম আলোর হাতে আসে। ২০২২-এর আগস্টে দলিলগুলোর অবিকল পাঠ নিয়ে প্রথমা প্রকাশ করে 1971: The Siliguri Conference। বইটির সম্পাদনা করেন মতিউর রহমান।

প্রকাশের পর পাঠকমহল থেকে তাগিদ আসতে থাকে বইটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশের। মেজর (অব.) নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ বইটি অনুবাদের দায়িত্ব নেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হামলার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থানীয়ভাবে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছাড়াই এই প্রতিরোধযুদ্ধে হানাদার বাহিনী কার্যত কোণঠাসা হয়ে পড়ে। হানাদার বাহিনীর প্রথম আঘাতের পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আত্মগোপন করেন। হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা বিভিন্ন পথে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। এভাবেই কোনো সরকার গঠন ছাড়াই স্বাধীনতাযুদ্ধের সূত্রপাত হয়।

৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আস্থাভাজন ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সহযোগিতা চান। আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে তাজউদ্দীন আহমদ ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি এবং নিজেকে প্রধানমন্ত্রী নির্ধারণ করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে নিয়ে প্রবাসী সরকার গঠন করেন। এ ছাড়া জাতীয় পরিষদের সদস্য ও জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা কর্নেল এম এ জি ওসমানী মন্ত্রীর পদমর্যাদায় মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি পদে নিয়োজিত হন। ১৭ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা মুজিবনগরে শপথ গ্রহণ করেন।

বাস্তবতার কারণে অথবা ঘটনার আকস্মিকতায় প্রবাসী সরকার গঠনপ্রক্রিয়ায় তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি বা জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত সদস্যদের মতামত গ্রহণ করেননি। ফলে শুরু থেকেই তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রিত্ব ও নবগঠিত সরকার নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। বিরোধিতার পাশাপাশি নেতারা নিজেদের মধ্যেও কোন্দল ও উপদলীয় বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগের অধিকাংশ সদস্য আশা করেছিলেন যে সরকার তাঁদের পরামর্শে চলবে। এ চাহিদা পূরণ না হওয়ায় তাঁরা ক্ষুব্ধ হন। সরকার গঠনের পর প্রায় দুই মাস গত হয়ে গেলেও যুদ্ধে গতির সঞ্চার হলো না। প্রাথমিক বিজয়ও ধরে রাখা সম্ভব হলো না। বরং মুক্তিযোদ্ধারা সর্বত্র পিছিয়ে পড়তে থাকল। মুক্তিযুদ্ধের এ স্থবিরতা সবার মধ্যেই হতাশার জন্ম দেয়।

১০ জুন ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব অশোক কে রায় তাজউদ্দীন আহমদকে খুব শিগগির নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সম্মেলনের প্রস্তাব করেন। তিনি প্রথমে ১৯ জুন মেঘালয় রাজ্যের তুরায় এই সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তাব করেন। তাজউদ্দীন আহমদের সম্মতি থাকলেও এত অল্প সময়ের মধ্যে সবাইকে জড়ো করার অসুবিধা বিবেচনা করে সম্মেলন পিছিয়ে ৫ ও ৬ জুলাই তারিখে হিমালয়ের পাদদেশ শিলিগুড়ির জঙ্গলে নির্ধারণ করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধ

১৯৭১: শিলিগুড়ি সম্মেলন বইটিতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এমন এক সম্মেলনের কথা, যা এ যুদ্ধকে দিয়েছিল পরিকল্পিত সাংগঠনিক কাঠামো ও সংহতি। মতিউর রহমান সম্পাদিত এ বইয়ে ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর তিনটি প্রতিবেদনসহ শিলিগুড়ি সম্মেলনের পূর্বাপর বর্ণনা করে একটি লেখা আছে। সেই লেখা থেকে অংশবিশেষ। বইটি অচিরেই প্রকাশিত হবে।

১৯৭১: শিলিগুড়ি সম্মেলন

সম্পাদক: মতিউর রহমান

অনুবাদ: মেজর (অব.) নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল

দাম: ২৮০ টাকা।

শিলিগুড়ি সম্মেলনের আয়োজক ছিল শিলিগুড়িতে অবস্থিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৩৩ কোর সদর দপ্তর। বিএসএফ সম্মেলনের আবাসন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ছিল। সম্মেলনে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি এবং ১৯৭০ সালে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের প্রায় সবাই সম্মেলনে উপস্থিত হন। উপস্থিত ৩৭৪ পরিষদ সদস্যের মধ্যে ১৩৫ জন ছিলেন জাতীয় পরিষদের সদস্য এবং অন্যরা ছিলেন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য। সম্মেলনে শেখ মণি, আ স ম আবদুর রব, সিরাজুল আলম খানসহ ভিন্নমতাবলম্বী তরুণ নেতারা যোগ দেননি। আওয়ামী লীগের কিছু নেতৃস্থানীয় নেতাও সম্মেলনকালে কলকাতায় থেকে যান। সম্মেলনে পর্যবেক্ষক হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন পদবির বেশ কয়েক সামরিক কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষকের সংখ্যা ছিল চার শতাধিক।

৪ জুলাই সম্মেলনে যোগদানের জন্য সদস্যরা বিমান, রেল ও সড়কপথে মেঘালয়, ত্রিপুরা, উত্তর বাংলা ও কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি শহরে এসে পৌঁছান। শহরে পৌঁছানোর পর তাঁদের বাসে করে শিলিগুড়ির উপকণ্ঠে জঙ্গলের ভেতরে পাহাড়ি নদীর পাশে বিএসএফের শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়। নিরাপত্তার কারণে সম্মেলনের কথা গোপন রাখা হয় এবং আয়োজকেরা পূর্বপ্রচার থেকে বিরত থাকে, এমনকি অংশগ্রহণকারীদেরও সম্মেলনের স্থান ও সময় একেবারে শেষ মুহূর্তে জানানো হয়। সম্মেলনের সংবাদ প্রচার বিষয়ে সর্বোচ্চ গোপনীয়তা বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়। আয়োজকেরা সম্মেলনে আসা সদস্যদের নামের তালিকা প্রণয়ন করেন। তবে সদস্যরা সাধারণভাবে নিজেদের নাম ও পরিচয় দিতে অনীহা প্রকাশ করেছিলেন।

৫ জুলাই সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত গোপন সভা অনুষ্ঠিত হয়। গোপন সভার শুরুতে প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘ বক্তব্য দেন। তিনি স্বাধীনতাযুদ্ধের পটভূমি, আওয়ামী লীগের ইতিহাস, জাতীয় নির্বাচন, পাকিস্তানিদের ক্র্যাকডাউন, যুদ্ধের বর্তমান অবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, সরকারের অনেক দুর্বলতা আছে, সরকার অনেক ভুলও করেছে। তিনি ঐক্যবদ্ধ সরকারের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দেন।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার ওপর জাতীয় পরিষদের সদস্য মিজানুর রহমান চৌধুরী দল ও মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয়, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের মাঠপর্যায়ের সমস্যা তুলে ধরেন। তিনি চলমান সশস্ত্র যুদ্ধকে অধিক গুরুত্ব দেন এবং সশস্ত্র যুদ্ধের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মুক্তিবাহিনীতে কমান্ড বা নেতৃত্বের কাঠামো সন্তোষজনক নয়। যুবশিবিরে যুবকেরা মানবেতর অবস্থায় বাস করছেন। বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে যুবক প্রশিক্ষণের জন্য এলেও সমন্বয়ের অভাবে তাঁরা আবারও অধিকৃত এলাকায় ফিরে যাচ্ছেন। প্রধান সেনাপতি তাঁর বিভিন্ন পয়েন্টের উত্তর দেন। প্রধান সেনাপতি দেশে যুদ্ধ পরিচালনায় কিছু প্রতিবন্ধকতার কথা স্বীকার করেন।

৬ জুলাই সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। উভয় ওয়ার্কিং কমিটির ৩৯ সদস্য সভায় উপস্থিত ছিলেন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভায় দলের সাংগঠনিক বিষয়, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা হয়। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম কামারুজ্জামান সভায় সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন। সভায় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত করা হয় এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নতুন নামকরণ করা হয় ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’।

বক্তাদের আলোচনা শুনে ভারতীয় পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, ওয়ার্কিং কমিটি ও মন্ত্রিপরিষদের মধ্যে বেশ বড় রকমের মতপার্থক্য বিদ্যমান। পুরোনো সদস্যরা রাজনীতি, অর্থনীতি ও রণনীতি বিষয়ে দলের প্রাধান্য রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তবে অধিকাংশের সংসদীয় বিষয়, কার্যসম্পাদনের কূটকৌশল ও যুদ্ধ পরিচালনার জটিল ব্যবস্থা সম্পর্কে খুব কম ধারণা রয়েছে বলে তাঁদের মনে হয়েছে।

শিলিগুড়ি সম্মেলন সফলভাবে সমাপ্তিতে আওয়ামী লীগের মধ্যে নেতৃত্বের কোন্দল ও কলহ আপাতদৃষ্টে শীতল হয়ে যায় এবং দলে ভাঙন এড়ানো সম্ভব হয়। সম্মেলন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর সরকারকে দৃঢ় নৈতিক ভিত্তি প্রদান করে। প্রবাসী সরকার, বিশেষ করে তাজউদ্দীন আহমদের সামনে যে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা দূর হয়। বাহ্যত প্রধানমন্ত্রী-বিরোধীদের যত শক্তিশালী মনে হয়েছিল, বাস্তবে তা ভুল প্রমাণিত হয়। সম্মেলনে সরকার গঠন ও পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান অত্যন্ত দৃঢ় প্রমাণিত হয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের বাকি সময় তাঁকে আর কোনো বড় বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়নি। অপর দিকে সদস্যরা তাঁদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও সন্দেহ সম্মেলনে প্রকাশ করে নিজেদের হালকা করেন। সমালোচনার মাধ্যমে সরকারের অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি প্রকাশ পায়, যা শুধরে নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়া সম্মেলনের সফল পরিসমাপ্তিতে ভারত সরকারও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।

সভার গুরুত্ব বা ফলাফল সম্পর্কে সাপ্তাহিক জয় বাংলা উল্লেখ করে:

...এই বৈঠকের রাজনৈতিক তাৎপর্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। ভাবীকালের ঐতিহাসিকেরা যেদিন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস লিখবেন, সেদিন এই মুজিবনগর বৈঠকের গুরুত্ব তার যথার্থ পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। [জয় বাংলা, ৩০ জুলাই ১৯৭১]।