দু–তিন দিনে পড়ার মতো মুক্তিযুদ্ধের অনবদ্য পাঁচ উপন্যাস

গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি উপন্যাস, যেগুলো পরবর্তী প্রজন্মকে আখ্যানের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার মূল্য সম্পর্কে সচেতন করতে সক্ষম এবং যুদ্ধের অভিঘাত, ত্যাগ ও প্রভাবের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করে।

প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল। গ্রাফিকস: প্রথম আলো

মুক্তিযুদ্ধের বঞ্চনা ও প্রতিরোধের মর্ম অনুধাবন ও সামষ্টিকভাবে জাতীয় চেতনাবোধ প্রজ্বালনে বৃহৎ পরিসরের উপন্যাস পাঠ অত্যন্ত জরুরি। যুদ্ধের ঘটনাশ্রয়ী বড় উপন্যাসগুলো কেবল ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ দেয় না, বরং যুদ্ধের মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা, মানুষের ব্যক্তিগত সংগ্রাম এবং নৈতিক দ্বন্দ্বের সঙ্গে পাঠককে নিবিড়ভাবে পরিচিত করায়। আজ থাকছে যুদ্ধনির্ভর অজস্র লিখিত ভাষ্যের মধ্যে বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি উপন্যাস, যেগুলো পরবর্তী প্রজন্মকে আখ্যানের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার মূল্য সম্পর্কে সচেতন করতে সক্ষম এবং যুদ্ধের অভিঘাত, ত্যাগ ও প্রভাবের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করে।

১. রাইফেল রোটি আওরাত

‘রাইফেল রোটি আওরাত’ আনোয়ার পাশার (১৯২৮-১৯৭১) মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রেক্ষাপটে রচিত একটি কালজয়ী উপন্যাস। ১৮২ পৃষ্ঠার এ উপন্যাসের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত থেকে ২৮ মার্চের ভোর পর্যন্ত মাত্র তিন দিনের ঘটনাবলিকে কেন্দ্র করে। এতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যা ও ধ্বংসলীলার স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে উদগ্র বীভৎসতায়। কেন্দ্রীয় চরিত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সুদীপ্ত শাহীন, যিনি সপরিবার টিচার্স কোয়ার্টারের ২৩ নম্বর ভবনে থাকতেন। চারপাশে সহকর্মী ও ছাত্রদের লাশের স্তূপের মাঝেও সুদীপ্ত শাহীন ও তাঁর পরিবার ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। এই বেঁচে থাকার অপরাধবোধ, ভয়াবহ গণহত্যার চাক্ষুষ বিবরণ এবং নতুন ভোরের প্রতীক্ষাই উপন্যাসটির করুণ আবেদন।

আনোয়ার পাশা (১৯২৮—১৯৭১)

মূলত সুদীপ্ত শাহিন চরিত্রের সঙ্গে লেখকের যুদ্ধকালীন বাস্তবতা ও পরিণতি চরম সাদৃশ্যপূর্ণ। ফলে তাঁর মনোজাগতিক ভাবনায় লেখকের ভয়ার্ত স্মৃতি খুঁজে পাওয়া যায়। উপন্যাসে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. ফজলুর রহমানসহ অসংখ্য বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের মতো ঐতিহাসিক সত্যও উপস্থাপিত হয়েছে। উপন্যাসের নামকরণের মধ্যেই বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর জীবনদর্শন প্রতিফলিত—‘রোটি খেয়ে গায়ের তাকাত বাড়াও, রাইফেল ধরে প্রতিপক্ষকে খতম করো, তারপর আওরাত নিয়ে ফুর্তি করো। ব্যস, এহি জিন্দেগি হ্যায়।’ সুদীপ্ত শাহীন মধ্যবিত্তসুলভ মূল্যবোধ ধারণ করায় সমালোচকেরা তাঁকে দ্রষ্টা হিসেবে দেখেছেন, যিনি বৃহৎ সংগ্রামের উপলব্ধি থেকে দূরে ছিলেন। তবে তাঁর বন্ধু ফিরোজের মতো দেশপ্রেমিক ও কমিউনিস্ট কর্মী বুলার মতো বিপ্লবী চরিত্র গৃহহারা মানুষকে সহায়তা করে স্বাধীনতার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে মি. মালেক, ড. খালেক ও উপাচার্য ওসমান গণির মতো এ দেশীয় শিক্ষিত দালালেরা হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে কাজ করে। সামগ্রিকভাবে আনোয়ার পাশা এ উপন্যাসে অবরুদ্ধ সময়ের রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত, বাঙালির অস্তিত্বের সংকট, প্রতিরোধের প্রস্তুতি সুনিপুণভাবে উঠে এসেছে। ইতিহাসের এই নৃশংসতম অধ্যায়; অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ বস্তুনিষ্ঠ শিল্পরূপে ও তীব্র রাজনৈতিক চেতনার ফল হিসেবে দেখাতে পেরেছেন লেখক। যুদ্ধকালীন বাস্তবতার প্রমাণ্য দলিল হিসেবে যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে উপন্যসটি বিশিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছেছে।

২. যাত্রা

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক শওকত আলীর (১৯৩৬-২০১৮) কালজয়ী উপন্যাস ‘যাত্রা’। ১১২ পৃষ্ঠার এ উপন্যাস মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছর পর ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয়। যুদ্ধ-পরবর্তীকালের এক কঠিন বিরুদ্ধ পরিবেশে প্রকাশিত এ উপন্যাস ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের বর্বরোচিত কালরাত্রির পর ঢাকা শহরে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় ও সাধারণ মানুষের নিরুপায় ‘পলায়ন’-এর ঐতিহাসিক সত্যকে ধারণ করে। কাহিনির মূলে দেখা যায়, ২৫ মার্চের ভয়াবহ হামলার পর ঢাকা শহর ছেড়ে অধ্যাপক রায়হান তাঁর স্ত্রী বিনু ও দুই সন্তানকে নিয়ে বুড়িগঙ্গা নদী ধরে জনস্রোতে মিশে যান এবং অচেনা এক গ্রামের স্কুলঘরে আশ্রয় নেন। এই আদি-অন্তহীন যাত্রাপথে সঙ্গী হন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী লীলা, প্রতিরোধ করতে গিয়ে আহত ছাত্র হাসান, সখিনা, ফার্নান্দেজসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিরা।

শওকত আলী (১৯৩৬—২০১৮)

এই পথপরিক্রমার মধ্য দিয়েই লেখক সেই দুঃসময়ের মানুষের প্রাথমিক বিহ্বলতা এবং পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ‘নৃশংসতা ও নির্মমতার’ প্রত্যক্ষ ভাষ্যচিত্র তুলে ধরেছেন। অধ্যাপক রায়হানের মতো চরিত্রের মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্তের সংকটাপন্ন, দোদুল্যমান চেতনালোক এবং আহত হাসানের মতো চরিত্রের মাধ্যমে প্রতিরোধের প্রাথমিক স্ফুলিঙ্গ ফুটিয়ে তুলেছেন।

উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য হিসেবে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি কেবল ব্যক্তিগত পলায়ন নয়, বরং স্বাধীনতার দিকে একটি জাতির ঐতিহাসিক যাত্রার প্রত্যয়। এটি যুদ্ধের প্রারম্ভিক আঘাত ও প্রত্যাঘাতের সলতে পাকানোর প্রহরগুলো উন্মোচন করেছে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালের বিরুদ্ধ পরিবেশে সংগ্রামী ঘটনাপ্রবাহের পুনরুচ্চারণের সাহসিকতা দেখিয়েছে। চরম অনিশ্চয়তা ও অবরুদ্ধতার মধ্যেও বিজয়ের সুপ্ত স্বপ্নটি তিনি অঙ্কন করেছেন তাঁর নির্মিত চরিত্রের মাধ্যমে, ‘জখম শরীর, এক হাতে রাইফেল, জানালা দিয়ে দেখতে পায় নদীর ওপারে, দিগন্তরেখার কাছে তখনো তুমুল গুলি হচ্ছে, গ্রাম জ্বলছে, হাট জ্বলছে, খামারবাড়ি জ্বলে যাচ্ছে। দুজনেই দেখতে পায় লেলিহান শিখা, ধোঁয়ার কুণ্ডলী এবং আত্মচিৎকারময় আকাশের ওপারে সূর্যোদয় হচ্ছে।’ এভাবেই ‘যাত্রা’ উপন্যাসে নতুন সূর্যের উদয়ের প্রতীক দিয়ে স্বাধীনতার দিকে এক ঐতিহাসিক যাত্রার মানসিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

৩. হাঙর নদী গ্রেনেড

সেলিনা হোসেনের (জন্ম: ১৯৪৭) উল্লেখযোগ্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ (১৯৭৬)। ১৪৪ পৃষ্ঠা কলেবরের এ উপন্যাসে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় যশোরের কালীগঞ্জ গ্রামের এক মায়ের আত্মত্যাগের সত্য ঘটনা চিত্রিত হয়েছে, যা একাত্তরের হাজারো আত্মোৎসর্গের কাহিনির মধ্যে বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। উপন্যাসের পটভূমিতে রয়েছে একটি অতিসাধারণ গ্রাম, যার নাম হলদী গাঁ আর রয়েছে বুড়ি নামের এক নারী; যে এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। বুড়ি এক ছোট্ট মেয়ে, যে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে গ্রামের আর পাঁচটা মেয়ে থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে। তার মন ঘরকন্নার স্বপ্নে আবদ্ধ না থেকে আকাশের পাখি হতে চায়, নদীর মাঝি হতে চায়, দূরদূরান্তে হারিয়ে যেতে চায়। এই অনাস্বাদিত আকাঙ্ক্ষাকে সে তার মনের গহিনেই জিইয়ে রাখে। অল্প বয়েসেই তার বিয়ে হয় দ্বিগুণ বয়সী দোজবর চাচাতো ভাই গফুরের সঙ্গে এবং একই সঙ্গে আগের পক্ষের সলীম-কলীম নামের দুই ছেলেরও মা হতে হয় বুড়িকে।

সেলিনা হোসেন (১৯৪৭)

নিজস্ব সন্তানের জন্য হাহাকার তাকে এক পরিপূর্ণ নারীতে পরিণত করে এবং রইস নামের একটি বোবা ছেলের জন্মের মধ্য দিয়ে তার মাতৃত্বের স্বপ্ন পূরণ হয়। উপন্যাসটির মূল প্রেরণা আসে লেখকের শিক্ষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাফিজের বর্ণনা করা একাত্তরের একটি সত্য ঘটনা থেকে। প্রথমে ছোটগল্প আকারে ১৯৭২ সালে ‘টেরেডাকটিল’ পত্রিকায় ছাপা হলেও এর ব্যাপক গভীরতা উপলব্ধি করে সেলিনা হোসেন ১৯৭৪ সালে এটিকে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস আকারে লেখেন।

আরও পড়ুন

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে হলদী গাঁয়েও এসে লাগে আগুনের হলকা। সলীম-কলীম মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ছুটে যায়, আর বুড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ দেয়। গ্রামে রাজাকার মনসুরের মতো দেশদ্রোহীদের সহযোগিতায় মিলিটারির অত্যাচার বাড়লে, বুড়ির সই নীতা তার কাছে আশ্রয়প্রার্থী হয়। কাহিনির চরম নাটকীয় মুহূর্তে এক রাতে যখন পাকিস্তানি সৈন্যরা তার ঘরে হানা দেয়, তখন বুড়ি এক মহৎ সিদ্ধান্ত নেয়। দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে (কাদের ও হাফিজ) রক্ষা করার প্রয়োজনে সে নিজের প্রাণপ্রতিম, প্রতিবন্ধী সন্তান রইসকে জাগিয়ে তুলে সৈন্যদের হাতে তুলে দেয়। নিজের নাড়িছেঁড়া ধনকে দেশের স্বাধীনতার জন্য অকুতোভয়ে বিসর্জন দেওয়ার এই কাহিনি মনোজগতে গভীরভাবে আলোড়ন তোলে। নিজের সন্তানের চেয়ে দেশের মুক্তি ও সংগ্রামরত সন্তানদের জীবনকে প্রাধান্য দিয়ে বুড়ি যে আত্মত্যাগ করে, তা তাকে নিছক একজন ব্যক্তি থেকে ‘সকলের মা’ করে তোলে। কাদের ও হাফিজের বিদায় নেওয়ার সময় ‘মাগো যাই’ বলে সম্বোধন করা সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তই এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য। লেখিকা উপন্যাসটির সমাপ্তি বিজয়ের মধ্য দিয়ে না টেনে, সংগ্রামের চিরন্তনতার ইঙ্গিত দিয়েছেন। ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যের অন্যতম ধ্রুপদি সৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত।

৪. তালাশ

সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক শাহীন আখতারের (জন্ম ১৯৬২) মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত বহুল আলোচিত উপন্যাস ‘তালাশ’। ২৫৪ পৃষ্ঠার এ উপন্যাস প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালের একুশে বইমেলায়। এ উপন্যাস চিরায়ত বীরত্বের আখ্যানের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বীরাঙ্গনাদের বঞ্চনা ও যুদ্ধোত্তর করুণ ইতিহাস তুলে ধরে।

শাহীন আখতার (১৯৬২)

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মরিয়ম, যে ছিল অবস্থাপন্ন ঘরের শিক্ষিত মেয়ে এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনের শিকার। যুদ্ধ শেষে মরিয়ম স্বাধীন দেশে সম্মানজনক জীবন ‘তালাশ’ করে, কিন্তু সমাজ তাকে আর স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেয়নি। তার পাশাপাশি উঠে আসে অনুরাধা সরকার নামের এক কলেজছাত্রীর চরিত্র, যে বন্দিশালায় থাকার সময় থেকেই যুদ্ধ-পরবর্তী অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সচেতন ছিল। অনুরাধা যুদ্ধ শেষে নিষিদ্ধ পল্লিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। উপন্যাসে মরিয়মের জীবনের মর্মান্তিক বর্ণনা দেন লেখক এভাবে, ‘মরিয়ম হামানদিস্তায় থেঁতলানো দেহ আর কোরবানির মাংসের মতো ভাগে ভাগে বেঁটে দেওয়া জীবন নিয়ে বাঁচে। তারপর এই দেহ আর নিজের থাকেনি। নিজের জীবন আর নিজের হয়নি।’ মরিয়ম ও অনুরাধা ছাড়াও পারুল ও শ্যামলীর মতো অন্যান্য চরিত্রের মাধ্যমে ঔপন্যাসিক দেখিয়েছেন, কীভাবে বীরাঙ্গনাদের জীবন দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এক দুর্বিষহ চক্রের মধ্যে আবর্তিত হয়েছে।

আরও পড়ুন

শাহীন আখতার তাঁর আখ্যানে সেই ঐতিহাসিক সত্যকে প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা দীর্ঘকাল ধরে সমাজের আড়ালে ছিল—মুক্তিযুদ্ধে নারীর ত্যাগের অস্বীকৃতি। উপন্যাসের পটভূমি এই যে যখন পুরুষ মুক্তিযোদ্ধারা বীরের মর্যাদা পাচ্ছেন, তখন নিপীড়িত নারীরা পাচ্ছেন কেবল সামাজিক গঞ্জনা ও লাঞ্ছনা। অনুরাধা চরিত্রটি এই কঠিন বাস্তবতাকে ভবিষ্যদ্বাণীর মতো করে ব্যক্ত করে, যা ঐতিহাসিক সত্যের প্রতিধ্বনি, ‘তুমি ভাবছো স্বাধীন দেশের মানুষ মালা দিয়া আমাদের বরণ করবে? না মেরি, পৃথিবীর ইতিহাসে এমনটা ঘটে নাই। যুদ্ধ শেষে পুরুষেরা হয় বীর, মেয়েরা হয় কলঙ্কিনী।’ সমাজ থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যন্ত কেউই তাঁদের দায়ভার গ্রহণ করেনি। এমনকি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিও সরকারের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে, যেমন পারুল চরিত্রের ক্ষেত্রে দেখা যায়। ‘তালাশ’ একটি যুদ্ধের কাহিনিমাত্র নয়, এটি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সঙ্গে বাস্তবতার নির্মম সংঘাতের দলিল। চিরায়ত পুরুষতান্ত্রিক ন্যারেটিভ থেকে সরে এসে নারীর অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধের একটি অপ্রিয় সত্যকে তুলে ধরেছে। বীরাঙ্গনাদের করুণ পরিণতি ও তাঁদের প্রতি সমাজের ঔদাসীন্যকে ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসের ধারায় এক নতুন ও অপরিহার্য মাত্রা যোগ করা হয়েছে, যেখানে বীরত্বের উল্লাসের চেয়ে বঞ্চনার হাহাকার বেশি স্পষ্ট।

৫. মা

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বাস্তব ঘটনার অবলম্বনে লেখক, নাট্যকার ও সাংবাদিক আনিসুল হক (জন্ম: ১৯৬৫) রচনা করেছেন ‘মা’ উপন্যাসটি। ২৮৮ পৃষ্ঠার এই বই প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালে। এ উপন্যাসের মূল আখ্যান শহীদজননী সাফিয়া বেগম ও তাঁর একমাত্র সন্তান, গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদকে কেন্দ্র করে। আজাদ ছিলেন এক বিত্তশালী পরিবারের সন্তান, কিন্তু বাবার দ্বিতীয় বিয়ের কারণে ইস্পাতকঠিন আত্মমর্যাদাবান মা সাফিয়া বেগম সেই প্রাসাদ ছেড়ে জুরাইনের এক সাধারণ খুপরিঘরে আজাদকে নিয়ে জীবনযুদ্ধ শুরু করেন।

আনিসুল হক (১৯৬৫)

১৯৭১ সালে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ডাক আসে, তখন এমএ শেষ করা আজাদ দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার তাগিদে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মায়ের অসহায়ত্বের কথা মনে পড়লেও বিবেকের তাড়নায় তিনি একদিন মাকে সব খুলে বলেন। মা তাঁকে আশীর্বাদ দিয়ে বিদায় দেন এই বলে, ‘আমি কি তোকে শুধু আমার জন্যই মানুষ করেছি। এ দেশটাও তোর মা। যা দেশটাকে স্বাধীন করে আয়।’ আজাদ ছিলেন ঢাকার দুর্ধর্ষ গেরিলা দল ‘ক্র্যাক প্লাটুন’-এর একজন সদস্য। আগস্ট মাসে তিনি রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। ঐতিহাসিক সত্যের ভিত্তিতে রচিত এই কাহিনিতে দেখানো হয়েছে, হানাদাররা যখন তথ্য জানার জন্য তাঁকে অমানুষিক অত্যাচার করছিল, তখন ছেলের জীবন বাঁচানোর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মা ছুটে যান ছেলেকে আরও দৃঢ় করতে। মা তাঁকে বলেন, ‘বাবা রে, যখন মারবে, তুমি শক্ত হয়ে থেকো। সহ্য করো। কারও নাম যেন বলে দিয়ো না।’ নির্মম নির্যাতনের মধ্যে ভাত না খেতে পাওয়া আজাদের জন্য মা পরদিন ভাত নিয়ে এলেও আজাদ মাকে দেওয়া কথা রেখে শহীদ হন।

আরও পড়ুন

এ উপন্যাস মুক্তিযুদ্ধের এক মর্মস্পর্শী সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত, যা কেবল যুদ্ধের বিবরণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, আত্মত্যাগ, মাতৃত্ব ও মানবসত্তার গভীরতম অনুভূতিকে স্পর্শ করেছে। আজাদ চরিত্রটি তরুণ প্রজন্মের দেশপ্রেমের প্রতীক, আর মা সাফিয়া বেগম, যিনি স্বাধীনতার পরও ১৪ বছর বেঁচেছিলেন এই প্রতীক্ষায় যে ছেলে হয়তো ফিরবে এবং এই দীর্ঘকাল তিনি ছেলের কষ্টের কথা মনে করে কখনো ভাত খাননি বা খাটে ঘুমাননি। কারণ, তাঁর ছেলে মৃত্যুর আগে জেলে মাদুরে শুতেন—এই চরিত্রই হলো বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। সাফিয়া বেগম আমৃত্যু শহীদ আজাদের মা হিসেবেই পরিচিত হতে চেয়েছেন, যা এই উপন্যাসকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক কালজয়ী ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।