অতীতের মানুষ ও ইতিহাস উঠে এসেছে যে বইয়ে

সম্প্রতি প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে মতিউর রহমানের লেখা ‘আকাশভরা সূর্যতারা: কবিতা–গান–শিল্পের ঝরনাধারায়’ বইয়ের তৃতীয় মুদ্রণ। ২০১৪ সালে বইটি প্রকাশের পর এর মধ্যেই দুটি মুদ্রণ শেষ হয়েছে। এই বইয়ে লেখকের স্মৃতিচারণায় অতীত দিনের মানুষজন যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছেন।

‘আকাশভরা সূর্যতারা’ বইয়ের প্রচ্ছদ এবং বইটির লেখক মতিউর রহমানের ছবি অবলম্বনে কোলাজ

মতিউর রহমানের লেখা ‘আকাশভরা সূর্যতারা: কবিতা–গান–শিল্পের ঝরনাধারায়’ বইটি যেন ২৭টি নক্ষত্রে সাজানো একটি আকাশ, যা কালে কালে দীপ্তি ছড়াবে। বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা এবং এর শিল্প–সংস্কৃতির প্রসঙ্গ উঠলেই অনিবার্যভাবে উচ্চারিত হবে কিছু মনীষীর নাম। সে রকম কিছু মানুষের স্মৃতি আর সান্নিধ্যের শিল্পিত বিবরণ রয়েছে এখানে। এই বইয়ের লেখক মতিউর রহমান আশ্চর্য স্মৃতিশক্তিধর এক মানুষ। তিনি চলচ্চিত্রের মতো জীবনের ফ্ল্যাশব্যাকে তুলে ধরেছেন কিছু মানুষের জীবনকথা, যার মাধ্যমে উঠে এসেছে এই ভূখণ্ডের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ইতিহাস–ঐতিহ্য। ২৭ জন সৃজনশীল মানুষের সঙ্গস্মৃতির অনন্য আখ্যান এ বই বাংলা স্মৃতিকথা–সাহিত্যের উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবে।

‘আকাশভরা সূর্যতারা’ বই থেকে সত্যিকারের কিছু তারার আলো যিনি ছড়িয়ে দিলেন, তিনি নিজেও আসলে নিজের দ্যুতিতেই দ্যুতিমান। বাংলা ভাষার সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসেবে দিনের প্রতিটি মুহূর্ত তাঁকে থাকতে হয় কর্মব্যস্ত। সেই তিনিই লিখেছেন প্রায় ৩৫০ পৃষ্ঠার বইটি। কখনো কখনো কারও প্রয়াণে ‘অবিচ্যুয়ারি’ লিখতে গিয়ে তুলে এনেছেন তাঁর জীবনের নানা দিক, কখনো হয়তো কারও স্মৃতিচারণা করেছেন। সাংবাদিকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিকর্মী এবং শিল্প–সাহিত্যসেবী হিসেবে নিজের জীবনের স্মৃতিগুলো কাজে লাগিয়েছেন। বইটি পড়তে পড়তে মনে হলো, সাংবাদিকতা শুধু বর্তমানকে তুলে ধরে না, কিছু কিছু বিশেষ সাংবাদিকতা অতীত, অতীতের মানুষ ও ইতিহাসের ঘটনাকেও উদ্‌ঘাটন করে। এ বইয়ে মতিউর রহমানও তা–ই করেছেন। নতুন প্রজন্মের যাঁরা তাঁকে শুধু প্রথম আলোর সম্পাদক হিসেবে চেনেন, তাঁরাও এই লেখকের বেড়ে ওঠার সময় এবং তাঁর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চেতনার সঙ্গে পরিচিত হবেন বইটির মাধ্যমে।

গেল শতকের ষাট দশকের শুরুতে মাধ্যমিক পড়ালেখা শেষ করে কলেজজীবনে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন প্রথিতযশা সাংবাদিক, লেখক, চিত্রশিল্প সংগ্রাহক মতিউর রহমান। শোষণহীন একটি সমাজ নির্মাণের স্বপ্নে বিভোর সেই সব দিন তাঁর কেটেছে উদ্দীপনার মধ্যে। বইয়ের ভূমিকায় তিনি উল্লেখ করেছেন, বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনের শুরুর দিন থেকে সরাসরি অংশ নিয়েছেন সব রাজনৈতিক কার্যক্রমে। পাশাপাশি নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও। এরই সুবাদে বড় বড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। যুক্ত থেকেছেন নানা সংকলন প্রকাশ আর সেমিনারের সঙ্গে। নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতের সেরা কবি, লেখক, গায়ক ও চিত্রশিল্পীদের। নানা সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে পরিচয়ের মধ্য দিয়ে সেসব প্রিয় ও গুণীজনকে নিয়েই লেখা এ বই।

তিনি চলচ্চিত্রের মতো জীবনের ফ্ল্যাশব্যাকে তুলে ধরেছেন কিছু মানুষের জীবনকথা, যার মাধ্যমে উঠে এসেছে এই ভূখণ্ডের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ইতিহাস–ঐতিহ্য। ২৭ জন সৃজনশীল মানুষের সঙ্গস্মৃতির অনন্য আখ্যান এ বই বাংলা স্মৃতিকথা–সাহিত্যের উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবে।

শুরুতে ‘আকাশভরা সূর্যতারা’ বইটিকে আকাশের সঙ্গে তুলনা করেছিলাম। একসময় রাতের অন্ধকারে কখনো আকাশের দিকে তাকালে মনের ভেতর ধন্দ তৈরি হতো। অযুত–নিযুত তারার মধ্যে নির্দিষ্ট একটির দিকে দৃষ্টি স্থির করা কঠিন। একটু বড় হয়ে দু–একটির বৈশিষ্ট্য কিংবা নাম জেনে সেগুলো খোঁজার চেষ্টা করতাম। এই বইয়ের ২৭ জন তারার মধ্যে সে রকম প্রথমেই বেছে নিয়েছি কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে। তিনি ছিলেন আমাদের তরুণ বয়সের নায়ক, স্বপ্নের আর চেতনার কবি। আমার দুর্বল স্মৃতি আর ক্ষীণ মেধা দিয়ে যে কয়েকটি কবিতা মুখস্ত রেখেছি, তার মধ্যে তাঁর কবিতাই বেশি। সেগুলোর বেশির ভাগের মধ্যে ফুলের অনুষঙ্গ আছে। যেমন ‘প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য...’, ‘ফুল ফুটুক না ফুটক আজ বসন্ত...’, ‘ফুলগুলো সরিয়ে নাও/আমার লাগছে...’, কিংবা ‘ফুলকে দিয়ে মানুষ বড় বেশি মিথ্যে বলায় বলেই ফুলের ওপর কোনো দিনই আমার টান নেই’।

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
ফাইল ছবি

কৈশোরের কোমল বয়সে ফুলের সৌন্দর্য আর কমনীয়তার বিপরীতে দ্বান্দ্বিক কিন্তু নান্দনিক উপস্থাপনায় এক আশ্চর্য নতুন বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে শিখেছিলাম এসব কবিতার মাধ্যমে। খেলাঘর আর ছাত্র ইউনিয়নের বয়সে তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিল ‘প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য’ গানটির মাধ্যমে। পরবর্তীকালে একটু বড় হয়ে আমরা যখন জীবনানন্দে বুঁদ হয়ে ‘সাতটি তারার তিমির’–এর মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছি, তখন অচিরা পাঠচক্রে মোমেন ভাই (কবি আবুল মোমেন) একদিন আমাদের পাঠ করে শোনালেন সুভাষের কবিতা—

‘তারপর যে-তে যে-তে যে-তে
এক নদীর সঙ্গে দেখা।
পায়ে তার ঘুঙুর বাঁধা
পরনে
উড়ু-উড়ু ঢেউয়ের
নীল ঘাগরা।’

এ এক অন্য ভাষা। অন্য ভাবনা। অন্য জগৎ। নতুন বিস্ময়—জীবনানন্দের ভাষায় আমরা বলে উঠি। এর পরপরই মোমেন ভাই পড়ে শোনালেন ‘মেজাজ’ কবিতাটি। এর শেষ দিকের পঙ্‌ক্তিগুলো প্রথমবার শুনেই মনে গেঁথে গেল চিরজীবনের মতো—‘কী নাম দেব, জানো?/আফ্রিকা।/কালো মানুষেরা কী কাণ্ডটাই না করছে সেখানে।’

পৃথিবীটাকে আমরা যেমনভাবে দেখতে চাইতাম, যেভাবে স্বপ্ন দেখতাম, ঠিক তেমন করেই সুভাষ ধরা দিলেন আমাদের কাছে। ঠিক হয়তো এ কারণে আমি প্রথমেই বেছে নিয়েছিলাম সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে। এ রকম পর্ব ভাগ করা এ বইয়ের একটা সুবিধা। শুরু থেকে পড়তে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আবার পুরো বইটা একসঙ্গে পড়া শেষ করতে হবে, তা–ও নয়। সুভাষকে নিয়ে লেখাটির শিরোনাম—‘তিনি তো আমাদেরই লোক’। কবির চিরযাত্রা আর সর্বশেষ লেখার কথা দিয়ে লেখাটির শুরু। এরপর আদ্যোপান্ত একটা সুভাষকে লেখক তুলে এনেছেন সুদীর্ঘ একটা রচনায়। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সব সৃষ্টির উল্লেখ যেমন আছে, তেমনি আছে তাঁর জীবনের সব প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির বিবরণ। লেখক কীভাবে কবির লেখা বই সংগ্রহ করেছেন, কীভাবে তাঁর সঙ্গে পরিচয় ইত্যাদি।

১৯৭৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার হোটেল পূর্বাণীতে সারা রাত সাহিত্য, সংস্কৃতি ও লেখকের সামাজিক দায় নিয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায় যেসব কথাবার্তা বলেছেন, সেই সব কথা লেখক এমনভাবে লিখেছেন যেন এইমাত্র আড্ডার টেবিল থেকে উঠে এলেন তিনি। যেন সুভাষের সুবাস নিলাম, পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখলাম স্বপ্নের কবিকে। তাঁর জীবন–জীবিকা, জীবনের দর্শন, রাজনীতি, সাহিত্য, মনের দ্বৈততা (যেমন রবীন্দ্রনাথ নিয়ে নিজের অবস্থান)—সব মিলে এমন পূর্ণাঙ্গ লেখা আজকাল পাওয়া যায় না। এই ডিজিটাল যুগে সবকিছু যেমন ওপরে ওপরে একটুখানি চোখ ফেলে চলে যায়, কোনো গভীর অনুসন্ধানের অবকাশ নেই, এ বইয়ে কোনো লেখায় সে রকম শব্দের কোনো সীমাবদ্ধতা ছিল না লেখকের। যাঁকে নিয়ে লিখেছেন, তাঁকে নিয়ে নিজের যত স্মৃতি, যত মত ও বিশ্লেষণ আছে, সব উজাড় করে দিয়েছেন। কখনো স্মৃতিকাতর হয়ে, কখনো আবেগতাড়িত হয়ে লিখেছেন। তবে মোহগ্রস্ত হয়ে নয়, বিচার–বিবেচনাবোধ না হারিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন প্রত্যেক মানুষকে। প্রত্যেকের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড, জীবনদর্শন ও মতামতের সন্ধান পাই এ বইয়ে।

শামসুর রাহমান
ফাইল ছবি

শুধু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় নয়, মতিউর রহমানের স্মৃতির উজ্জ্বল আধার থেকে বইয়ে উঠে এসেছেন কবি অরুণ মিত্র; গণসংগীতশিল্পী ও সংগীত পরিচালক আলতাফ মাহমুদ; চিত্রশিল্পী ও শিক্ষক কামরুল হাসান; চিত্রশিল্পী ও লেখক কাইয়ুম চৌধুরী; চিত্রশিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া; গণেশ পাইন; চলচ্চিত্র পরিচালক ও ঔপন্যাসিক জহির রায়হান; ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী নিতুন কুণ্ডু; চিত্রশিল্পী ও লেখক পরিতোষ সেন; কবি ও চিত্রপরিচালক পূর্ণেন্দু পত্রী; চিত্রশিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্য; স্থপতি মাজহারুল ইসলাম; চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর; চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরী; লেখক ও সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্ত; সেতারবাদক, সুরকার ও সংগীত পরিচালক রবিশঙ্কর; সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও ভাষা আন্দোলনের সংগঠক শহীদুল্লা কায়সার; কবি ও সাংবাদিক শামসুর রাহমান; সাংবাদিক ও লেখক সন্তোষ গুপ্ত; কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়; ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী সোমনাথ হোর; দৈনিক ‘সংবাদ’–এর সম্পাদক ও রাজনীতিবিদ আহমদুল কবির; সংগীত সাধক, সাংস্কৃতিক নেতা ও সাংবাদিক ওয়াহিদুল হক; রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী জাহেদুর রহীম; চিত্রশিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী; সাংবাদিক বজলুর রহমান এবং কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। প্রত্যেকের জন্য লেখকের আলাদা শিরোনাম।

আরও পড়ুন

শামসুর রাহমানকে নিয়ে লেখাটির শিরোনাম ‘আলোর পথের যাত্রী’। শামসুর রাহমানের সঙ্গে লেখকের পরিচয় হয় ১৯৬৮ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদের একুশে ফেব্রুয়ারির সংকলনে প্রকাশের উদ্দেশ্যে মতিউর রহমান লেখা চাইতে গিয়েছিলেন কবির বাসায়। সারা রাত জেগে কবিতা লিখেছেন শামসুর রাহমান। কবিতার শিরোনাম ‘আমার স্বরের ডালে’। কবিতা দেওয়ার আগে নিজেই একবার আবৃত্তি করে শোনান। বাংলার সেরা কবির সঙ্গে সেই যে পরিচয় ও সম্পর্কের সূত্রপাত, তা ২০০৬ সালে কবির মৃত্যু অবধি অব্যাহত ছিল। কত দিন কাটল আলাপে, আড্ডায়! বিশেষ করে উনসত্তর আর সত্তরের উত্তাল দিনগুলোয় কত না সময় কেটেছে কবিতা, সাহিত্য, গান, রাজনীতি আর আন্দোলন নিয়ে—কত না কথা আর আলোচনায়। বৈঠকি স্বতঃস্ফূর্ত ভাষায় তিনি বলে গেলেন শামসুর রাহমানের অনেক কবিতার জন্মকথা। আমরা জানলাম ‘বন্দীরও মুহূর্ত আছে’ শিরোনামের সনেটটি কবি মতিউর রহমানের অনুরোধে সাপ্তাহিক ‘একতা’ পত্রিকার জন্যই লিখেছিলেন কবি।

শামসুর রাহমানের সঙ্গে লেখকের পরিচয় হয় ১৯৬৮ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদের একুশে ফেব্রুয়ারির সংকলনে প্রকাশের উদ্দেশ্যে মতিউর রহমান লেখা চাইতে গিয়েছিলেন কবির বাসায়। সারা রাত জেগে কবিতা লিখেছেন শামসুর রাহমান। কবিতার শিরোনাম ‘আমার স্বরের ডালে’। কবিতা দেওয়ার আগে নিজেই একবার আবৃত্তি করে শোনান। বাংলার সেরা কবির সঙ্গে সেই যে পরিচয় ও সম্পর্কের সূত্রপাত, তা ২০০৬ সালে কবির মৃত্যু অবধি অব্যাহত ছিল।

গেল শতকের শুরুতে জন্ম এমন মনীষীরও বৃত্তান্ত পাই এখানে। ফলে গ্রন্থটি পরোক্ষভাবে হয়ে উঠেছে এক শতাব্দীর বিবরণ। ভাবীকালের ইতিহাসবেত্তারা এখান থেকে অতি মূল্যবান উপাদান খুঁজে পাবেন। বইয়ের প্রথম আখ্যানের শিরোনাম ‘মিছিলের কবি, মিছিলের যাত্রী নন’। পশ্চিমবঙ্গের কবি অরুণ মিত্রকে নিয়ে এই লেখার শুরু তাঁর প্রয়াণের খবর দিয়ে। পরে স্মৃতিচারণায় কবির চিন্তা, মতামত, কথাগুলো উঠে আসে। অরুণ মিত্রের কথার একটা উদ্ধৃতি—‘ওই সময় নগর আর গ্রাম ছিল মেশামেশি। কুঁড়েঘর আর দালান লাগালাগি, পুকুর আর ডোবা পাশাপাশি। ঝোপঝাড়, বাঁশবন, নারকেল, সুপুরি, তাল, খেজুরগাছের একসঙ্গে জটলা। শহর থেকে পা বাড়ালেই গ্রাম।’ এমন সাবলীল বর্ণনা পাঠকালে যেকোনো পাঠকের মনের ভেতর সেকালের গ্রামবাংলার নিখুঁত ছবি অনায়াস পঠিত হয়ে যায়। পাওয়া যায় আর্থসামাজিক চিত্র এবং মানুষের স্বপ্নের কথাও—‘বর্তমান দুর্দশা–দুর্গতি, যা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে—সেসব দূর করা, সমস্ত মানুষ মুক্ত জীবনের স্বাদ পাবে বা নিজের জীবনের স্বাধীনতা পাওয়ার মতো পরিবেশ পাবে, সে রকম ভবিষ্যতের দিকে উন্মুক্ত হয়ে থাকার অর্থে আমি বামপন্থী।’ আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে সাক্ষাৎকারে কথাগুলো অরুণ মিত্র ‘একতা’ পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমানকে বলেছিলেন। এখনো কেমন প্রাসঙ্গিক কথাগুলো। বাংলার ভূগোলজুড়ে কীর্তির কারণে উৎকীর্ণ থাকবে যাঁদের নাম, সে রকম কিছু মানুষের কথার আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে পুরো বইটিতে।

কাইয়ুম চৌধুরী (৯ মার্চ ১৯৩২—৩০ নভেম্বর ২০১৪)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

একুশের অমর সংগীত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র সুরকার, গণসংগীতশিল্পী ও সংগীত পরিচালক, মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদ আলতাফ মাহমুদকে নিয়ে লেখাটির নাম ‘ঝড়ের পাখির অসমাপ্ত গান’। শিরোনামে উঠে এসেছে এই মহান শিল্পীর জীবনের করুণ দিক। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ কিন্তু সৃজনশীলতায় ভরপুর। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আগস্ট মাসে পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্যরা তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি আর ফেরেননি।

প্রতিটি লেখার শিরোনাম এই বইয়ের অন্যতম আকর্ষণ। কারণ, এসব শিরোনামের মধ্যেই পুরো মানুষটার চরিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন শিল্পী কামরুল হাসানকে নিয়ে লেখার শিরোনাম ‘আমৃত্যু বিদ্রোহী এক শিল্পী’। কাইয়ুম চৌধুরীকে নিয়ে লেখার শিরোনাম ‘একজন কত দিতে পারে’। ‘বিমূর্ত চিত্রকলার প্রধান শিল্পী’—এই শিরোনাম দেওয়া হয়েছে শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়ার জন্য। শিল্পী গণেশ পাইনের শিরোনাম ‘শেকড়ের সন্ধানে’। জহির রায়হানকে নিয়ে লেখার শিরোনাম ‘জীবনের একটু আগুন চাই’। শহীদুল্লা কায়সারের শিরোনাম ‘অন্য এক আলোয় দেখা’।

বইয়ের দ্বিতীয় অংশের নাম ‘স্মৃতিতে’। মোট ২৭ জনের মধ্যে এই অংশে আছে ৬ মনিষীর স্মৃতিকথা। এগুলো প্রথম অংশের ২১ জনের মতো বিস্তারিত নয়, কিছুটা সংক্ষিপ্ত। এ অংশে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে লেখাটির শিরোনাম ‘তাঁর আরেক যুদ্ধ’। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর ‘আমিই মিসির আলী’ উপন্যাসের উৎসর্গপত্রে লিখেছেন: ‘প্রথম আলোর মতি ভাই/জনাব মতিউর রহমান/এই মানুষটাকে আমার মাঝে মাঝে মিসির আলী বলে মনে হয়।’

লেখাটা পড়ে আমারও এখন মনে হচ্ছে, তা–ই তো! মতিউর রহমানও তো মিসির আলীর মতোই। বাংলা সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার মানকে তিনি এক বিশেষ উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যা এর আগে কেউ পারেননি। তাঁর সম্পাদিত ‘প্রথম আলো’ জনপ্রিয়তায় সর্বকালের সব রেকর্ড ভেঙে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। মিসির আলী যা কিছু করে, যুক্তি দিয়ে এবং ভীষণ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে করে। মতিউর রহমানও প্রথম আলো, প্রথমাসহ এ জীবনে যা কিছু করেছেন, সবকিছু যুক্তি আর বুদ্ধি দিয়ে করেছেন বলেই এগুলো দেশসেরায় পরিণত হয়েছে। তিনি একজন সফল মানুষ এসব কারণেই। বহু গুণের অধিকারী তিনি। তাঁর জীবন বর্ণিল, ঘটনাবহুল, বাংলাদেশের ইতিহাসের বহু বাঁকবদলের সাক্ষী তিনি। তাঁর স্মৃতিশক্তি প্রখর। বহু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা তিনি অনুপুঙ্খ মনে রাখতে পারেন। প্রবল স্মৃতিশক্তি একজন লেখকের শ্রেষ্ঠ পুঁজি। এ কারণেই তিনি এ রকম অসাধারণ বই লিখতে পেরেছেন। বড় মাপের মানুষের স্মৃতির বর্ণনা ভবিষ৵তের জন্য সম্পদ হয়ে ওঠে। এর আগে সাহিত্য–সংস্কৃতি–শিল্পের সঙ্গে সংযুক্ত মানুষের স্মৃতি নিয়ে বাংলা ভাষায় লেখা দুটো বই পড়েছি। একটি হলো ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক কথাসাহিত্যিক সাগরময় ঘোষের লেখা ‘সম্পাদকের বৈঠকে’। সম্পাদক হিসেবে বহু লেখকের সঙ্গে তাঁর সংযোগ ছিল, বন্ধুতা ছিল। তাঁর হাত ধরে উঠে এসেছেন অনেক লেখক। ‘সম্পাদকের বৈঠকে’ বইটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা সম্পদ। দ্বিতীয় যে বই আমি পড়েছি, সেটি হলো, কলকাতার প্রখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা মিত্র ও ঘোষের কর্ণধার সবিতেন্দ্রনাথ রায়ের লেখা বই ‘লেখকের কাছাকাছি’। কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে তাঁর প্রকাশনা সংস্থার অফিসে নিয়মিত আড্ডা দিতে আসতেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সজনীকান্ত দাশসহ সেকালের খ্যাতিমান সব লেখক। তাঁদের স্মৃতি নিয়ে এই বই। এ রকম বইয়ের তালিকায় এখন যুক্ত হলো তিন নম্বর বইটি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সিন্দুকে আরও একটি সম্পদ জমা হলো।

‘আকাশভরা সূর্যতারা: কবিতা–গান–শিল্পের ঝরনাধারায়’ বইয়ের প্রচ্ছদ

‘আকাশভরা সূর্যতারা: কবিতা–গান–শিল্পের ঝরনাধারায়’ বইয়ের পাতায় পাতায় স্থান পেয়েছে দুর্লভ সব ছবি। লেখককে দেওয়া চিঠি, অটোগ্রাফ, উপহারের স্মারক, বই, চিত্রকর্মের ছবি প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বইটির মর্যাদা বাড়ানোর পাশাপাশি ভেতরের পাতাগুলোয় দিয়েছে বাড়তি সৌন্দর্য। ৯.৬০ ইঞ্চি বাই ৭ ইঞ্চি সাইজের প্রথমা প্রকাশনার বইটির অঙ্গসৌষ্ঠব অসাধারণ। কাইয়ুম চৌধুরীর মতো শিল্পী যে বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেন এবং অঙ্গসৌষ্ঠবের পরিকল্পনা করেন, সে বইয়ের বাহ্যিক দর্শনে একটা ধ্রুপদি আমেজ থাকবে, তাতে আর সন্দেহ কী!

আকাশভরা সূর্যতারা: কবিতা–গান–শিল্পের ঝরনাধারায়
মতিউর রহমান
প্রকাশন: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
তৃতীয় মুদ্রণ: জুন ২০২৩

প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী
দাম: ৮০০ টাকা।
‘আকাশভরা সূর্যতারা: কবিতা–গান–শিল্পের ঝরনাধারায়’ বইটি সংগ্রহ করতে অর্ডার করুন prothoma.com