কদর্য এক আরব্য রজনী

শাহীন আখতার

সদ্য প্রকাশিত বই কেনার ক্ষেত্রে মন ইদানীং অনেক যাচাই-বাছাই করে। অল্প কিছু লেখকের ক্ষেত্রেই কেবল নতুন বই সংগ্রহ করতে দেরি করি না। ব্যক্তিগত সেই তালিকার একদম প্রথম দিকেই থাকেন শাহীন আখতার।

শাহীনের সাম্প্রতিক উপন্যাস এক শ এক রাতের গল্প তাই প্রকাশের পরে সংগ্রহ করি একদম টাটকা। আর পড়তে বসে কয়েক পাতা গিয়েই আবিষ্কার করি, উপন্যাসের পটভূমি সেই কুখ্যাত হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ-কাণ্ড। আলোচিত ঘটনাটা নিয়ে দেশের প্রথম বড় ক্যানভাসের কাজটা পাওয়া গেল প্রিয় ঔপন্যাসিকের কলমে, সেই ভাবনায় আপ্লুত হয়ে আমি তখন ঢুকে পড়ি উপন্যাসের আরও ভেতরে।

বলে নেওয়া ভালো, হলি আর্টিজানের ঘটনার ঠিক বর্ণনাসুলভ রচনা নয় আলোচ্য উপন্যাস, লেখক বরং ধরতে চেয়েছেন ঘটনার সঙ্গে যারা মোটেই সংশ্লিষ্ট নয়, আততায়ীদের হতবুদ্ধি হয়ে যাওয়া সেই পরিবারগুলোর গল্প। ঔপন্যাসিক চেয়েছেন যেসব বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া ছেলেরা টিভি আর সংবাদপত্রে ‘নিহত জঙ্গি’ হয়ে ফিরে এল, সেসব বাড়ির কয়েকটি মানুষকে আবিষ্কার করতে।

কল্পিত মৃত জঙ্গি শাহরিয়ার জামালের বোন সাফা মরিয়মের সঙ্গে সঙ্গে এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র বলা যায় শাহরিয়ারের সাবেক বান্ধবী দিলরুবা মেহবুবা, আর আরেক কল্পিত জঙ্গি জাভেদ মুর্তজার গৃহশিক্ষক শফি মোহাম্মদকে। নিহত জঙ্গিদের মধ্যে নিজের ছেলে শাহরিয়ার আছে, সেটা জানার পর মুখে ফেনা উঠে মৃত্যু ঘটে সাফা মরিয়মের বাবার, মা যেন কিছুটা বাস্তবতার সঙ্গে যোগ হারিয়ে ফেলেন। সাফা মরিয়ম তখন ঘুরে বেড়ায় ভাইয়ের লাশটা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ফিরিয়ে আনতে। মর্গ থেকে লাশ ছাড়িয়ে আনার চেষ্টায় সাফা মরিয়ম যোগাযোগ করতে থাকে নিহত বাকি জঙ্গিদের পরিবারের সঙ্গে। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা দিলরুবা মেহবুবা চলে যায় সেই গ্রামে, যেখানে মৃত্যুর আগের কয়েকটা দিন আত্মগোপন করে
ছিল তার সাবেক প্রেমিক শাহরিয়ার, প্রস্তুতি নিচ্ছিল রেস্তোরাঁয় হামলা করে বেহেশতে যাওয়ার। আর শফি মোহাম্মদ? নিজের ছাত্রের ‘জঙ্গি’
পরিচয় আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে ভীত শফি মোহাম্মদ ইদানীং আর ঘুমাতে পারে না। রাতের পর রাত জেগে সে তাই আরব্য রজনীর ঢঙে গল্প শোনায় অশরীরী কাউকে, গল্পের কেন্দ্রে থাকে হাজার বছরের ধর্মীয় সহিংসতার ইতিহাস।

এক শ এক রাতের গল্প পড়তে গিয়ে মনে আসে প্রায় একই আঙ্গিক ও বিষয় নিয়ে বছর দুয়েক আগে প্রকাশিত আরেকটি বইয়ের কথা, অদিতি ফাল্গুনীর পরিশ্রমী উপন্যাস ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে। অদিতির উপন্যাসটি দারুণ উচ্চাভিলাষী আর বিস্তৃত, মানুষের চেয়ে একটা কালপর্বকেই ধরতে চাওয়া সেখানে লেখকের আরাধ্য। অথচ অল্প কিছু মানুষের ওপরে আলো ফেলাতেই বোধ হয় শাহীনের বয়ানকে অপেক্ষাকৃত সংহত ও মানবিক লাগে।

তবে এই মানবিক বয়ান তৈরির কাজটাও কঠিন ছিল। কারণ, হাজার চুরাশির মা উপন্যাস পাঠকের মধ্যে ব্রতী চ্যাটার্জীর জন্য যে মায়া তৈরি করে, শাহীনকে কাজ করতে হয়েছে তার উল্টো দিকে; শহুরে উচ্চবিত্ত শাহরিয়ার জামাল কিংবা গ্রামের দরিদ্র বাদশা মিয়ার বেছে নেওয়া রাস্তাকে অবিরাম তিরস্কার করতে হয়েছে তাঁকে। তাই লেখককে যেন অবচেতনে আচ্ছন্ন করে রাখে
একটা অতিসতর্কতা। সঙ্গে উপন্যাসের আঙ্গিকের কারণেও যেন ইতিহাসকে কাঠখোট্টাভাবে বলার একটা চাপ তৈরি হয় লেখকের ওপর। মূল গল্পের সমান্তরালে চলা ক্রুসেড, ফিলিস্তিনের শরণার্থী, আলী ভাইদের খিলাফত আন্দোলন আর একুশ শতকে সিরিয়াগামী যুবকের মোহভঙ্গের গল্প—পাঠককে এরা খানিক দূরেই সরিয়ে রাখে। বরং সাফা মরিয়মের অনুসন্ধান, কিংবা মৃত জঙ্গির বোন আমিরন ফারাবি কীভাবে পা বাড়ায় ওই একই পথে—পাঠকের কাছে সেই কাহিনিই আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক, কারণ, সৎ উপন্যাসের কাছে আমাদের চিরদিন প্রত্যাশা থাকে যে সেটা অন্যের জীবনে উঁকি মারার ফুটো তৈরি করে দেবে।

এক শ এক রাতের গল্প ওই সততার কারণেই উল্লেখ্য। সিনেমার মতো কাছের হয়েও দূরের ওই সময়টার স্মৃতি মানুষের মনে ঝাপসা হয়ে গেছে মাঝখানের কয়েক বছরে। শাহীন আখতারের উপন্যাস আমাদের সেই ডুবে যাওয়া শহরে ফিরিয়ে নিয়েছে আশ্চর্য সততায়।

সুহান রিজওয়ান

এক শ এক রাতের গল্প

শাহীন আখতার

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: জুলাই ২০২২,

প্রচ্ছদ: জাহিদুর রহিম অঞ্জন,

২৩২ পৃষ্ঠা, দাম: ৪২০ টাকা।

বইটি পাওয়া যাচ্ছে

prothoma.com এবং মানসম্মত

বইয়ের দোকানে।