যে উপন্যাস জীবনকে ধন্যবাদ দিতে চায়

উম্মে ফারহানার উপন্যাস রাত্রিশেষের গান চলৎশক্তিহীন এক নারীকে নিয়ে। থিয়েটারকর্মী রাত্রি। আর দশটা মানুষের মতো তারও গতিময় জীবন ছিল। পরিবার, বন্ধু, নিজের কাজকর্ম—সব চলছিল ঠিকঠাক। কিন্তু সেই জীবনের ছন্দ ভেঙে পড়ে। নেমে আসে স্থবিরতা। একটা দুর্ঘটনা সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। তাকে বন্দী করে ফেলে চারদেয়ালের ভেতর। বাইরের জগৎ থেকে হাঠৎ এই বিচ্ছিন্নতায় বিমর্ষ হয়ে পড়ে সে। কিন্তু জীবন কি থেমে থাকে? চারদেয়ালের বন্দিজীবনে তার ভেতর গড়ে উঠতে থাকে দোদুল্যমান সংশয়ে ভরা এক জগৎ। সে মেলাতে চায় জীবনের হিসাব-নিকাশ, স্থবির এই জীবনের অর্থ কী? নাকি এটাই তার নিয়তি? তবু কেন জীবনকে ধন্যবাদ দেয় সে?

উপন্যাসটি শুরু হয়েছে জীবন নিয়ে এই নারীর একধরনের উপলব্ধি ও নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে, ‘মানুষের জীবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হচ্ছে এর অনিশ্চয়তা। যখন কারও জীবনে কোনো অনিশ্চয়তা নেই, নতুন কোনো সম্ভাবনা নেই; সব অজানা সম্ভাবনা কিংবা শঙ্কা নিভে গিয়ে শুধু একটামাত্র বাঁচার পথ খোলা থাকে, সেটাকে নিশ্চয়তা বলা যায় কি না, সেটা একটা প্রশ্ন বটে। এটা নিশ্চয়তা নয়, একে বলে নিয়তি, অমোঘ নিয়তি। আধুনিক মানুষ নিয়তি মানে না, ভাবে ভবিতব্য বলে কিছু নেই, বিশ্বাস করে জীবনে কর্মফলই সব। অথচ কারও কারও জীবনে ভাগ্য তার সর্বোচ্চ নির্মমতা দেখিয়ে দেয়, বুঝিয়ে দেয় মানুষ ভাগ্যের সামনে বড় অসহায়।’

উপন্যাসটি সহজে পাঠককে রাত্রি নামের এই নারীর জীবনের নানা ঘটনার গভীরে নিয়ে যায়। এর একটি বড় কারণ লেখকের ঝরঝরে বর্ণনাভঙ্গি। ঔপন্যাসিক সচেতনভাবে জীবন-জগতের সেই অলিগলিতে পাঠক নিয়ে যান, যা মানুষ নিরাসক্তভাবে বলতে পারে না বা বলতে চায় না। 

মানুষ যখন হারিয়ে ফেলে তার চলার শক্তি, তখন তার কল্পনা, স্বপ্ন ডানা মেলে। পুরো দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায় এসব। আস্তে আস্তে সে তলিয়ে যেতে থাকে পরাবাস্তবের দুনিয়ায়।

চারদেয়ালের মাঝখানে থেকেও রাত্রি নিজেকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করে। হুইলচেয়ারে ভর করে তার ঘর–বারান্দা গুছিয়ে নেয়। পৃথিবী সব রং, গন্ধ সে অনুভব করতে চায় তার স্বপ্নে আর কল্পনায়। বারান্দার টবের ফুলের গাছগুলোর প্রতি অনুভব করে মমত্ব। আর শুনতে থাকে তার পছন্দের গানগুলো। স্মৃতির মধ্যে ডুবে যায় সুযোগ পেলেই। সেই স্মৃতি ধীরে ধীরে উন্মোচন করে তার জীবনের নানান ঘটনা—শৈশব, প্রথম প্রেম, বিশ্ববিদ্যালয়জীবন, সারা রাত আড্ডা দেওয়া দিনগুলো, বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো সুন্দর সব মুহূর্ত। 

উপন্যাসটি পড়তে পড়তে জানা যায়, কীভাবে মে মাসের এক বৃষ্টিমুখর সকালে রাত্রির স্বাভাবিক জীবনে ছেদ পড়ে। বন্দিজীবনের সূচনা হয়। কীভাবে ধীরে ধীরে সে আটকে পড়ে চারদেয়ালের মধ্যে। এ সময় তার স্মৃতিতে হানা দেয় বৃষ্টির তোড়ে ডুবে যাওয়া নতুন কবর, গাঙচিল, চন্দ্রমল্লিকা ফুল, ছোট খালার নাকফুল, হিটার হাতে আন্তোনিও বান্দারাস, প্রথম চুমু খাওয়ার মুহূর্ত, প্রেমিক আরিফের কথা—সবকিছু একটার পর একটা ভেসে উঠতে থাকে মনোজগতে।

কিন্তু জীবন কি চলতে পারে এভাবে? হাঁপিয়ে ওঠে না? হ্যাঁ, রাত্রিও হাঁপিয়ে ওঠে। স্থবির জীবনের নিরর্থকতা গ্রাস করে তাকে। মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে মৃত্যুভাবনা। চারদেয়ালের জীবন থেকে মুক্তি চায় সে। করতে থাকে আত্মহননের পরিকল্পনা।

কিন্তু পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ, হাওয়া, জল বড় মায়াময়। জীবন একে ছেড়ে যেতে চায় না। সবকিছু নিরর্থক হওয়ার পরও তাই রাত্রি যেতে পারে না দুনিয়া ছেড়ে। শেষ পর্যন্ত একটা স্প্যানিশ গানই মেয়েটির জীবনের উপলব্ধি হয়ে ওঠে, ‘গ্রাসিয়াস আ লা ভিদা কে মি আ দাদো তান্তো, মি আ দাদো লা মারচা দে মিস পিয়েস কানসাদোস’, যার অর্থ—জীবনকে ধন্যবাদ, যে আমাকে দিয়েছে ক্লান্ত দুই পায়ে হাঁটার ক্ষমতা।

উপন্যাসটি এই নারীর জীবনকাহিনির মধ্য দিয়ে মানুষের অন্তর্জগতের গল্প যেমন বলেছে, তেমনি দেখিয়েছে জীবনের প্রতি আশাবাদ। পাশাপাশি হাজির করেছে জীবন–জগতের এমন এক জিজ্ঞাসা, সচরাচর যার সামনে দাঁড়াতে আমরা বিব্রত বোধ করি। কী সেই জিজ্ঞাসা?

জানতে হলে রাত্রিশেষের গান উপন্যাসের পৃষ্ঠায় চোখ বোলাতে হবে আপনাকে।

রাত্রিশেষের গান

উম্মে ফারহানা

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০২৪

প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

১২৭ পৃষ্ঠা

দাম: ৩৪০ টাকা।

বইমেলায় পাওয়া যাচ্ছে

প্রথমা প্রকাশনের ৫ নম্বর প্যাভিলিয়নে

ঘরে বসে বইটি পেতে অর্ডার করুন prothoma.com