পাবলো নেরুদার অবিশ্বাস্য জীবন

কী বিচিত্র জীবন ছিল পাবলো নেরুদার! একজীবনে কী না করেছেন! চিলির সামান্য রেলশ্রমিকের ঘরে জন্ম। পড়াশোনা করে চাকরি নিয়েছিলেন বাণিজ্যদূতের। সেই সূত্রে পৃথিবীর নানা দেশ ঘুরেছেন। সেসব দেশের নারীদের সঙ্গ তাঁকে প্রভূত আনন্দ দিয়েছে। করতেন কমিউনিস্ট পার্টি। একপর্যায়ে গোপনে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। ১৯৫২ সালে দেশে ফেরার অনুমতি পান। দেশে ফেরার দীর্ঘদিন পর ১৯৭০ সালে চিলির কমিউনিস্ট পার্টি তাঁকে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী ঘোষণা করে। তিনি বন্ধু সালভাদর আয়েন্দের পক্ষে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। ১৯৭১ সালে প্যারিসে চিলির রাষ্ট্রদূত থাকাকালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। এসবই আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন নেরুদা। বইটির নাম পাবলো নেরুদা: অনুস্মৃতি। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত এই বইয়ের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায় বর্ণনা করা আছে দরিদ্র, ভবঘুরে, উদ্বাস্তু থেকে ক্রমে বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত কবি হওয়ার এক পথপরিক্রমা।

সেই পাবলো নেরুদাকেই শেষ জীবনে এক অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্যে বাঁচতে হয়েছে। ১৯৭২ সালে অসুস্থ হওয়ায় চিলিতে ফিরে আসেন। ১৯৭৩ সালে আয়েন্দে খুন হন। কবিকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। এমনকি, হাসপাতালে নিতে বাধা দেওয়া হয়। তাঁর বাড়ি লুট করা হয়। জলের কলগুলো খুলে রাখা হয়। সান্তিয়াগোর এক অখ্যাত হাসপাতালে প্রায় বিনা চিকিৎসায় ২৩ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর কফিন আইলা নিগ্রায় তাঁর বাড়ির সামনে আনার পর সামরিক সরকার কারফিউ জারি করে। কিন্তু জনতা সেই নির্দেশ মানেনি। নেরুদার শেষ জীবনের এসব ঘটনা নিয়ে উপন্যাস দ্য পোস্টম্যান। লিখেছেন চিলির আন্তনিও স্কারমেতা। অনুবাদ করেছেন কথাসাহিত্যিক সাগুফতা শারমীন তানিয়া। অনুবাদ এতটা সাবলীল যে পড়ার সময় ঘুণাক্ষরেও টের পাওয়া যায় না, এটা
অনুবাদ।

পাবলো নেরুদাকে নিয়ে উপন্যাস:

দ্য পোস্টম্যান

আন্তনিও স্কারমেতা

অনুবাদ: সাগুফতা শারমীন তানিয়া

প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ২০২০, ৯৬ পৃষ্ঠা, দাম: ২২০ টাকা।

আইলা নিগ্রা, দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের তীরের পাথুরে দ্বীপ। চিলির বিখ্যাত সমুদ্রসৈকতও। এখানে কবি পাবলো নেরুদা ১৯৩৯ সাল থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন। এখানকারই এক ডাকপিয়নের জীবনের গল্প এই দ্য পোস্টম্যান। তাঁর নাম মারিও হিমেনেজ। তিনি নেরুদার ডাকপিয়ন। প্রেমে পড়েন বিয়েত্রিজ গঞ্জালেজ নামের এক সুরা পরিবেশনকারীর। সমস্যা হলো, বিয়েত্রিজের সামনে গেলে ডাকপিয়ন সব ভুলে যান, কোনো কথাই বলতে পারেন না। এহেন সংকটে পাবলো নেরুদাকে গুরু মেনে পরামর্শ চান মারিও। এসব আলাপের মধ্যে শিষ্য শিখে ফেলেন ‘উপমা’, কবিতার বহু পুরোনো অস্ত্র। এই অস্ত্রই একদিন তিনি বিয়েত্রিজের ওপর প্রয়োগ করেন, ‘তোমার হাসি প্রজাপতির পাখনার মতো ডানা মেলে ছড়িয়ে পড়ে।’ এভাবে একের পর এক অস্ত্র প্রয়োগে মেয়েটির মন গলে যায়। নেরুদা উপস্থিত থেকে তাঁদের বিয়ে দেন। তাঁদের সন্তানও হয়। একজন সামান্য ডাকপিয়নের কবি হয়ে ওঠার যে প্রক্রিয়া এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, তা অসাধারণ।

আসলে দ্য পোস্টম্যান উপন্যাসে পাবলো নেরুদা আইসবার্গ বা হিমশিলার মতো। হিমশিলার ধর্ম হলো পানির ওপর এক-দশমাংশ ভাসে; বাকি নয়-দশমাংশ থাকে পানির নিচে। এই বই পড়তে গিয়ে বারবার টাইটানিক জাহাজের কথা মনে হয়েছে। একটুকরো বরফ, তাই কিনা শেষে অত বড় জাহাজকে ডুবিয়ে দিল! এই বই পড়তে গিয়ে অনেক পাঠকের অবস্থা হতে পারে টাইটানিকের মতো। তাঁরা ওপরের অংশটাই দেখবেন। তলে যে বিশাল বরফপাহাড় রয়েছে, তা না–ও খেয়াল করতে পারেন। তবে খেয়াল করে পড়লে অন্য রকম আনন্দ পাবেন।