নানান রকম ওয়ালীউল্লাহ্

বিভিন্ন সময়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্​র জীবন ও সাহিত্যকর্মবিষয়ক বিবিধ রচনায় তাঁকে বিশ্লেষণের নানামুখী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে পাঠকের। তবে সেসব রচনাকে ছাপিয়ে ‘ব্যক্তি’ ওয়ালীউল্লাহ্​কে সম্পূর্ণ ভিন্নমাত্রায় ও পরম নিবিড়তায় জানতে গেলে তাঁর স্ত্রী আন-মারি ওয়ালীউল্লাহ্​র লেখা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্​: মাই হাজব্যান্ড অ্যাজ আই স হিম বইটির বিকল্প নেই। ইংরেজিতে লেখা এই গ্রন্থের পরতে পরতে আন-মারির চোখে বিশ্লেষিত হয়েছেন ওয়ালীউল্লাহ্ এবং সেই পর্যবেক্ষণের ধারায় পাঠকের সামনে উন্মোচিত হয়েছে লেখকের ব্যক্তিসত্তা ও সৃষ্টিশীলতার বৈচিত্র্যময় দিকগুলো।

মনোমুগ্ধকর বইটির মুখবন্ধে শামশাদ মর্তুজা বলেছেন, এখানে দুজন দুজনকে খুঁজে পাওয়ার, দুজনের গড়ে ওঠায় একে অপরের সহযোগিতার, এবং পারস্পরিক অনুভূতি কখনোই ম্লান না হওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। তবে নিছক ‘স্মৃতিকথা’ আখ্যা দিয়ে এ বইয়ের মূল সুরকে ধরা ধারণ সম্ভব নয়, এটি বরং তার চেয়ে আরও বেশি কিছু! বৃহৎ আকারের বইয়ের মোট সাত অধ্যায়ে পর্যায়ক্রমে উঠে এসেছে আন-মারির সঙ্গে ওয়ালীউল্লাহ্​র সাক্ষাতের ইতিবৃত্ত, তাঁদের ইউরোপের দিনগুলো, একজন বাঙালি মুসলমান হিসেবে আন-মারি কীভাবে লেখককে মূল্যায়ন করেছেন সেই দৃষ্টিকোণ। আবার সর্বগ্রাসী পাঠক হিসেবে ওয়ালীউল্লাহ্​র ভিন্নমাত্রিক পরিচয় এবং আন-মারির দৃষ্টিতে শিল্পী ও লেখক হিসেবে ওয়ালীউল্লাহ্​কে পর্যবেক্ষণের প্রয়াসও এখানে পাওয়া যায়।

বইয়ের ভূমিকায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্​ ও আন–মারির ছেলে ইরাজ ওয়ালীউল্লাহ্​র বয়ান রয়েছে। চমৎকার কিছু ছবি, পাণ্ডুলিপি, লেখকের চিত্রকর্ম, এবং চিঠিসংবলিত এই বইকে একটি অসাধারণ অ্যালবামও বলা চলে, যার মূল পরিকল্পনায় ছিলেন ইরাজের বোন সিমিন ওয়ালীউল্লাহ্। তাঁদের মা ১৯৯৭ সালে মৃত্যুর কিছুকাল আগে তাঁদের বাবাকে নিয়ে ইংরেজি ভাষায় একটি স্মৃতিকথা লিখেছিলেন, যেটি পরবর্তী সময়ে আন-মারির মৃত্যুর পর প্রথমা প্রকাশন থেকে আমার স্বামী ওয়ালী নামে শিবব্রত বর্মনের বাংলা অনুবাদে প্রকাশিত হয়। মূলত সেই স্মৃতিকথাটিই নতুন এই অ্যালবামসদৃশ বইটির মূল উপজীব্য। তাই সিমিন ও ইরাজ ওয়ালীউল্লাহ্ এটি উৎসর্গও করেছেন তাঁদের মা-বাবাকে।

জীবনসঙ্গী হওয়ার সূত্রে আন-মারি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্​কে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে জেনেছেন, তাতে সন্দেহ নেই। তবে তিনি যেভাবে তাঁর অনুভূতিগুলোকে শব্দে প্রকাশ করেছেন, তা একজন লেখক হিসেবে তাঁর প্রজ্ঞাকেও করে তুলেছে সমুজ্জ্বল।

আন-মারির ঝরঝরে বর্ণনাভঙ্গি ও সুগভীর বিশ্লেষণী দক্ষতা বইটি পড়ার সময় পাঠকের মনোযোগ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে সক্ষম। পাশাপাশি বাড়তি পাওনা হিসেবে অ্যালবামে সংযুক্ত রয়েছে অসংখ্য আলোকচিত্র, যেসবের মাধ্যমে ওয়ালীউল্লাহ্​র ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন, পেশাগত অভিজ্ঞতা, শখ-শৌখিনতা ও ভ্রমণসম্পর্কিত বাস্তব, আননন্দময়, ও বহু বর্ণিল দৃশ্যপটগুলো পাঠকের সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে, উন্মুক্ত হয় তাঁকে জানার নতুন দিগন্ত। এখানে সংকলিত হয়েছে ওয়ালীউল্লাহ্​র আঁকা বেশ কিছু ছবিও। এসব ছবি দেখে তাঁর শিল্পীসত্তার প্রশংসা না করে উপায় থাকে না।

লেখককে দেখার যে ভঙ্গি আন-মারির বর্ণনায় পাওয়া যায়, তা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্​কে সঠিকভাবে অনুধাবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওয়ালীউল্লাহ্​কে নিজের ‘গুরু’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেছিলেন, তাঁর মতো এত বিদ্বান লোক তিনি কম দেখেছেন। দেশভাগ, হিন্দু-মুসলমান বিরোধ, নিজের দেশের দরিদ্র অশিক্ষিত লোকজনের জীবন নিয়ে এই কথাসাহিত্যিক অনেক ভাবতেন—এমনটাই মনে করতেন আন-মারি। তিনি বলেছেন, ধর্মীয়ভাবে না হলেও সাংস্কৃতিকভাবে ওয়ালীউল্লাহ্ বাঙালি মুসলমানই ছিলেন। তাঁর বর্ণনায় একজন ভোজনপ্রিয় ও সংগীতপ্রিয় বাঙালি হিসেবেও ওয়ালীউল্লাহ্​র পরিচয় মেলে। পাওয়া যায় পাঠক ওয়ালীউল্লাহ্​কেও।

লেখা ও ছবি মিলেমিশে এ বই যেমন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্​র জীবনকে বোঝার জন্য জরুরি, তেমনি এখানে ভেসে ওঠে নানান রকম ওয়ালীউল্লাহ্​র মুখ।

মাফরুহা সিফাত

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্​: মাই হাজব্যান্ড অ্যাজ আই স হিম

আন-মারি ওয়ালীউল্লাহ্​

প্রকাশক: নিমফিয়া পাবলিকেশন্স, ঢাকা, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২২, বই নকশা: সিমিন ওয়ালীউল্লাহ্​,

প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা,

২৫০ পৃষ্ঠা, দাম: ১৫০০ টাকা।