আমার বাবার জুতা

প্রাত্যহিক জীবনে ‘জুতা’ এক প্রয়োজনীয় পণ্যের নাম। জুতা যেমন আমাদের চলার ক্লান্তিকে দূর করে, তেমনি কোনো কোনো সময় এই জুতাই হয় আমাদের বেদনার কারণ। জুতা কখনো কখনো আবার গর্ব আর আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবেও ধরা দেয়। নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদ বেশ আগে তাঁর বাবা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদের জুতা নিয়ে একটি মর্মস্পর্শী লেখা লিখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় দিবসের প্রেক্ষাপটে রচিত সেই লেখা অনেকেরই প্রিয়। সম্প্রতি বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন জুতা পরা নিয়ে একটি আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। সেই সূত্রে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ক্ষোভে ফেটে পড়েছে মানুষ। এই প্রেক্ষিতে হুমায়ূন আহমেদের ‘আমার বাবার জুতা’ শিরোনামের লেখাটি আবার পড়া যেতে পারে।

হুমায়ূন আহমেদছবি: প্রথম আলো

বিজয় দিবসের কত সুন্দর সুন্দর স্মৃতি মানুষের আছে। সেসব স্মৃতিকথা অন্যকে শোনাতে ভালো লাগে। প্রেমিকার প্রথম চিঠি পাওয়ার গল্প বলার সময় যেমন রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয়, বিজয় দিবসের গল্প বলার সময়ও তাই হয়। আমার বন্ধু  ‘দৈনিক বাংলা’র সালেহ চৌধুরীকে দেখেছি বিজয় দিবসের স্মৃতিকথা বলার সময় তাঁর চোখে পানি এসে পড়ে। যদিও তেমন কিছু উল্লেখ করার মতো স্মৃতি নয়। তিনি তাঁর মুক্তিযোদ্ধা দলবল নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছিলেন। হঠাৎ শুনলেন দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। যুদ্ধের অবসান হয়েছে, আর গুলি ছুড়তে হবে না। তিনি রাইফেল ছুড়ে ফেলে মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদতে শুরু করলেন। এই গল্প বলার সময় কেউ কাঁদতে শুরু করলে তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না।

আমার দূরসম্পর্কের এক চাচা বিজয় দিবসের স্মৃতি এভাবে বলেন, খবরটা শোনার পরে কানের মধ্যে ‘তবদা’ লেগে গেল। আর কিছুই কান দিয়ে ঢোকে না। আমি দেখছি সবার ঠোঁট নড়ে, কিন্তু কিছু শুনি না। আজব অবস্থা। ১৬ ডিসেম্বর কাছাকাছি এলেই পত্রিকাওয়ালারা বিজয় দিবসের স্মৃতিকথা ছাপানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাঁরা কখনোই ভাবেন না, সেদিনের কথা যথাযথভাবে বলা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। সেদিন আমরা সবাই ঘোরের মধ্যে ছিলাম। ঘোরের স্মৃতি হলো এলোমেলো স্মৃতি। ঘোরের কারণে তুচ্ছ জিনিসকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। মস্তিষ্ক খুব যত্ন করে তার মেমোরিসেলে তুচ্ছ জিনিসগুলো রেখে দেয়। আবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সে অদরকারি মনে করে ফেলে দেয়।

আমার বাবার এক জোড়াই জুতা ছিল। লাল রঙের চামড়ার জুতা। মাল্টিপারপাস জুতা। সাধারণভাবেও পরতেন, আবার তাঁর পুলিশের ইউনিফর্মের সঙ্গেও পরতেন। জুতা জোড়ার সঙ্গে আমরা খুব পরিচিত, কারণ আমাদের প্রায়ই তাঁর জুতা কালি করতে হতো। কাজটা আমাদের খুব পছন্দের ছিল। জুতার কালির গন্ধটা খুব মজা লাগত। আবার ব্রাশ ঘষতে ঘষতে জুতা যখন ঝকঝকে হয়ে উঠত, তখন দেখতে ভালো লাগত। সবচেয়ে বড় কথা, ঝকঝকে জুতা দেখে বাবা বলতেন, ‘আরে বাপ রে এক্কেবারে আয়না বানিয়ে ফেলেছে।’ এই বাক্যটি শুনতেও বড় ভালো লাগত।

একজন মাতালকে নেশা কেটে যাওয়ার পর যদি জিজ্ঞেস করা হয়, নেশা করার ওই রাতে তুমি মদ্যপান ছাড়া আর কী করেছিলে? সে পরিষ্কার কিছু বলতে পারবে না। বলতে পারার কোনো কারণ নেই। বিজয় দিবসে আমরা সবাই এক প্রচণ্ড নেশার মধ্যে ছিলাম। কাজেই হে পত্রিকা সম্পাদক! আপনি কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। জিজ্ঞেস করলেই আমরা উল্টাপাল্টা কথা বলব। আপনার ধারণা হবে আমরা মিথ্যা কথা বলছি। কিন্তু আমরা কেউ মিথ্যা বলছি না। দেশের স্বাধীনতা নিয়ে কি আর মিথ্যা গল্প করা যায়?

আজ আমি বিজয় দিবসের স্মৃতির গল্প করব না। আমি বরং আমার বাবাকে নিয়ে একটি গল্প বলি। এই মহান ও পবিত্র দিনে গল্পটি বলা যেতে পারে।

আমার বাবার এক জোড়াই জুতা ছিল। লাল রঙের চামড়ার জুতা। মাল্টিপারপাস জুতা। সাধারণভাবেও পরতেন, আবার তাঁর পুলিশের ইউনিফর্মের সঙ্গেও পরতেন। জুতা জোড়ার সঙ্গে আমরা খুব পরিচিত, কারণ আমাদের প্রায়ই তাঁর জুতা কালি করতে হতো। কাজটা আমাদের খুব পছন্দের ছিল। জুতার কালির গন্ধটা খুব মজা লাগত। আবার ব্রাশ ঘষতে ঘষতে জুতা যখন ঝকঝকে হয়ে উঠত, তখন দেখতে ভালো লাগত। সবচেয়ে বড় কথা, ঝকঝকে জুতা দেখে বাবা বলতেন, ‘আরে বাপ রে এক্কেবারে আয়না বানিয়ে ফেলেছে।’ এই বাক্যটি শুনতেও বড় ভালো লাগত।

মা আয়েশা ফয়েজের সঙ্গে তিন ছেলে—মুহম্মদ জাফর ইকবাল, হুমায়ূন আহমেদ ও আহসান হাবীব
ছবি: নাসির আলী মামুন

১৯৭১ সালের ৫ মে আমার বাবা তাঁর লাল জুতা পরে বরিশালের গোয়ারেখো গ্রাম থেকে বের হলেন। সেদিন জুতা জোড়া কালি করে দিল আমার ছোট বোন। বাবা যথারীতি বললেন, ‘আরে বাপ রে এক্কেবারে আয়না বানিয়ে ফেলেছিস দেখি।’ সেই তাঁর জুতা পরে শেষ বের হয়ে যাওয়া।

সন্ধ্যার সময় খবর এল, বলেশ্বর নদের তীরে দাঁড় করিয়ে মিলিটারিরা তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। মানুষকে যে এত সহজে মেরে ফেলা যায়, তা আমার মা তখনো জানতেন না। তিনি খবরটা বিশ্বাস করলেন না। তিনি আমাদের ডেকে বললেন, তোরা এই লোকগুলোর কথা বিশ্বাস করিস না। তোর বাবা সারা জীবনে কোনো পাপ করেনি। এ রকম মৃত্যু তাঁর হতে পারে না। তোর বাবা অবশ্যই বেঁচে আছেন। যেখানেই থাকুন তিনি যেন সুস্থ থাকেন, এই দোয়া কর। আমি জানি তোর বাবার সঙ্গে তোদের আবার দেখা হবে, অবশ্যই হবে।

একজনের বিশ্বাস অন্যের মধ্যে সংক্রমিত হয়। আমরা সবাই মায়ের কথা বিশ্বাস করলাম। এর মধ্যে মা এক রাতে স্বপ্নেও দেখলেন, মিলিটারিরা বাবাকে পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে সেখানের এক জেলে আটকে রেখেছে। বাবা স্বপ্নে মাকে বললেন, ‘দেশ স্বাধীন হলেই এরা আমাকে ছেড়ে দেবে। তখন তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে। এই কদিন একটু কষ্ট করে থাকো।’

মা খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিছুই খেতে পারতেন না। এই স্বপ্নের পর আবার অল্পস্বল্প খেতে শুরু করলেন। আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম স্বাধীনতার দিনটির জন্য। আমরাও মায়ের মতোই ধরে নিয়েছিলাম, দেশ স্বাধীন হলেই বাবাকে পাওয়া যাবে। মায়ের প্রতি আমাদের এই অবিচল বিশ্বাসের কারণও আছে। আমার মা কখনোই তাঁর ছেলেমেয়েদের কোনো ভুল আশ্বাস দেননি।

আমরা তখন গ্রামে পালিয়ে আছি। মে মাস প্রায় শেষ হতে চলছে। ঘোর বর্ষা। দিনের পর দিন একনাগাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। তখন অদ্ভুত একটা খবর পাওয়া গেল। এক লোক নাকি বলেশ্বর নদ দিয়ে ভেসে যাওয়া একটা লাশ তুলে কবর দিয়েছে। তার ধারণা, এটা পিরোজপুরের পুলিশপ্রধান ফয়জুর রহমান আহমেদের লাশ। সে লাশটা কবর দিয়েছে, তবে প্রমাণের জন্য লাশের পা থেকে জুতা জোড়া খুলে রেখেছে। এই জুতা জোড়া সে আমাদের হাতে তুলে দিতে চায়। আমার মা বললেন, অসম্ভব! এটা হতেই পারে না। নিশ্চয়ই অন্য কারও জুতা। তবু পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য আমাকে জুতা আনতে শহরে পাঠালেন। আমাকে পাঠানোর কারণ হলো, আমার মায়ের ধারণা, আমি খুব ভাগ্যবান ছেলে। আমি কখনো অমঙ্গলের খবর আনব না।

মিলিটারিতে তখন পিরোজপুর গিজগিজ করছে। এ অবস্থায় কোনো যুবক ছেলের শহরে ঢোকা মানে জীবন হাতে নিয়ে ঢোকা। তার ওপর শুনেছি, মিলিটারিরা আমাকে এবং আমার ছোট ভাইকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

হুমায়ূন আহমেদের বাবা পুলিশ কর্মকর্তা শহীদ শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদ
ছবি: সংগৃহীত

আমি শহরে গেলাম লুঙ্গি, পাঞ্জাবি এবং টুপি মাথায় দিয়ে। যেন কেউ চিনতে না পারে। ওই লোককে খুঁজে বের করলাম। আমাকে জুতা জোড়া দেওয়া হলো। হ্যাঁ, আমার বাবারই জুতা। ভুল হওয়ার কোনোই কারণ নেই। জুতা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফিরলাম। আমার মা জুতা দেখলেন, তিনিও বুঝলেন এটা কার জুতা, তারপরও বিশ্বাস করলেন না। এক রকম জুতা তো কত মানুষেরই থাকতে পারে। তিনি আমাদের বললেন, জুতা দেখে তোরা মন খারাপ করিস না। এটা মোটেই কোনো জোরালো প্রমাণ না। জুতা জোড়া কাগজে মুড়ে এক কোনায় রেখে দেওয়া হলো।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর মা ঢাকা থেকে পিরোজপুর গেলেন। নদীর পাড়ে যেখানে বাবাকে কবর দেওয়া হয়েছিল বলে দাবি করা হয়েছে, সেই জায়গা নিজে উপস্থিত থেকে খোঁড়ালেন। কবর থেকে লাশ তোলা হলো। শরীর পচে গলে গেছে, কিন্তু নাইলনের মোজা অবিকৃত। মা পায়ের মোজা, দাঁত, মাথার চুল দেখে বাবাকে শনাক্ত করলেন। দীর্ঘ ছয় মাস পর তিনি স্বীকার করলেন, তাঁর স্বামী বেঁচে নেই।

তিনি ঢাকায় ফিরে এলেন, আমাদের যে এত দিন মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছেন, তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। আমার সবচেয়ে ছোট বোনটি অসুস্থ। সে কথা বলতে পারে না, কানেও শোনে না। মা আমার ছোট ভাইকে বললেন, তাকে যেন বাবার মৃত্যুর ব্যাপারটি বুঝিয়ে বলা হয়।

সন্ধ্যাবেলা মা কাগজের মোড়ক থেকে জুতা জোড়া বের করলেন। অনেক সময় নিয়ে পরিষ্কার করলেন। লাল কালি কিনে এনে জুতা কালি করা হলো। আমরা দেখলাম, তাঁর বিছানায় বালিশের পাশে জুতা জোড়া রাখা হয়েছে। সেই রাতে তিনি বাবার জুতা জোড়া জড়িয়ে ধরে বিছানায় শুতে গেলেন।

হুমায়ূন আহমেদ
ছবি: নাসির আলী মামুন

আজকের এই মহা-আনন্দের দিনে আমি আপনাদের আমার একটি ব্যক্তিগত কষ্টের গল্প বললাম। আমার এই কষ্ট যেন আপনাদের আনন্দকে কোনোভাবেই ছোট না করে। আজকের দিনে কষ্টের কোনো স্থান নেই। আমার বাবা এই দেশকে ভালোবেসেছিলেন। আমিও বাসি। অবশ্যই আমার ছেলেমেয়েরাও বাসবে। আজকের দিনে এই ভালোবাসাই সত্য, আর সব মিথ্যা।

প্রতিবছর বিজয় দিবস আসে, আমি নিজের হাতে বাসায় একটা পতাকা টানাই। পতাকাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে বড় ভালো লাগে। আমার কী সৌভাগ্য, স্বাধীন দেশের পতাকা নিজের হাতে ওড়াচ্ছি।

আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব
ফুরায়ে গেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব।

সূত্র: ‘বিজয়ের মুহূর্ত’, সম্পাদক: মতিউর রহমান, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৯