মুক্তিযুদ্ধে চারুশিল্পীদের অজানা ইতিহাস

‘স্বাধীনতা’—এই প্লাকার্ড নিয়ে কবি সুফিয়া কামাল ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে চারু ও কারুশিল্পী সংগ্রাম পরিষদের মিছিল, মার্চ ১৯৭১
ছবি: রশীদ তালুকদার

২৪ মার্চের প্রথম আলোর ‘অন্য আলো’য় অগ্রগণ্য গবেষক সৈয়দ আজিজুল হকের ‘মুক্তিযুদ্ধে চারুশিল্পীরা’ শিরোনামের নিবন্ধটির জন্য তাঁকে ধন্যবাদ, অন্যথায় এসব তথ্য হয়তো কালের গর্ভে হারিয়ে যেত। তাঁর লেখাটির পর একই বিষয়ে আমার এ লেখার উদ্দেশ্য, মুক্তিযুদ্ধের সময়ের চারুশিল্পীদের আরও কিছু বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা, অনেকের কাছেই যা এখন অজানা।

১৯৬৬ সালে ভর্তি হয়ে ১৯৭১ সালে আমি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের (সর্বসাধারণ্যে তখন আর্ট কলেজ হিসেবে পরিচিত) পঞ্চম বা শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলাম। সে কারণে বহু ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বা সাক্ষী হিসেবে কিছু অনুল্লেখিত তথ্যের অবতারণা প্রাসঙ্গিক বলে অনুভব করছি।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তানিদের হাতে শহীদ হন আর্ট কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র শাহনেওয়াজ

১৯৬৭ সালে ছায়ানটের আয়োজনে রমনার বটমূলে বাংলা নববর্ষ আবাহনের সূচনা বাঙালি জাতিসত্তার জাগরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এতে আর্ট কলেজের ছাত্রদের উৎসাহী অংশগ্রহণ ছিল। শিল্পী নিতুন কুণ্ডু সিনিয়র ছাত্রদের নিয়ে বর্ষবরণের প্রথম অনুষ্ঠানের মঞ্চসজ্জা করেছিলেন বলে মনে পড়ে। প্রথম দিকের স্বল্পসংখ্যক শ্রোতার মধ্যে ছায়ানট ও আর্ট কলেজের ছাত্ররাই ছিলেন প্রধান। এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকালীন অবদান ছাড়া নিতুন কুণ্ডু সম্পর্কে আরও জানাতে চাই, ষাটের দশকে তিনি তৎকালীন ইউএসআইএস বা মার্কিন তথ্যকেন্দ্রে চাকরিরত ছিলেন। তখন যেকোনো আন্দোলন-মিছিলে ইউএসআইএসের তোপখানা অফিসটি তোপের মুখে পড়ত, ওখানে ঢিল ছোড়া ছিল নিয়মিত ব্যাপার। নিতুনদার কাছে আমরা যেতাম আন্দোলনের তহবিলে চাঁদার জন্য আর প্রতিষ্ঠানটির স্ক্রিনপ্রিন্ট সুবিধা ব্যবহার করে ছোটখাটো ছাপার কাজে। নিতুনদা ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের দৃষ্টি এড়িয়ে দুটি কাজই করে দিতেন।

ষাটের দশকের শেষের দিকে আর্ট কলেজ ও এর হোস্টেল হয়ে ওঠে আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারের উল্টো দিকের সীমানা প্রাচীরের ওপর যেসব বৃহৎ আকারের সচিত্র ব্যানার টানানো হতো, সেগুলো আঁকা হতো আমাদের হোস্টেলে। আমরা বড়দের রং–তুলি এগিয়ে দেওয়ার কাজ আর কঞ্চির আগায় তুলা বেঁধে গুঁড়া রং গুলিয়ে সারা রাত পোস্টার লিখতাম। পোস্টারে রাজনৈতিক বক্তব্য ছাড়া কবিতার লাইনও তখন জনপ্রিয় ছিল। আমার কিছুটা সাহিত্যজ্ঞান ছিল বলে এগুলো নির্বাচনের দায়িত্ব পড়ত আমার ঘাড়ে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, জীবনানন্দের জনপ্রিয় কবিতা তো ছিলই, আমি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, এমনকি তুর্কি কবি নাজিম হিকমতের কবিতা থেকেও পঙ্‌ক্তি যোগ করি পোস্টারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণে প্রতিদিন বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়; পোস্টার, ফেস্টুন, কার্টুন, ব্যানারসজ্জিত মিছিল নিয়ে আমরা সমাবেশস্থলে হাজির হলে সারা কলাভবন প্রাঙ্গণ হাততালিতে ফেটে পড়ত।

একাত্তরের শুরু থেকেই ক্লাসরুম অপেক্ষা রাজপথ অধিক আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে শুরু করল। আমাদের কলেজে নানা রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন লেগেই থাকত। একবার একটি গণসংগীতের আসর আয়োজন করা হলো, যেটির মঞ্চ সাজানো হয়েছিল দুই পাশজুড়ে জ্বলন্ত মশালের সারি দ্বারা। আরেকবার সিদ্ধান্ত হলো, আমাদের মিছিলের সামনে থাকবে রাস্তার দুইপাশজুড়ে বিস্তৃত বিশাল ব্যানার। এর বাণীচয়নের ভার যথারীতি আমার ওপর পড়ল। আমি রবীন্দ্রনাথের কবিতা ঘেঁটে চয়ন করলাম, ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই /নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই’। কথা ছিল ব্যানারটি মিছিলের অগ্রভাগে বহন করবেন মেয়েরা, কিন্তু বাতাসের বিপরীতে এত বড় ব্যানার টানতে মেয়েরা প্রায় উল্টে পড়ার অবস্থা। শেষে চারজন ছেলে গলদঘর্ম হয়ে ব্যানারটি কোনোমতে টেনে নিয়ে গেলেন। এ সময় হোস্টেলবাসী ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নিলেন, হোস্টেলের ছাদ থেকে একতলা পর্যন্ত প্রস্থের বৃহত্তম ব্যানার ঝোলানো হবে, এর কথাও রচনার ভার পড়ল আমার ওপর। আমার রচিত ‘স্বাধীনতা আমার স্বপ্ন, ঐক্য আমার শক্তি, মুক্তি আমার লক্ষ্য’ কথাটি একটি লাল কাপড়ে লিখে ঝোলানো হলো। ব্যানারে হোস্টেলের সম্মুখভাগ ঢেকে গেল। এই বাক্য বেশ কিছু কাগজ সে সময় হেডলাইন হিসেবে ব্যবহার করেছে।

শিল্পীদের মিছিল ও অন্যান্য কর্মকাণ্ডে আমাদের শিক্ষক ও ছাত্ররা ছাড়া বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত শিল্পীরাও যুক্ত হয়েছিলেন—এটিও স্মরণ করা দরকার। শিল্পী কামরুল হাসান ও মুস্তাফা মনোয়ারের কথা বলাই হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারির আয়োজনে অক্ষরবৃক্ষের ও অক্ষর-অঙ্কিত শাড়ি পরিধানের পরিকল্পনা মূলত কামরুল হাসানের। খালি গা, মাথায় পট্টি, গলায় ঢোলক, ব্রতচারীর বোলসহ তাঁর অংশগ্রহণ আমাদের উদ্দীপনাকে বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। ওই সময় টেলিভিশনে কর্মরত শিল্পীদের কথাও খানিক বলতে হয়। এ মুহূর্তে মহীউদ্দিন ফারুক, আনোয়ার হোসেন, রেজাউল করিম, আবদুল মান্নানের কথা স্মরণ করতে পারছি। আমাদের আগে আগেই পাস করা সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদসহ অনেকেই আমাদের প্রেরণা জোগাতেন। ‘মুক্তির গান’-এর গায়ক দলে শিল্পী স্বপন চৌধুরী ছিলেন অন্যতম একজন।

১ মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়। বেশির ভাগ ছাত্র চলে গেছেন, হোস্টেলে আছি আমরা জনা দশেক ছাত্র আর কর্মচারী। বাড়ি থেকে ঘুরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ২৪ তারিখে আমার সহপাঠী ও বিশেষ বন্ধু শাহনেওয়াজের কাছে রুমের চাবি রেখে বিদায় নিলাম, আমি অল্প দিনেই ফিরে আসব। তখন দুঃস্বপ্নেও জানি না, বন্ধু শাহনেওয়াজ এবং অন্য কয়েকজনের সঙ্গে আর জীবনে দেখা হবে না। আর মাত্র এক দিনের হেরফেরে আমারও একই পরিণতি হতে পারত। আমাদের হোস্টেল সুপার শিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরী বাড়িতে গেছেন। তাঁর সঙ্গে থাকতেন পরিজনহীন অকৃতদার শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া। ২৬ মার্চ সেনা দল যখন হোস্টেলে প্রবেশ করে, তখন কিবরিয়া স্যার তাঁর চোস্ত উর্দুজ্ঞান আর প্রাইড অব পারফরম্যান্স পদক দেখিয়ে কীভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন, তা অনেকেরই জানা। সেনাদের হানায় আমার বন্ধু শাহনেওয়াজ নিহত হয়, নজরুল ইসলাম গুলি খেয়েও অলৌকিকভাবে বেঁচে যায়। বর্তমানে প্রয়াত নজরুল একসময় কার্টুনিস্ট হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল।

ঘটনার পরদিন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী নিজে গাড়ি চালিয়ে হোস্টেল থেকে কিবরিয়া স্যারকে উদ্ধার করে নিজের বাসায় নিয়ে এসেছিলেন, এটিও ওই সময় বিরল সাহসিকতার একটি নিদর্শন। মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখসমরে যোদ্ধা হিসেবে আমরা শিল্পী শাহাবুদ্দিনের নাম শুনি, আবুল বারক আলভীর সাহসী ভূমিকার কথা জানি। তবে আরও অনেকেই নানাভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। শাহাবুদ্দিনের সহপাঠী কে এম এ কাইয়ূম ঢাকা শহরের মধ্যে অস্ত্র পরিবহনের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেছেন। তখনকার ছাত্রদের মধ্যে আমার সহপাঠী আবদুর রাজ্জাক, আবদুল খালেক এবং নিচের শ্রেণির বনিজুল হক, মো. সিরাজুদ্দিন ট্রেনিংপ্রাপ্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বলে জানি।

চট্টগ্রামে আমার ভাই আবুল মোমেন এবং আমি অন্য কয়েকজনের সঙ্গে দেশের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের নানা কাজকর্মে যুক্ত হই। মুজিবনগর থেকে আসা জয়বাংলা পত্রিকা গোপনে বিলি করা ছিল আমাদের একটি প্রধান কাজ। এ ছাড়া ট্রেনিং নিয়ে শহরে ঢোকা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ওষুধ, অর্থ ও অন্য টুকিটাকি জিনিস সংগ্রহ করা। আমরা অবরুদ্ধ দেশে মুক্তি নামে একটি পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলাম, এতে আমার একটি কার্টুন ছাপা হওয়ার কথা ছিল। ছাপার আগমুহূর্তে পুলিশের হানায় তা ভেস্তে যায়। তবে তখন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ লাগো-লাগো অবস্থার কারণে আমাদের বিপদ তেমন ঘটেনি।

১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এ দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রথম ও ঢাকার বাইরে দ্বিতীয় শিল্পশিক্ষার প্রতিষ্ঠান চালু হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে আগে চট্টগ্রামে যে আন্দোলন-সংগ্রাম সূচিত হয়, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক-ছাত্ররা সম্মুখসারিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। শিল্পী রশিদ চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী, মিজানুর রহিম, তখনকার ছাত্র সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, শাহ মোহাম্মদ আনসার আলী, এনায়েত হোসেন, সবিহ উল আলম প্রমুখ মিলে লিথোগ্রাফে করা একটি পোর্টফোলিও প্রকাশ করেন, যা তখন যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। শিল্পী মুর্তজা বশীর প্যারিস প্রবাসে বসে পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে ছবি এঁকেছিলেন।

এভাবে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে, ভারতে বা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থান করে আরও অনেক দৃশ্যশিল্পীই হয়তো স্বদেশের মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় নানা ছোট–বড় প্রয়াসে যুক্ত হয়েছেন। তাঁদের কথা যত বেশি করে জানা যাবে, ততই মুক্তিযুদ্ধে চারুশিল্পীদের অবদান উজ্জ্বলতর মহিমায় প্রতিভাত হবে।