‘বাঘটা কাঁদছে।’
নাশতা শেষ করে বাবান চলে গিয়েছিল তার রুমে। ফিরে এসে এ কথা বলল।
শুনে মা-বাবা দুজনই অবাক। বাবা চায়ে
চুমুক দিতে গিয়ে থামলেন, ‘কোথায় বাঘ কাঁদছে, বাবান?’
‘রতনপুর গ্রামে।’
মা বললেন, ‘রতনপুরে তো আমাদের খামারবাড়ি। সেখানে বাঘ এল কোত্থেকে?’
‘এসেছে। বাঘটা কাঁদছে। তার ভারি কষ্ট।’
বাবা হাসলেন, ‘তুমি কি স্বপ্ন দেখেছ?’
‘না। স্বপ্ন দেখিনি।’
মা বললেন, ‘তাহলে কী করে বলছ, রতনপুরে বাঘ এসেছে?’
‘এসেছে, মা। বাঘটা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “বাবান, আমার ভারি কষ্ট। তুমি আমাকে বাঁচাও।”’
মা–বাবা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন।
বাবান বলল, ‘বাবা, আমি রতনপুরে যাব। ব্যবস্থা করো।’
বাবান আর কথা বলল না। নিজের রুমে
চলে গেল।
বাবা বললেন, ‘কী করা যায় এখন?’
মা বললেন, ‘যাওয়া উচিত। তুমি দেখেছ না, বাবান যা বলে তা মিলে যায়। চলো, কাল সকালে রতনপুরে যাই। খামারটা দেখে এলাম। বাংলোয় কয়েক দিন কাটিয়ে এলাম। বেড়ানোও হলো, বাঘের ব্যাপারটাও জানা হলো।’
‘ঠিক আছে। চলো, যাই তাহলে।’
পরদিন মা–বাবার সঙ্গে রতনপুরে এল বাবান। এখানে তাদের বিশাল কৃষিখামার।
বাংলোবাড়িতে গাড়ি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ম্যানেজার লিয়াকত এগিয়ে এল। বাবানকে নিয়ে মা–বাবা নামলেন। কেউ কোনো কথা বলার আগেই বাবান বলল, ‘লিয়াকত আঙ্কেল, বাঘটা কোথায়?’
লিয়াকত সাহেবের সঙ্গে খামারের আরও কয়েকজন আছে। বাবানের কথা শুনে তারা তেমন অবাক হলো না। মা–বাবা অবাক।
লিয়াকত সাহেব হাসলেন, ‘তুমি তাহলে জেনে গেছ, এই গ্রামে একটা বাঘ আছে?’
বাবান বলল, ‘হ্যাঁ, জেনেছি। সে জন্যই তো আজ এসেছি। বাঘটা কোথায়?’
মা–বাবা কেউ কোনো কথা বলছেন না।
লিয়াকত সাহেব বললেন, ‘বাঘটা গ্রামে এসেছে চার দিন হলো। সার্কাসের বাঘ। এই গ্রামের ঘোষবাবুর একটা সার্কাসের দল ছিল। দলটা বন্ধ হয়ে গেছে। হাতি–ঘোড়া–বানরও ছিল দলে। একটা ভালুক ছিল। সবই বিক্রি হয়ে গেছে অল্প দামে। শুধু বাঘটা বিক্রি করা যায়নি। বুড়ো বাঘ কেউ কিনতে চায় না। বেচারা ঘোষবাবু বাঘটা নিয়ে খুব বিপদে আছেন। ঠিকমতো খেতে দিতে পারেন না।’
বাবান বলল, ‘ঘোষবাবুকে ফোন করুন, আঙ্কেল। বাঘটা নিয়ে আসতে বলুন।’
লিয়াকত সাহেব তাকালেন মা–বাবার দিকে।
বাবা বললেন, ‘ঠিক আছে, নিয়ে
আসতে বলুন।’
আধঘণ্টার মধ্যে বাঘ নিয়ে হাজির ঘোষবাবু। বাঘটার গলায় শিকল নেই। সে ঘোষবাবুর পাশাপাশি হেঁটে এল। পেছনে গ্রামের কিছু ছেলেপুলে আছে। তারা কেউ খামারে ঢুকল না। বাঘ নিয়ে ঢুকলেন ঘোষবাবু।
মা–বাবা একটু ভয় পেলেন। সরে যেতে চাইলেন। ঘোষবাবু কথা বলার আগেই বাবান বলল, ‘ভয়ের কিছু নেই, “ওল্ড বয়” কিছু
বলবে না।’
বাবান এগিয়ে গিয়ে বাঘটার সামনে দাঁড়াল। বাঘটা সঙ্গে সঙ্গে এমন ভঙ্গিতে তার পায়ের কাছে মুখ ঘষতে লাগল, যেন কত দিনের চেনা! তারপর মুখ তুলে বাবানের দিকে তাকিয়ে রইল। বাবান বাঘের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বলল, ‘মন খারাপ কোরো না। আমি এসে গেছি। তোমাকে আর না খেয়ে থাকতে হবে না। আমি তোমার নাম রাখলাম “ওল্ড বয়”। বাংলায় হচ্ছে “বুড়ো খোকা”।’
পুরো এক সপ্তাহ খামারবাড়িতে থাকল বাবানরা। ওল্ড বয় সব সময় আছে তার সঙ্গে। সে যেখানে যায়, ওল্ড বয় যায় তার সঙ্গে। ঢাকায় যেমন বিড়াল আর কুকুরটা তার সঙ্গে থাকে, ওল্ড বয় ঠিক তেমন বন্ধু হয়ে গেছে বাবানের।
বাঘ যেন বাবানের কথায় ভারি খুশি হলো। মুখে যেন হাসি ফুটল তার।
‘লিয়াকত আঙ্কেল, কাউকে বাজারে পাঠান। ১০ কেজি গরুর মাংস আনান। “ওল্ড বয়” খাবে। সে তিন দিন ধরে না খেয়ে আছে।’
ঘোষবাবু অবাক, ‘এ কথা তুমি জানলে কী করে, বাবা? সত্যি বাঘটাকে তিন দিন খেতে দিতে পারিনি। শেষ দিকে সার্কাস আর চলত না। ধারদেনায় ডুবে গিয়েছিলাম। সবকিছু বিক্রি করে ধার শোধ করেছি। এখন নিজেরই না খেয়ে থাকার অবস্থা। বাঘকে খাওয়াব কেমন করে?’
বাবান বাবার দিকে তাকাল, ‘বাবা, ঘোষ আঙ্কেলকে আমাদের খামারে চাকরি দাও। তিনি ওল্ড বয়কে নিয়ে খামারেই থাকবেন। তাঁর তো আর কেউ নেই। আছে শুধু ওল্ড বয়।’
বাবানের কথা শুনে সবাই অবাক।
ঘোষবাবু বললেন, ‘ছেলে তো দেখি আমার সব খবরই রাখে! হ্যাঁ, আমি একা মানুষ। এই বাঘটাই এখন আমার সঙ্গী।’
পুরো এক সপ্তাহ খামারবাড়িতে থাকল বাবানরা। ওল্ড বয় সব সময় আছে তার সঙ্গে। সে যেখানে যায়, ওল্ড বয় যায় তার সঙ্গে। ঢাকায় যেমন বিড়াল আর কুকুরটা তার সঙ্গে থাকে, ওল্ড বয় ঠিক তেমন বন্ধু হয়ে গেছে বাবানের। লিয়াকত সাহেবকে বাবা বলে দিয়েছেন, প্রতিদিন ১০ কেজি করে মাংস দিতে হবে ওল্ড বয়কে।
ঘোষবাবুর চাকরিও হয়েছে। তিনিও খামারের একজন ম্যানেজার। তবে তাঁর মূলকাজ হচ্ছে ওল্ড বয়ের দেখাশোনা। তাকে ঠিকমতো খাওয়ানো আর সাবান–শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করানো। গায়ে যেন গন্ধ না হয়।
ফেরার দিন মাকে এক ফাঁকে বাবা বললেন, ‘আমাদের বাবান সত্যি অদ্ভুত ছেলে। পশুপাখির ভাষা বুঝতে পারে। কেমন কেমন করে যেন তাদের কষ্ট–বেদনার কথা সে জেনে যায়। ঢাকায় বসে কেমন করে জানল এখানকার বাঘটার কথা? ভেবে আমি খুবই অবাক হচ্ছি।’
মা বললেন, ‘প্রথম প্রথম আমিও খুব অবাক হতাম। এখন আর হই না। কোনো কোনো মানবশিশু অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। প্রকৃতির ভাষা বুঝতে পারে, পশুপাখির ভাষা বুঝতে পারে। বহুদূর থেকে বিপদে পড়া পশুপাখির বেদনা টের পায়। আমাদের বাবান তেমন শিশু।’