বিশ্বকাপ ফুটবলের সমাপনী অনুষ্ঠানে পড়া হয়েছিল যে কবিতা
এ বছর ফুটবল বিশ্বকাপের জমজমাট ২২তম আসর বসেছিল উপসাগরীয় দেশ কাতারে। স্বাগতিক দেশ হিসেবে নিজেদের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার চেষ্টায় কোনো খামতি বা রাখঢাক রাখেনি তারা। এ বিশ্বকাপের অন্যতম প্রধান আলোচিত বিষয় ছিল ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতি সংহতি। খেলোয়াড় বা দর্শকেরা তো বটেই, এমনকি আয়োজক দেশ কাতারও আনুষ্ঠানিকভাবে এই সংহতি প্রকাশে অংশগ্রহণ করেছে। তাই বিশ্বমঞ্চে ফিলিস্তিন তথা গোটা আরব বিশ্বের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের দাবি তুলে ধরতে স্বাগতিক কাতার আশ্রয় নেয় কবিতার। সম্ভবত প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের সমাপনী অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠের আয়োজন করে দেশটি।
এতে কবিতা পাঠের আমন্ত্রণ জানানো হয় আরব বিশ্বের দুই বিখ্যাত কবিকে। তাঁদের একজন ‘জেরুজালেমের কবি’খ্যাত ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত মিসরের তামিম আল–বারগুছি ও পশ্চিম আফ্রিকান আরব দেশ মৌরিতানিয়ার সিদি মোহামেদ উলদ বেমবা।
দুই কবির মধ্যে তামিমের জন্ম ১৯৭৭ সালে, কায়রোতে। তাঁর বাবা ছিলেন ফিলিস্তিনের আরেক বিখ্যাত কবি মুরিদ আল–বারগুছি, মা মিসরের নামকরা ঔপন্যাসিক রাদওয়া আশুর।
খুব অল্প বয়সেই এমিল হাবিবি, মাহমুদ দারবিশ ও সাদি ইউসুফের মতো বামপন্থী রাজনীতি-প্রভাবিত কবি–লেখকদের সঙ্গে পরিচিত ও প্রভাবিত হন তামিম। তাঁর বিখ্যাত কিছু কাব্যগ্রন্থ হলো: মিজনা (সিরিয়া, লেবানন ও ফিলিস্তিন অঞ্চলে প্রচলিত একধরনের লোককবিতাকে বলা হয় মিজনা; ১৯৯৯), আল মুনজির (অবকাশদাতা; ২০০০), কালু লি: বাতহাব মিসর? (তারা বলে: মিসর ভালোবাসো?; ২০০৫) প্রভৃতি।
বিশ্বকাপের সমাপনী অনুষ্ঠানে তামিম আল-বারগুছি খেলা নিয়ে তাঁর সদ্য রচিত একটি কবিতা পাঠ করেন। কবিতাটির নাম: মা-ল্লাযি য়াদ‘উ-ল মুত’আবিন ইলা-ল লা’ইব (ক্লান্ত মানুষ কেন খেলায় মজে)।
অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত আরেক কবি সিদি মোহামেদ উলদ বেমবা লেখেন আরবি ভাষায়। তবে সমাপনী অনুষ্ঠানে তিনি স্বরচিত কোনো কবিতা পড়েননি, প্রচলিত একটি বিখ্যাত কবিতা আবৃত্তি করেন।
বিশ্বকাপের সমাপনী অনুষ্ঠানে তামিম বারগুছিকে আমন্ত্রণ জানানো ছিল একটি চোখে পড়ার মতো ঘটনা। ফিলিস্তিন ইস্যুতে পশ্চিমাদের দ্বিচারিতার দিকে আঙুল তোলাই ছিল এর উদ্দেশ্য। অনুষ্ঠানে ফিলিস্তিনের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘কুফিয়্যা’ গলায় জড়িয়ে কবিতাটি পড়েন তামিম। এটিও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে প্রকাশিত হলো তামিম আল–বারগুছির সেই কবিতার অনুবাদ। এতে তিনি বলেছেন, ৯০ মিনিটের ফুটবল খেলায় যেমন দুই দলেরই সমান সুযোগ থাকে, দুই দলই যেমন ন্যায় ও সাম্যের ভিত্তিতে খেলায় অংশ নিতে পারে, বাস্তব দুনিয়ায়ও তেমনই ন্যায় ও সাম্য চায় মানুষ।
তামিম আল-বারগুছি
ক্লান্ত মানুষ কেন খেলায় মজে
ক্লান্ত মানুষ কেন খেলায় মজে?
কেন গান গায় দুঃখী প্রাণসকল?
আমার মতো একজন কবি কেন, কিসের টানে
আজ হাজির এমনতর আনন্দসভায়?
খেলা: ছোট এক বিকল্প দুনিয়ায়
অল্প সময়ের সফর; দুই ঘণ্টার সততা ও সমতা।
ধরা যাক—একদল খেলছে উড়ন্ত জুতা পরে,
আরেক দলের পা খালি; একদল দৌড়ে যাচ্ছে মাঠের এ পাশ থেকে ও পাশে,
অথচ মাঝমাঠ পার হতে
অন্য দলের লাগছে ভিসা ও পাসপোর্ট—
খেলায় এমন হয় না।
বল যখন খেলার মাঠে, তখন দুই দলেরই থাকে
শট নেওয়ার সমান সুযোগ। আর খেলা শেষে
সবাই থাকে নিটোল, সতেজ।
শরীর ভেজে শুধুই ঘামে; চিৎকারে থাকে কেবল
স্বাধীন উল্লাসের সুখ।
এ কি শুধুই খেলার নিয়ম? না বন্ধু!
এগুলো এই দেশ, এই জাতির...বরং
অনাদিকাল থেকে গোটা মানবসভ্যতার
প্রস্তাবিত ইশতেহার। কেবল দুই ঘণ্টার নয়,
এ তো অনন্ত জীবনের সুখস্বপ্ন। যখনই ওরা
এই স্বপ্নকে দূরে ঠেলে দিতে চায়, তখনই সে
সত্য হয়ে ঘনিয়ে আসে মানুষের চোখে চোখে।
এ কারণেই ক্লান্ত মানুষ ফিরে আসে
খেলার কাছে; আর দিন শেষে এটাই
আসল আজাদি, সত্য সফলতা, প্রকৃত বিজয়।