২০২১ সালের নোবেলজয়ী আবদুলরাজাক গুরনাহর সাক্ষাৎকার

নোবেলজয়ী ঔপন্যাসিক আবদুলরাজাক গুরনাহ। এই কথোপকথনে উঠে এসেছে কথাসাহিত্য ও বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি। বলেছেন নিজের আত্মপরিচয় প্রসঙ্গেও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রফিক–উম–মুনীর চৌধুরী মোজাফ্​ফর হোসেন

প্রশ্ন:

রফিক–উম–মুনীর চৌধুরী:পনি কেন আপনার মাতৃভাষা কিসোয়াহিলিতে না লিখে ইংরেজিতে লিখতে শুরু করলেন?

২০২১ সালের নোবেলজয়ী ঔপন্যাসিক আবদুলরাজাক গুরনাহ
ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

আবদুলরাজাক গুরনাহ: কারণ, আমি মনে করি লেখালেখির জন্য একটি ভাষা নির্বাচন করে নিতে হয়, বিশেষ করে যদি কারও বিকল্প থাকে। আমি কাউকে বলে দিতে চাই না, তুমি এই ভাষায়  লিখো বা লিখো না। এ ক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত নয়। কেউ কেউ অন্যভাবে চিন্তা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। তাই আমি বলি, যে যে ভাষায় লিখছেন, সেটা হতে পারে ফরাসি বা বাংলা, সেটা তাঁদের যাঁর যাঁর ব্যাপার। আর অন্যদিকে আমি ঔপনিবেশিক বাস্তবতার মধ্যে বেড়ে ওঠার কারণে স্কুলে থাকতেই ইংরেজি ভাষা শিখি এবং ইংরেজি বই পড়তে শুরু করি। তাই এই ভাষায় লিখতে, নিজেকে প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি, উপভোগ করি। এই ভাষার সঙ্গে আমার সম্পর্ক তৈরি হওয়ার পেছনে অনেকগুলো ঘটনা আছে। লেখালেখির প্রথম থেকেই ভাষাটি আমার কাছে চলে এসেছে। কখনো মনে হয়নি, আমার কোনো বিকল্প আছে। কারণ, এই ভাষা আমার আত্মস্থ হয়েছিল।

রফিক: আমার পাঠ থেকে মনে হয়েছে, আপনি খুব সাধারণভাবে গল্পটা বলা শুরু করেন, কিন্তু  যখন আপনি ন্যারেটিভের কেন্দ্রে প্রবেশ করেন, তখন সেটা হালকা থাকে না, বিশদ বিবরণে পরিণত হয়। পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ছোট ছোট ঘটনা কোলাজ চিত্রের মতো যুক্ত হয়ে আমাদের সামনে একটি ইতিহাস, একটি সমাজ উন্মোচন করে, যেটা সম্পর্কে আমরা এখান থেকে খুব কমই জানি। বিশেষ করে জানজিবার বা পূর্ব আফ্রিকার একটা বড় চিত্র আমাদের সামনে উঠে আসে। আপনি কি উপন্যাস লেখার সময় ভাষা নিয়ে অনেক ভাবনাচিন্তা করেন? আমরা জানি, অনেক লেখকই কাঠামো নিয়ে বিস্তর ভাবেন।

আবদুলরাজাক: নিশ্চয়ই। উপন্যাস লেখার আনন্দটাই হলো কাহিনিকে একটি নির্দিষ্ট দিকে এগিয়ে নেওয়া, কখন কীভাবে কোন চরিত্র সামনে আনতে হবে, কোথায় কখন মোচড়টা দিতে হবে—এগুলোর মধ্যে। পাণ্ডুলিপি যখন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়, তখন অবশ্যই ভালো লাগে; কিন্তু লেখার সময়ের আনন্দের সঙ্গে সেটা তুল্য নয়।

প্রশ্ন:

মোজাফ্​ফর হোসেন:পনার উপন্যাস পড়ার সময় মনে হতে পারে, দুজন মানুষ নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। একজন আঠারো বছরের তরুণ, যিনি জানজিবারে থাকেন, আরেকজন সফল লেখক, যিনি ব্রিটেনে থাকেন। দুই দেশের, দুই সময়ের দুজন মানুষের বোঝাপড়ার গল্প এটা। আপনার কী মনে হয়?

আবদুলরাজাক: এটা কেউ ভাবতে পারেন। তবে একই সঙ্গে আমি যে পৃথিবীতে বাস করি, তার সঙ্গেও আমার সংলাপ এটা। শুধু ব্যক্তিসত্তার ব্যাপার নয়। ইতিহাস, ঘটনা আরও অনেক কিছু—শুধু দুজন মানুষের বোঝাপড়ার বিষয় নয়।

প্রশ্ন:

মোজাফ্​ফর: আমরা কি তবে বলতে পারি, আপনি ব্যক্তিগত নয়, জাতিগত স্মৃতি নিয়ে লিখছেন?

আবদুলরাজাক: আমি এভাবেও বলতে পারি, এটা একটা সম্মিলিত ব্যাপার। শুধু কোনো কিছু মনে রাখার বিষয় নয়, বিষয় হলো, কেন মনে রাখব আমরা। আমি খুব বড় বড় বিষয় নিয়ে লিখি না, যেমন একটু আগে (ঢাকা লিট ফেস্টে সদ্য শেষ হওয়া সেশনে) আবহাওয়া পরিবর্তন নিয়ে কথা হচ্ছিল। আমি অনেক ছোট ছোট বিষয় নিয়ে লিখি, যেগুলো আমাদের ব্যক্তিজীবনে প্রভাব রাখে।

প্রশ্ন:

মোজাফ্​ফর: আমরা যদি আপনার উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তানজানিয়া বা পূর্ব আফ্রিকা সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করি; সেটা কতটা নির্ভরযোগ্য হবে?

আবদুলরাজাক: প্রথমত, আমি ইতিহাসবিদ নই, ঔপন্যাসিক। তবে আমার উপন্যাসে ঐতিহাসিক অনেক ঘটনাপ্রবাহ আছে। ইতিহাসের অনেক ঘটনা আমাদের এখনো তাড়িত করে। যেমন ধরুন, বিশ্বযুদ্ধ বা ঔপনিবেশিক শাসন—এগুলো আমার লেখার মধ্যে এসেছে। তাই, হ্যাঁ, আপনি যদি বলেন, আমার লেখা ইতিহাস না উপন্যাস? আমি বলব, আমি দুটো একসঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। আমার কাছে এ দুটো আলাদা কিছু নয়।

প্রশ্ন:

রফিক: অভিবাসন কি স্বদেশকে নিয়ে লেখার কাজটি সহজ করে? অবস্থানগতভাবে দূর থেকে দেখা কি লেখালেখির কাজটাকে সহজ করে দেয় নাকি ব্যাপারটা জটিলতর?

আবদুলরাজাক: একটা ধারণা তো আছেই, দেখার অনেক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে দেয় দূরত্ব। চিন্তা করার অনেক অবসর দেয়। কিন্তু যখন ঘটনার মধ্যে থাকা হয়, বিষয়টি অন্যভাবে কাজ করে। আবার যখন আমরা দূরে চলে যাই, দূর থেকে কল্পনা করি অবস্থাটা—যেমন ধরুন, একজন আফগানিস্তানের মানুষ যদি দূরে নিরাপদ অবস্থান থেকে তাঁর দেশকে চিন্তা করেন, তাহলে তাঁর জন্য বিষয়টা আরও অনেক বেশি কষ্টদায়ক হবে। কারণ, আপনি যদি ঘটনার মধ্যে থাকেন, তখন আপনার কিছু করার থাকে। আপনি সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারেন। তাই আমি—দূর থেকে লেখা সহজ, এভাবে সরল সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চাই না।

প্রশ্ন:

মোজাফ্​ফর: এই যে আপনাকে বলা হয়ে থাকে ‘ব্রিটিশ-তানজানিয়ান’, আপনি আপনার এই ‘হাইফেনেটেড আইডেন্টিটি’কে কীভাবে দেখেন?

আবদুলরাজাক: আমি হাইফেনেটেড নই। আমি দুটোই—তানজানীয় ও ব্রিটিশ।

প্রশ্ন:

মোজাফ্​ফর: আমরা দেখি ডায়াসপোরা লেখকদের অনেকের ক্ষেত্রে তাঁদের টেক্সট নিয়ে মাতৃভূমিতে একধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। বিশেষ করে নাইপল ও রুশদির কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। তাঁরা যখন ভারত বা এই উপমহাদেশ নিয়ে লিখছেন, তখন তাঁদের বিরুদ্ধে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তুলছে একটা শ্রেণি। আপনি তানজানিয়া বা জানজিবার নিয়ে যখন লেখেন, তখন তাদের প্রতিক্রিয়া কেমন থাকে?

আবদুলরাজাক: খুব ভালো। তারা আমাকে ভালোবাসে। আমি নাইপল নই। আমি ও রকম ‘বিশ্রী’ বিষয় লিখি না। বিশেষ করে নাইপল যেভাবে সবাইকে আক্রমণ করে লিখেছেন, সেটা আমি করি না। আমি আমার জন্মভূমিতে ভালোভাবেই গৃহীত।

প্রশ্ন:

মোজাফ্​ফর: আপনাকে বলা হয়ে থাকে ঔপনিবেশিক শাসন পরবর্তী সাহিত্যের লেখক। নিজেকে আপনি কীভাবে দেখেন?

আবদুলরাজাক: ঠিক ওভাবে ভাবি না। আমার পরিচিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠলে শুধু নিজের নামটাই বলব। নিজেকে আমি কোনো বিশেষ পরিচয়ে বেঁধে দিতে চাই না।

প্রশ্ন:

মোজাফ্​ফর: মুসলিম দেশগুলোয় ধর্মীয় বিষয় নিয়ে লেখা খুব কঠিন। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, এখানেও ধর্মীয় মৌলবাদ, উগ্রবাদ বেড়ে গেছে। মুক্তমতচর্চার জন্য আমাদের লেখকদের জীবনও দিতে হয়েছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

আবদুলরাজাক: ব্যাপারটা আসলে সবার বিষয়। ভুক্তভোগী লেখকেরা এটা নিয়ে ভালো লিখতে পারবেন। আপনারা যাঁরা এখানে বাস করছেন, তাঁরা এটাকে কীভাবে দেখছেন, সেটাই হলো প্রধান বিষয়। আর আমরা কীভাবে সমষ্টিগতভাবে এ বিষয় সম্পর্কে ভাবছি, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশ্ন:

মোজাফ্​ফর: উদ্বাস্তু সমস্যা আগামী দিনের ন্যারেটিভে কী ধরনের পরিবর্তন আনবে?

আবদুলরাজাক: পৃথিবীতে চিরস্থায়ী বলে কিছু নেই। পরিবর্তন একটা ঘটে যাচ্ছে। কোথায়, কীভাবে বেশি পরিবর্তন আসবে, সেটাও একটা প্রশ্ন বটে। কার পরিবর্তন ঘটবে? উদ্বাস্তুদের নাকি আশ্রয়দানকারী দেশের? এর সঙ্গে ভাষা ও সংস্কৃতিরও পরিবর্তন ঘটবে, সেটা উভয় পক্ষেরই।

প্রশ্ন:

মোজাফ্​ফর: পরিবর্তিত এই পৃথিবীতে বিশ্বসাহিত্যের ভূমিকা কী হতে পারে?

আবদুলরাজাক: এটা নির্ভর করছে বিশ্বসাহিত্য বলতে আমরা কী বুঝি, তার ওপর। সাহিত্যের ভূমিকা হলো সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এই এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি সব সমাজের জন্য এক রকম নয়। আমার মনে হয়, সমাজের ভেতরকার ভাবনাগুলো নিয়ে আমাদের প্রশ্ন তুলতে হবে

আবদুলরাজাক গুরনাহ

আবদুলরাজাক গুরনাহ

জন্ম: ২০ ডিসেম্বর ১৯৪৮, জানজিবার দ্বীপ, তানজানিয়া

জাতীয়তা: তানজানীয়, ব্রিটিশ

পূর্বপুরুষের দেশ: ইয়েমেন

মাতৃভাষা: কিসোয়াহিলি 

লেখালেখির ভাষা: ইংরেজি

দেশত্যাগ: ১৯৬০

পড়াশোনা: ‘ক্রাইটেরিয়া ইন দ্য ক্রিটিসিজম অব ওয়েস্ট আফ্রিকান ফিকশন’–এর ওপর পিএইচডি

কর্মজীবন: অধ্যাপনা—নাইজেরিয়ার বায়েরো বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৮০-৮২) ও কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৮৫-২০১৭)

উল্লেখযোগ্য উপন্যাস: মেমোরি অব ডিপারচার (১৯৮৭), পিলগ্রিমস ওয়ে (১৯৮৮) ডটি (১৯৯০), প্যারাডাইস (১৯৯৪), অ্যাডমায়ারিং সাইলেন্স (১৯৯৬), বাই দ্য সি (২০০১), গ্র্যাভেল হার্ট (২০১৭)

আফটারলাইভস্ (২০২০)

পুরস্কার: সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার (২০২১)