ঢাকায় অন্য রবীন্দ্রনাথ

আজ বাইশে শ্রাবণ। কবি গুরুর প্রয়াণ দিবস। তিনি ১৯২৬ সালের শুরুর দিকে ঢাকায় এসেছিলেন। এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে। কবির প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে কিছু স্মৃতি উঠে এসেছে আর সি মজুমদারের ‘জীবনের স্মৃতিদীপে’ নামের আত্মজীবনীতে।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২৫ বৈশাখ ১২৬৮—২২ শ্রাবণ ১৩৪৮)
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে ১৯২৬ সালের শুরুর দিকে ঢাকায় এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদারের বাড়িতে, আর সি মজুমদার নামে যিনি খ্যাতিমান। আর সি মজুমদার তখন জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট। প্রভোস্টের বাড়ি তখন ঢাকার নতুন শহর রমনায়। পরে তিনি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।

‘অসাহিত্যিক’ প্রভোস্টের বাড়িতে বিশ্ববরেণ্য কবি কেন থাকবেন, তা নিয়ে রবীন্দ্র অনুগারীরা তখন জল কম ঘোলা করেননি। জয় আর সি মজুমদারেরই হয়েছিল। সেই কয়েকটি দিনের কথা তিনি লিখে গেছেন তাঁর ‘জীবনের স্মৃতিদীপে’ নামের আত্মজীবনীতে। এই আত্মজীবনীতে পাওয়া যায় অন্য এক রবীন্দ্রনাথকে।

বইটির এক জায়গায় খুঁজে পাওয়া যায় ৬৫ বছর বয়সী ভোজনরসিক রবীন্দ্রনাথকে। ঢাকায় বড় বড় কই মাছ পাওয়া যেত। কবিকে প্রতিদিন একটি তাবড় আকারের কই মাছ দেওয়া হতো। অন্যান্য তরিতরকারির সঙ্গে তিনি পুরো মাছটি খেতেন। খেয়ে খুব খুশি হয়ে বলতেন, ‘পূর্ব বাংলার মতো মাছ রান্না আমাদের ওদিকে করতে পারে না।’

রবীন্দ্রনাথের আরেকটি বিষয় ছিল, তাঁর স্নানের পারিপাট্য। ঢাকায় আসার আগেই তিনি চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, তাঁর জন্য যেন একটি বাথটাবের ব্যবস্থা করা হয়। আর সি মজুমদারের বাড়িতে সে ব্যবস্থা ছিল না, তবে বন্দোবস্ত করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘স্নানের ঘরে দেখতাম নানা রকম অনেকগুলো শিশি তিনি রেখে দিয়েছেন। অন্তত এক ঘণ্টা ধরে স্নান করতেন। স্নান সেরে প্রতিদিনই একটি নতুন আলখাল্লার মতো পোশাক পরতেন। আমার স্ত্রীকে বলতেন, “দেখো তো পোশাকটা ঠিক হয়েছে কি না।”’

স্নানের এমন আয়োজনের তুলনায় রবীন্দ্রনাথের অন্য একটি বিষয়ে ‘আশ্চর্য’ হয়েছিলেন গ্রন্থকার। রবীন্দ্রনাথ নিজের সঙ্গে একজন ভৃত্য এনেছিলেন। খাটের ওপর সে কবির জন্য বিছানা করেছিল। তা দেখে অবাক হন আর সি মজুমদারের স্ত্রী। ‘কারণ বিছানাটি বেশ ময়লা। তোশক এবং বালিশও ছেঁড়া।’ সেটি বদল করে কবির জন্য নতুন একটি বিছানা পেতে দেওয়া হলো। আর সি মজুমদার লিখেছেন, কবির দৃষ্টি ছিল তীক্ষ্ণ। ঘরে এসেই তফাৎটা বুঝতে পেরে বললেন, ‘এসবই তোমাদের ব্যবস্থা দেখছি।’ ভৃত্যের নাম উল্লেখ করে বললেন যে এটা তাঁর পাতা বিছানা তো মোটেই নয়।

রবীন্দ্রনাথ চাইতেন তাঁর আশপাশের সবাই সব সময় পরিপাটি হয়ে থাকুক। একবার আর সি মজুমদারের স্ত্রী সাদামাটা একটা শাড়ি পরে কবির সামনে গিয়েছিলেন। খানিকটা বিরক্ত হয়ে কবি বললেন, ‘মেয়েদের এই আটপৌরে শাড়ি পরা এটা বড় খারাপ লাগে। তোমরা বেশ সেজেগুজে আমার সামনে আসবে; ভালো শাড়ি ভালো জামা।’

আর সি মজুমদারের স্ত্রীর পান খাওয়ার অভ্যাস ছিল। একদিন কথায়–কথায় রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘আমাদের ছেলেবেলায় গুরুজনের সামনে পান খাওয়া দোষের ছিল।’ তিনি মুখ ধুয়ে খানিক পরে যেতেই কবি বললেন, ‘তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? পান খাওনি বুঝি।’ তিনি বললেন, ‘আপনি তো বলেছেন গুরুজনের সামনে পান খাওয়া দোষের।’ কবি হো হো করে হেসে উঠে বললেন, ‘আরে সে তো আমাদের ছেলেবেলার কথা—যাও পান খেয়ে এসো।’

নতুন শহর রমনার চারদিক তখন মুক্ত প্রান্তর। প্রতিটি বাড়িতেই অনেকটা করে ফাঁকা জমি। একদিন আর সি মজুমদার কবিকে ‘ঢাকার পুরোনো শহর’ দেখাতে নিয়ে গেলেন। পুরোনো শহর অতি নোংরা, রাস্তাগুলো অত্যন্ত সরু। রবীন্দ্রনাথ ফিরে এসে বললেন, ‘তোমাদের ওই পাড়ার নাম বদলানো উচিত।’ আর সি মজুমদার বললেন, কেন? কবি বললেন, ‘শহরের ওই অংশের নাম সার্থক—ঢাকা। এই রমনার নাম হওয়া উচিত “খোলা”।’

আর সি মজুমদারের দোতলার যে ঘরে রবীন্দ্রনাথ থাকতেন, তার সামনে একটি আমগাছ ছিল। গাছটি মুকুলে ভরে গিয়েছিল। সকালে চা পানের পর রবীন্দ্রনাথ ওই ঘরের বারান্দায় একটি ইজিচেয়ারে বসে থাকতেন। বলতেন, এভাবে বসে থাকতে ভারী ভালো লাগে।

কবির চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটবে ভেবে আর সি মজুমদার তাঁর পরিবারের সদস্যদের বারণ করে দিয়েছিলেন যাতে সকালবেলা কেউ বারান্দায় না আসে। দু-তিন দিন নিরাপদে কাটল। একদিন সকালে লেখকের ১২–১৩ বছরের মেয়ে কবিকে গিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আপনি নাকি খুব বড় কবি। আপনি নাকি অনেক কবিতা লিখেছেন।’ রবীন্দ্রনাথ একটু হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, এই দুর্নাম আমার আছে।’

অমনি একটি ছোট খাতা বের করে মেয়েটি বলল, ‘আমার নামে একটা কবিতা লিখে দিন না।’ রবীন্দ্রনাথ মেয়েটির ভালো নাম ও ডাকনাম জিজ্ঞেস করলেন। তৎক্ষণাৎ তার সেই ছোট খাতায় তারই কলমে একটি কবিতা লিখে দিলেন, যার মধ্যে দুটি নামই আছে। আর সি মজুমদার লিখেছেন, তাঁর মেয়ে বড় হয়ে বুঝতে পেরেছিল, এ তাঁর জীবনের কত বড় সম্পদ। মেয়ের বিয়ের সময় কবিতাটি প্রতিলিপিসহ ছাপিয়েছিলেন তিনি।

পরে ‘স্ফুলিঙ্গ’ নামে কাব্যপুস্তিকা ও রবীন্দ্র–রচনাবলিতে কবিতাটি স্থান পায়। এ নিয়ে কিছুটা আক্ষেপ ছিল আর সি মজুমদারের। কারণ, তাতে ‘ঘটনাটির কোনো উল্লেখ নেই।’