কারা ছিলেন হেমিংওয়ের প্রেমিকা

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। জগদ্বিখ্যাত এই লেখকর জীবন ছিল বিচিত্রমাত্রিক। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে পাঠকের আগ্রহের শেষ নেই। চার স্ত্রী— হ্যাডলি রিচার্ডসন, পলিন ফাইবার, মার্থা গেলর্হন ও মেরি ওয়ালেশ ছাড়াও অসংখ্য নারী এসেছিলেন তাঁর জীবনে। তাঁর বিভিন্ন লেখায় কখনো সরাসরি আবার কখনো নামে-বেনামে এসব নারীর উপস্থিতি চোখে পড়ে। মার্কিন এই কথাশিল্পীর জীবনের আরেক অধ্যায় তাঁর গোয়েন্দাজীবন। এসব নিয়ে সংশয় ও বির্তকের শেষ নেই। সম্প্রতি বইমেলা উপলক্ষে প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে লেখক–গবেষক ফারুক মঈনউদ্দীনের লেখা বই ‘গোয়েন্দা হেমিংওয়ে ও তাঁর প্রেমিকাদের খোঁজে’। এই বইয়ের একটি অংশে আছে তাঁর প্রথমদিককার প্রেমিকাদের কথা। সেখান  থেকে অংশবিশেষ।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে

হেমিংওয়ের প্রথম জীবনের বান্ধবী এবং পরিচিতাদের মধ্যে মার্জোরি বাম্প, পলিন স্নো, কেটি স্মিথ কিংবা প্রুডেন্স বৌলটনের নাম বহু জীবনীকারের অনুসন্ধান ও লেখায় উঠে এসেছে, যাঁদের সবাইকে তিনি বিভিন্ন গল্পের চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু ক্যাথরিন লংওয়েল নামের আরেক তরুণীর খোঁজ পাওয়া যায়, যাঁর কথা প্রকাশ করেছেন আমেরিকান সাংবাদিক ও লেখক রবার্ট কে এলডার। তিনি ছাড়া এই তরুণীর কথা একমাত্র উল্লেখ করেছেন জীবনীকার কার্লোস বেকার।

জানা যায়, হেমিংওয়ে যখন পায়ে আঘাত নিয়ে ভগ্নহৃদয়ে ইতালি থেকে ফিরে আসেন, সে সময় এই ক্যাথরিনের সঙ্গে তাঁর কিছু রোমান্টিক মেলামেশার ঘটনা ঘটেছিল। সেই সংক্ষিপ্ত সময়ের সান্নিধ্যের কথা ক্যাথরিন বলে গেছেন হেমিংওয়ের ভাই লেস্টারকে। তাঁরা দুজনে মিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দে প্লেইনস নদীতে ডিঙি চালিয়ে ঘুরে বেড়াতেন, ক্যাথরিনের বাড়িতে বসে শহর থেকে কিনে আনা ইতালিয়ান কেক খেতে খেতে নিজের লেখা নতুন গল্প পড়ে শোনাতেন তরুণ লেখক হেমিংওয়ে। স্বল্প সময়ের সঙ্গিনী হিসেবে, এমনকি কোনো গল্পের চরিত্রও হননি বলে হেমিংওয়ের জীবনীকারেরা এই তরুণীর বিষয়ে বিশেষ কিছু আবিষ্কার করেননি কিংবা খুব গুরুত্ব দেননি এই সম্পর্ককে। কিন্তু জানা গেছে, ক্যাথরিনের প্রতি হেমিংওয়ে এতই ঝুঁকে পড়েছিলেন যে ইতালির যুদ্ধে তাঁর ব্যবহৃত একটা পোশাক তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু হেমিংওয়ের মা ব্যাপারটা পছন্দ করেননি, এমনকি পোশাকটা ফেরত চেয়েছিলেন। আহতাবস্থায় ইতালির হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সেরে ওঠার পর ১৯১৯ সালের এপ্রিলে পোস্ট কার্ডে ক্যাথরিনকে একটা চিঠি লিখেছিলেন হেমিংওয়ে।

অ্যারন ভেচ ও মার্ক সিরিনোর সঙ্গে যৌথভাবে লেখা ‘হিডেন হেমিংওয়ে: ইনসাইড দ্য আর্নেস্ট হেমিংওয়ে আর্কাইভস অব ওক পার্ক’ বইটির মালমসলা সংগ্রহের সময় স্বল্প পরিচিতা এই তরুণী সম্পর্কে প্রথম জানতে পারেন এলডার। ওক পার্ক অঞ্চলে হেমিংওয়ে সম্পর্কে একটা ধারণা প্রচলিত ছিল যে তিনি মেয়েদের ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিলেন না, যা এলডারের অনুসন্ধানী চোখে সঠিক বলে মনে হয়নি। ওক পার্ক স্কুলের সমসাময়িক শিক্ষার্থীরা যা-ই বলুন না কেন, এলডার আবিষ্কার করেছেন যে হেমিংওয়ে তাঁর সহপাঠিনী অ্যানেথ ডেভোর সঙ্গে গোপনে ডেটিং করতেন, একটা বেশ আবেগপূর্ণ কবিতাও লিখেছিলেন তাঁকে নিয়ে, তবে কবিতাটি তাঁকে দিয়েছিলেন কি না, সে সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। কবিতাটি ছিল এ রকম, ‘তোমার সঙ্গে নরকের ভেতর দিয়েও সানন্দে হেঁটে যাব আমি/ কিংবা দেব এই জীবন বিসর্জন।’  

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের প্রথম প্রেমিকা অ্যাগনেস ফন কুরোওস্কি

ধারণা করা হয়, ইতালির হাসপাতালের নার্স অ্যাগনেস কুরোওস্কির ব্যর্থ প্রেমের ক্ষতে প্রলেপ বোলানোর জন্য ক্যাথরিনের প্রতি ঝুঁকেছিলেন হেমিংওয়ে। হেমিংওয়ের জীবনের এই অজানা অধ্যায় সম্পর্কে খোঁজখবর করার একপর্যায়ে ক্যাথরিনের ছেলে পিটার ডেভিসের সাক্ষাৎ লাভ করেন এলডার। ডেভিস জানান, তাঁর মা হেমিংওয়ে সম্পর্কে কিছু বলতে চাইতেন না। তাঁর ধারণা, মায়ের নির্দেশে ক্যাথরিনের কাছ থেকে নিজের উপহার দেওয়া পোশাকটা ফেরত নেওয়ার পর বিব্রত হেমিংওয়ে তাঁকে যুদ্ধে পাওয়া একটা মেডাল দিয়েছিলেন, কিন্তু সেটিও দীর্ঘদিনের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে। হেমিংওয়ের ভাই লেস্টারও তাঁর বইতে জানিয়েছেন, হেমিংওয়ে ইতালির রণাঙ্গনে বীরত্বের জন্য দুটি পদক পেয়েছিলেন—একটি ব্রোঞ্জ এবং আরেকটি রৌপ্যপদক। রুপারটি তিনি তাঁর এক বান্ধবীকে উপহার দিয়েছিলেন। বোঝা যায়, এই বান্ধবীটিই ক্যাথরিন। এলডারের তথ্য থেকে জানা যায়, ক্যাথরিনের সঙ্গে যখন ডেভিসের বাবা হাওয়ার্ড ডেভিসের বাগ্‌দানপর্ব চলছিল, সে সময়ও তাঁদের বাড়িতে আসা-যাওয়া ছিল হেমিংওয়ের। এমনকি তাঁদের পিয়ানোর ওপর হেমিংওয়ের একটা ছবিও থাকত।

তাঁদের দুজনের মধ্যকার রোমান্টিক সম্পর্ক কত দিন টিকে ছিল, জানা যায়নি। তবে ডেভিস তাঁর মায়ের সঙ্গে একবার কিউবা ভ্রমণে গিয়েছিলেন; তখনো ফিদেল কাস্ত্রো ক্ষমতায় আসেননি। ডেভিস জানান, তাঁর মায়ের সঙ্গে হেমিংওয়ের টেলিফোন আলাপ চলেছে দীর্ঘদিন, যদিও তাঁর সঙ্গে বিখ্যাত হয়ে ওঠা এই লেখকের আর কখনোই দেখা হয়নি। ডেভিস এটাও বলেন, ‘বিশ্বাস করুন, আমার মা যে হেমিংওয়েকে বিয়ে করেননি, তাতে আমি খুশি। কী একটা উন্মাদ জীবন!’

তাঁদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হওয়ার বিশেষ কোনো কারণ জানা যায়নি, তবে ধারণা করা যায়, হেমিংওয়ে মিশিগান চলে যাওয়ার পর সম্পর্কের স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছিল।

লুসি মার্জোরি বাম্প

হেমিংওয়ের কলেজজীবনের আরেক বান্ধবীর খোঁজ পাওয়া যায় এলডারের সুলুকসন্ধানের সুবাদে—তাঁর নাম ফ্রান্সেস এলিজাবেথ কোটস। দুজন একই ক্লাসে পড়তেন এবং এই তরুণীর সঙ্গেও হেমিংওয়ের একটা পরিণতিহীন সম্পর্ক হয়েছিল। কোটসের নাতনি বেটসি ফেরমানোর সংগ্রহে থাকা তাঁদের দুজনের কিছু চিঠিপত্র আবিষ্কার করার পর এই সম্পর্কের ব্যাপারে আলোকপাত করেছেন এলডার। আমরা জানি, কলেজজীবন শেষ করার পর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এক মর্টার হামলায় মারাত্মক আহত হয়ে হেমিংওয়ে ভর্তি হয়েছিলেন মিলানের রেডক্রস হাসপাতালে। সে সময় হাসপাতাল থেকে ফ্রান্সেসের কাছে লেখা হেমিংওয়ের চিঠি সযত্নে গচ্ছিত ছিল তাঁর (ফ্রান্সেস) নাতনি বেটসির কাছে। সেই চিঠির একটির তারিখ ছিল ১৫ অক্টোবর ১৯১৮—হেমিংওয়ে আহত হয়েছিলেন একই বছরের জুন মাসে। ধারণা করা যায়, অ্যাগনেস কুরোওস্কির সঙ্গে তখনো হেমিংওয়ের সম্পর্ক তৈরি হয়নি। সুতরাং হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তাঁর মনে পড়েছিল একসময়ের ঘনিষ্ঠ সহপাঠিনী ফ্রান্সেস এলিজাবেথ কোটসের কথা, যাঁর সঙ্গে কলেজে একটা সাহিত্যপত্রিকা বের করার জন্য কাজ করেছিলেন তিনি। হাসপাতালে রাতের খাবারের ট্রের উল্টো পাশে কাগজ রেখে বেয়নেটের সঙ্গে আটকানো মোমবাতির আলোতে চিঠিটা লিখেছেন বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। এরপর লেখেন, ‘এখন আমি ইতালীয় ভাষায় প্রেমপত্র পড়তে, বলতে ও লিখতে পারি।...কাউকে “আমার মূল্যবান সম্পদ” ডাকার মতো পরিস্থিতি হবে বলে ভাবিনি কখনো, কিন্তু “তেসোরো মিআ” কথাটা কলম থেকে বেরিয়ে গেল।’

এখানে উল্লেখ করা দরকার, ইতালিয়ান ভাষায় “মিআ তেসোরো”র ইংরেজি অর্থ ‘মাই ডার্লিং।’ ভুল বানানে ইতালীয় ভাষায় তিনি সেটিই লিখেছিলেন ফ্রান্সেসকে।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে এই সুন্দরী সহপাঠিনীর কথা তাঁর এতটাই মনে পড়ছিল যে তিনি বোন মার্সেলিনকে লেখেন, ‘ফ্রান্সেস কোটসকে ডেকে বলো যে তোমার ভাই মৃত্যুর দুয়ারে। বলবে, দয়া করে যাতে তাকে চিঠি লিখে ও, কোনো ওজর চলবে না। তাকে দিয়ে ঠিকানাটা দুবার বলাবে, যাতে কোনো অজুহাত দিতে না পারে। বলবে যে ওকে ভালোবাসি আমি, কিংবা যা ইচ্ছা বলবে।’  

ফারুক মঈনউদ্দীন

হেমিংওয়ের চিঠিগুলো কোটস যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন বলে সেগুলো থেকে বোঝা যায়, তিনিও লিখেছিলেন উদীয়মান এই লেখককে। তবে সেসব চিঠি হারিয়ে গেছে। হেমিংওয়ে তাঁর একটা চিঠির জবাবে লিখেছিলেন, ‘ভীষণ সুন্দর তোমার চিঠিটা, যত্ন করে রেখে দেব ওটা। কারণ, আমার ভেতর সব সময় বিরাট আর মারাত্মক এবং তীব্র একটা কৌতূহল ছিল, তোমার হাতের লেখা কেমন সেটা দেখা।...কিন্তু সত্যিই ফ্রান্সেস, এটা ছিল বর্ণনাতীত রকম সুন্দর একটা চিঠি...।’

বেটসি ফেরমানোর কাছে পাওয়া অন্য নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে মিলানের হাসপাতালের বিছানায় শোয়া হেমিংওয়ে এবং কলেজজীবনে তাঁদের দুজনের ডিঙি নৌকায় ভ্রমণের ফটোগ্রাফ, পত্রিকায় ছাপা হওয়া হেমিংওয়ে-সম্পর্কিত খবর বা লেখার ক্লিপিং, তাঁর সব কটি বিয়ের সংবাদ এবং সবশেষে তাঁর আত্মহত্যার খবর। হেমিংওয়ের কলেজজীবনের একটা ছবিও সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো ছিল ফ্রান্সেসের ঘরে। গবেষক এলডারকে বেটসি ফেরমানো বলেছিলেন যে তাঁর ঠাকুরমা ব্যাপারটাকে খুব বড় করে দেখাননি কখনো, দেখিয়েছেন তাঁরা ছিলেন কেবলই বন্ধু। তাঁদের এই সম্পর্ক আরও গাঢ় হতে পারত, না-ও হতে পারত, তবে সে সময় জন গ্রেস নামের আরেক সহপাঠীর সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে পড়েছিলেন ফ্রান্সেস। হেমিংওয়ে হ্যাডলিকে বিয়ে করার আগের বছর তাঁরা বিয়েও করেছিলেন।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সঙ্গে অন্যেরা

বিয়ে হয়ে গেলেও হেমিংওয়ের সঙ্গে পত্রালাপ চালু ছিল ফ্রান্সেসের, এমনকি হেমিংওয়ের প্রথম বিয়ের পরও। হেমিংওয়ের কাছে ফ্রান্সেসের লেখা শেষ চিঠিটা ছিল ১৯২৭ সালের জানুয়ারি মাসে, সে মাসেই যে হ্যাডলির সঙ্গে হেমিংওয়ের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছে, সেটা তখনো জানা ছিল না ফ্রান্সেসের। তত দিনে হেমিংওয়ের দ্য সান অলসো রাইজেস প্রকাশিত হয়েছে, হেমিংওয়ের প্রথম পুত্র জ্যাক ওরফে বাম্বির বয়স তখন তিন বছর। সেই চিঠিতে ফ্রান্সেস লিখেছিলেন, ‘সবে তোমার দ্য সান অলসো রাইজেস পড়ে শেষ করলাম, আমার চোখের সামনে তুমি এত জীবন্ত হয়ে আছ যে বলতেই হবে, বইটা কী পরিমাণ উপভোগ করেছি আমি। ...যত বছর যাচ্ছে, সময় তোমাকে এক আশ্চর্য মানুষে পরিণত করছে—তোমাকে দেখতে পেলে খুব ভালো লাগত—এক বছরের বেশি হয় মার্সকে [মার্সেলিন] দেখি না—কেউ একজন বলল, তুমি নাকি আসছ। তোমার ছেলের সঙ্গে মানাবে, মুগ্ধ করার মতো এমন সুন্দর একটা মেয়ে আছে আমার—তোমার চমৎকার হ্যাডলির সঙ্গে দেখা হলে খুব ভালো লাগবে... জনও বলছে এই কথা, আমরা দুজনই তোমাদের দেখার অপেক্ষায় আছি।’১৮ চিঠিতে এমন কথা লিখলেও ফ্রান্সেস তাঁর সঙ্গে হেমিংওয়ের ছবির খামটার ওপর লিখেছিলেন, ‘আর্নির ছবি/ আর পঁচিশ বছর পর, উহ্‌! জনকে বিয়ে করেছি বলে আমি কি খুশি?’

গোয়েন্দা হেমিংওয়ে ও তাঁর প্রেমিকাদের খোঁজে
ফারুক মঈনউদ্দীন

প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০২৪
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
দাম: ৫০০ টাকা।
ঘরে বসে বই পেতে অর্ডার করুন: prothoma.com