গ্রামীণ নারীদের গুপ্ত সাধন-সংস্কৃতি

ষাট মার গানের আসরে মূল গায়ক মাজেদা খাতুন (আশা লাঠি হাতে) ও তাঁর সহযোগীদের পরিবেশনা
ছবি: লেখক

গ্রামীণ মানুষের কতই না লোকায়ত বিশ্বাস! এসব বিশ্বাসকে কল্পনার সঙ্গে মিলিয়ে গড়ে উঠেছে একটি আখ্যানমূলক পরিবেশনা। এখানে গানের মধ্য দিয়ে অসুখের নিদান খোঁজেন গ্রামীণ নারীরা। কুষ্টিয়া অঞ্চলের এক লৌকিক পরিবেশনা।

কুষ্টিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামে এক দুপুরবেলা আসরের শুরুতে মূল গায়ক মাজেদা খাতুনের নেতৃত্বে জাহানারা বেগম, বানে আরা খাতুন, জমেলা খাতুন ও আনোয়ারা বেগম সমবেতভাবে গেয়ে ওঠেন বন্দনাগীত,Ñ‘প্রথমে সালাম জানাই আমি আল্লাহ গুরুর চরণে/ আহারে আল্লাহ রসুল আমারে/ তারপরে সালাম জানাই আমি আল্লাহ রাসুলের চরণে.../ তারপরে সালাম জানাই আমি পঞ্চপীরের চরণে.../ হাজার হাজার সালাম জানাই আমি মা ফাতেমার চরণে... ।’ এভাবে বন্দনা গেয়ে মূল গায়ক আসরের দর্শকদের উদ্দেশে বলেনÑ‘আসসালামু আলাইকুম।’

২০১৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর আমরা উপস্থিত হয়েছিলাম ‘ষাট মার গান’ নামে এক কৃত্যমূলক গানের আসরে।

বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীদের সৃজনশীলতা অনেক সময় রহস্যময়, কৃত্যমূলক ও গুপ্ত ঐতিহ্য হিসেবে প্রবহমান। তাঁরা এমন কিছু গুপ্ত সাধন-সংস্কৃতির ঐতিহ্যের চর্চাকারী, যা অন্বেষণ করা বেশ কঠিন, শ্রমসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। তেমনি একটি গুপ্ত সাধন-সংস্কৃতি হলো ষাট মার গান। লোকচক্ষুর আড়ালে গ্রামীণ গৃহস্থ নারীরাই এর ধারক-বাহক ও পৃষ্ঠপোষক। গৃহস্থ নারীরা নিজের ও তাঁদের স্বামী-সন্তানদের হিতার্থে ষাট মার গানের মানত ও আয়োজন করে থাকেন। সন্তান বা স্বামী অসুস্থ হলে যখন ডাক্তার-কবিরাজের চিকিৎসায় আরোগ্য লাভে ব্যর্থ হন, তখনই ডাক পড়ে এ গানের শিল্পীদের। আর গানটি যেহেতু চিকিৎসা বা কোনো বাঞ্ছাপূরণের উদ্দেশ্যে করা হয়, সেহেতু গ্রামের নারীরা এখানে কিছুটা গোপনীয়তা রক্ষা করেন।

ষাট মার গানের ‘ষাট’ সংখ্যাটি কেন? কে এই ষাট মা? গানের আসরের আগে মুসলিম ধর্মানুসারী সাধক শিল্পীরা বিভিন্নভাবে আকার–ইঙ্গিতে বোঝাতে চেয়েছেন, ‘এই ষাট মা হলো ষাটজন ওলির মা।’

আসলে কি তাই? এই উত্তরের জন্য গভীরভাবে এই গান পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

ষাট মার গান সম্পর্কে শুনেছিলাম অনেক আগে। তবে ২০১৭ সালের মার্চ মাসে কুষ্টিয়ার ধরমপুর গ্রামে উস্তার আলীর দলের পদ্মার নাচনের একটি আসরে গিয়ে এই গানের কয়েকজন সাধক শিল্পীর সঙ্গে পরিচয়। পরে ওই বছরই মাজেদা খাতুনের বাড়িতে ষাট মার গানের পরিবেশনা দেখার সুযোগ ঘটে।

ষাট মার গানের আসর দেখার আগে মাজেদা খাতুনের ঘরের এক কোণে গোপন প্রার্থনার একটি আসন দেখতে পাই—ষাট মার আসন। আসনের চারদিকে পোঁতা আছে কয়েকটি বাঁশের চটা ও কঞ্চি। ওপরের দিকে কারবালা প্রান্তরের তিরবিদ্ধ তাজিয়া ঘোড়ার একটি বড় পোস্টার। বাঁশের চটার একটি খুঁটের ওপরের দিকে বিভিন্ন রঙের বেশ কয়েকটি তসবি ঝোলানো। আর আসনের ওপরের দিকে ঝোলানো রয়েরছে বিভিন্ন রঙের জরি ও কাপড়ের তৈরি লাল রঙের কয়েকটি জবা ফুল। আসনের সামনের দিকে বড় ও ছোট দুটি ধাতব ত্রিশূল পুঁতে দাঁড় করিয়ে রাখা। ত্রিশূলটির মাথায় ঝোলানো হয়েছে একটি ছোট আয়না। সামনের দিকে রয়েছে ধূপধুনা, আগরবাতি। ধুনচির ওপর কাঠের ছোট একটি লাঠি রাখা, যাকে বলা হয় আশা। এ ছাড়া পাশে রাখা হয়েছে কাঠের ছোট একটি দান বক্স।

ষাট মার আসনটি ঘরের পশ্চিম–উত্তর কোণে স্থাপিত। আসর শুরুর আগে মূল সাধক শিল্পী মাজেদা খাতুন জায়নামাজ বিছিয়ে তসবি হাতে স্মরণ করলেন ষাট মাকে। মাজেদা খাতুন অনেকটা পীরের মর্যাদা নিয়ে আসরে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। আর গানের মাধ্যমে মূল গায়ক আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী হিসেবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও আশীর্বাদও করেন।

সেদিন দুপুরের দিকে আসর শুরুর আগে সাধক শিল্পীরা মাথায় করে গামছাঢাকা ষাট মার আসনটি ঘরের বাইরে নিয়ে আসেন। এরপর সেটি তাঁবু টানানো উঠানের মাঝখানে পাটির ওপর রাখেন। পাশে মাটিতে গেঁথে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় ছোট ত্রিশূলটি। একই সঙ্গে পাঁচটি রক্তজবাভর্তি ছোট একটি নৌকা এনে রাখা হয় পাশে। ষাট মার আসনের ওপরও রাখা হয় পাঁচটি রক্তজবা। শেষে আগরবাতি জ্বালিয়ে মাটির পাত্রটি স্থাপন করা হয় ষাট মার আসনের পাশে। পরে ষাট মার আসনে ভক্তি জানিয়ে শুরু হয় গানের আসর।

বন্দনাগীত শেষে ষাট মার মাহাত্ম্য প্রকাশক কাহিনিতে প্রবেশ করলেন শিল্পীরা। এখানে বলা দরকার, কৃত্যধর্মী এই বর্ণনামূলক গীত পরিবেশন করছিলেন কুষ্টিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামের সাধারণ নারীরা। পুরো আখ্যানগীত, কথকতা ও সংলাপে তাই একান্তভাবেই কুষ্টিয়ার আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ লক্ষণীয়।

বন্দনা শেষে গায়কেরা প্রবেশ করলেন আখ্যানে:Ñ

‘পাতালপুরে বালুর চরে তালপাতার ঘরে আল্লাহ রে॥

একলা একলা জর্ম [জন্ম] হইলাম তোমার উদরে রে,

মা জান তোমার উদরে।

ঝাঁকে ঝাঁকে পায়রা খেলে আমার জোড়া নাইকো রে,

মা জান আমার জোড়া নাইকো রে॥

আমার জোড়া দাও রে মা জান, আমার জোড়া দাও

মা জান রে...।’

গানের সুর-তাল থেকে বের হয়ে এ পর্যায়ে মূল গায়ক কথকতার ভঙ্গিতে কাহিনি বর্ণনা করেন:Ñ

‘বাড়ির বাহির হইল বেটা দেউড়ির বাহির হইল রে বেটা, শরম বইয়া গেল।

শরম বইয়া যাইয়া বেটা বটপাকুড়গাছ পাইল রে।

[...]

স্বর্গে ছিল স্বর্গের ষাট মা, ধিয়ানেতে পাইল মা জান রে।

চৌদ্দ চাকার রথে ভরে বেটার আগে আইল মা জান রে,

বেটার আগে আইসা মা জান বেটার পাশে বসে মা

জান রে,

বেটার পাশে বইসা মা জান বেটা হস্ত ধরে মা জান রে,

ওই হস্তে লেখে মা জান বেটার বিয়ার শমন লেখে রে,

ওই হস্তে লেখে মা জান বেটার বিয়ার শমন লেখে রে।

বেটার বাড়ির পাতাল নগর, বিয়া লেখে উজান নগর রে,

শ্বশুরের নামটি লেখে নামে মেনকা রাজা মা জান রে,

শাশুড়ির নামটি লেখে নামে নীলমন সুন্দর বালা রে...।

[...]

হেন সময় কালে বেটা গায়ে চেতন পাইল বেটা রে, হস্ত ধরে দেইখা বেটা মায়ের আগে দৌড়ায় আইলো রে।’

এ ধরনের কথকতার মধ্যে সহশিল্পীরা উক্তি-প্রত্যুক্তিমূলক সংলাপে অংশ নিয়ে পরিবেশনে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেন এভাবে:Ñ

: এই যে মা।

: ওগো বেটা।

: দেখো মা।

: বলো বেটা।

: আমার হাতে কে লিখল, কী লিখন লিখল?

: ও বেটা, তোমার হাতে কে–বা না যে আমার ভাতের বৈরী হলো, কে–বা না যে আমার ডাকের বৈরী হলো, পরের নারী ঘরে আ’লে মা বলা ডাক বন্ধ হবে।

সংলাপাত্মক অভিনয়ের পর প্রাসঙ্গিকভাবে আবেগ সঞ্চারের প্রয়োজনে মূল গায়ক আবার গানের সুরে ফিরে গিয়ে গেয়ে ওঠেন:Ñ

‘ওই না হস্ত দেইখা মা জান আছাড় খাইয়া পড়ে মা জান রে

[...]

পরের নারী ঘরে আইলে বেটা হবে পর রে

আল্লাহ বেটা হবে পর রে

পরের নারী ঘরে আইলে মা বলা ডাক হবে বন্ধ রে

আল্লাহ ডাক হবে বন্ধ রে।

ওই না কথা বুইলা মা জান কান্দে কাতর হলো রে

মা জান রে

কান্দে কান্দে ওরে মা জান কান্দে ব্যাকুল হলো

মা জান রে।’

পরে গান থামিয়ে গায়কদের প্রত্যুক্তিমূলক সংলাপ চলে কিছুটা। যেমন:Ñ

: ও মা।

: বলো বেটা।

: যদি তুমি আমার বিয়ে না দাও। তালি কিন্তু তোমার ঘরেই রব না, তোমার বুকেও রব না।

: ও বেটা, তোমার তো বিয়ের বয়স হয়নি বেটা।

এ পর্যায়ে গানের সুরে সুরে গায়ক কাহিনি এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন।ফাঁকে ফাঁকে একই রীতিতে ফিরে ফিরে যুক্ত হয় সংলাপ, কথকতা ও গান।

ষাট মার আসনকে সামনে নিয়ে গান পরিবেশন

কাহিনিতে গ্রামীণ জীবনের চালচিত্রের সঙ্গে পৌরাণিক ও লোকায়ত কল্পনা যুক্ত হয়ে অন্য রকম এক আবহ তৈরি করে। পাশাপাশি আখ্যানের মধ্যে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উপাদানগুলো সন্নিবেশিত হওয়ায় পরিবেশনাটি অন্য এক মাত্রা পেয়েছে। আর ধর্মনিবিশেষে এই গানের ভোক্তা সবাই—অন্য ক্ষুদ্র ধর্মাচারী মানুষেরাও।

জানা যায়, একেকটি মানতের আসরে ষাট মার গানের দলের শিল্পীরা এক বা একাধিক দিন-রাত নিরবচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন পালা পরিবেশন করেন। মূল গায়ক মাজেদা খাতুন ও তাঁর সহযোগীরা জানান, তাঁরা সাধারণত ষাট মার গানের পাঁচটি পালা পরিবেশন করেন—‘তারার পালা’, কালুর পালা, ‘রূপের খুলনার পালা’, ‘শ্রীরাই পালা’, ‘সুমন বাদশার পালা’। প্রায় প্রতিটি পালাতেই স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল, সমুদ্র, নদী, আকাশ, পর্বত, মাটি প্রভৃতি বিহারের কথা আছে।

মাজেদা খাতুনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই গান গেয়ে তিনি প্যারালাইসিসের চিকিৎসা যেমন করেছেন, তেমনি বহু নিঃসন্তান নারী সন্তানবতী হয়েছেন। প্রতিটি সাফল্যের পর অনেক সময় পুনর্বার ষাট মার গান গেয়ে গরু, খাসি, মুরগি প্রভৃতির মাংস দিয়ে গায়ক-শিল্পীসহ এলাকার ভক্ত-অনুসারীদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় বলে জানা যায়। বলা বাহুল্য, মানুষের মঙ্গল বিধানের লক্ষ্যে ষাট মার গানের এই আসর আয়োজনের সঙ্গে লোকায়ত বিশ্বাসের সম্পর্ক রয়েছে। সেই সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে প্রাচীন ও লোকায়ত কৃত্যাচারের।

গ্রামাঞ্চলে অশুভ, অমঙ্গল বা অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ‘ষাট ষাট, বালাই ষাট’ কথার প্রচলিত রয়েছে। দীর্ঘদিনের অনুসন্ধানে ও কাণ্ডজ্ঞানে উপলব্ধি করেছি, এই ‘ষাট ষাট, বালাই ষাট’-এর সঙ্গে ‘ষাট মার গান’-এর সম্পর্ক রয়েছে। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ পাওয়া যায়, ‘ষাট’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ষষ্টি শব্দ থেকে। শুধু তা–ই নয়, ষাট শব্দের অর্থ-সংকলনে ‘ষাট’ ও ‘ষষ্টি’র আন্তসম্পর্ক গ্রন্থন করেছেন হরিচরণ। বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ ষাট-এর অর্থ-সংকলনে রয়েছে, ‘ষষ্ঠীদেবী’, ‘সন্তানাদির মঙ্গল কামনায় ষষ্ঠীদেবীর স্মরণার্থক’ প্রভৃতি। অন্যদিকে ‘ষষ্ঠী’ শব্দের অর্থ-সংকলনে রয়েছে, ‘প্রকৃতির ষষ্ঠাংশরূপা কার্তিকেয়ভার্য্যা মাতৃকাবিশেষ; দেবসেনা, ষষ্ঠীদেবী। ষষ্ঠাংশরূপা প্রকৃতেন্তেন ষষ্ঠী প্রকীর্তিতা। স্কন্দপুরাণ। [ইনি শিশুগণের প্রতিপালনকারিণী, পুত্র পৌত্রদাত্রী ও ত্রিভুবনধাত্রী। দ্বাদশ মাসে ইঁহার পূজা হয়। মঙ্গলার্থ শিশুর জন্মের ষষ্ঠ ও একবিংশ দিবসে ইঁহার অর্চ্চনার বিধান আছে (স্কন্দপুরাণ)।’ [প্রাগুক্ত, পৃ. ২০৭২]

অভিধানকারের উপরোক্ত অর্থ-সংকলন ও ব্যাখ্যার পাশাপাশি কুষ্টিয়া অঞ্চলের মুসলিম নারীদের পরিবেশিত ষাট মার গানের আখ্যানগীতি, সংলাপ, কথকতা প্রভৃতি বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে। এতে নিঃসন্দেহে সময়, সমাজ, সংস্কৃতি প্রভৃতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে প্রান্তিক পর্যায়ের মুসলিম নারীদের উপস্থাপনায় ও ব্যাখ্যায় নারী-শক্তির বন্দনা-করণের পদ্ধতি ও প্রকৃতি বিচার সম্ভব হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।