আজও রবীন্দ্রনাথের বায়োপিক নির্মিত হলো না কেন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প–উপন্যাস থেকে দুই বাংলাতেই নির্মিত হয়েছে অসংখ্য চলচ্চিত্র। কিন্তু কবির জন্মের এত বছর পরও ঢাকা–কলকাতা—কোনোখানেই রবি ঠাকুরের জীবন নিয়ে তৈরি করা সম্ভব হলো না কোনো বায়োপিক। কেন এমন ঘটল? এই লেখায় খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে সেই প্রশ্নের উত্তর।

মৃত্যুর আগে শেষবারের মতো শান্তিনিকেতন ছেড়ে গাড়িতে উঠেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জুলাই ১৯৪১ছবি: বিনোদ কোঠারি

আজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মদিন। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৬১ সালে। গুগল আর উইকিপিডিয়ার মতে, ৭ মে তাঁর জন্মজয়ন্তী হলেও পালন করা হয় বাংলা তারিখ অনুসারে—২৫ বৈশাখ, যা সংশোধিত দিনপঞ্জি অনুযায়ী এখন বাংলাদেশে পালিত হয় ৮ মে।

চলচ্চিত্র আবিষ্কার হয়েছে রবীন্দ্রনাথের জন্মের আরও তিন দশক পরে। চলচ্চিত্র ভাষা ও সংগীত পেয়েছে তাঁর চলে যাওয়ার মাত্র অল্প কিছু আগে। স্বল্প সময়ের জন্য হলেও তিনি নিজেও জড়িয়েছিলেন চলচ্চিত্রের সঙ্গে। নিজের লেখা চিত্রনাট্য থেকে তৈরি করেছিলেন ‘নটীর পূজা’‌ নামে একটি সংক্ষিপ্ত চলচ্চিত্র।

অভিনয়ও করেছিলেন। জানিয়েছিলেন, মাধ্যমটির প্রতি তাঁর আগ্রহ, ভালোবাসা আর সম্ভাবনার কথা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষে (১৯৬১) সত্যজিৎ রায় কবির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছিলেন রবি ঠাকুরের তিনটি ছোটগল্প (‘সমাপ্তি’, ‘মনিহারা’, ‘পোস্টমাস্টার’) নিয়ে অ্যান্থলজি ফিল্ম ‘তিন কন্যা’ নির্মাণ করে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় একই উপলক্ষে সত্যজিৎ আরও নির্মাণ করেছিলেন ৫৪ মিনিট দের্ঘ্যৈর একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। শিরোনাম—‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’, যা অনেক দিন থেকেই অনলাইনে প্রদর্শনের জন্য উন্মুক্ত আছে। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, দুটি নির্মাণই সম্পন্ন হয়েছে ঠাকুরের মৃত্যুর ২০ বছর পরে। যখন অনায়াসে একটি বায়োপিকের কথা হয়তো ভাবা যেত।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, আজ অবধি রবি ঠাকুরের একটা বায়োপিক বা জীবনীভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মিত হলো না কেন? সত্যজিৎ রায় আরও কিছুটা সুস্থ ও সক্রিয় জীবন পেলে কি করতে চাইতেন? কিংবা তাঁর পরের কেউ? মৃণাল সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বা গৌতম ঘোষ কি ভেবেছিলেন? অথবা হালের অন্য কেউ?

রবীন্দ্রনাথের ১৩টি উপন্যাসের মধ্যে একমাত্র ‘প্রজাপতি নির্বন্ধ’ ছাড়া বাকি সবগুলো নিয়েই কলকাতা থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।‌ ছোট গল্পসহ সেখানে রবীন্দ্রসাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের সংখ্যা পঞ্চাশের বেশি। এক ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাস থেকেই চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে চারবার। প্রথমবার নরেশ মিত্র নির্মাণ করেন ১৯৩৮ সালে। আর চতুর্থবার নির্মাণ করেন ঋতুপর্ণ ঘোষ, ২০১১ সালে।

সত্যজিৎ রায়ের পর ঋতুপর্ণ ঘোষও ‘জীবনস্মৃতি’ নামে রবি ঠাকুরের ওপর একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। সেটাও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি। তবে কবির বায়োপিকের কোনো ভাবনা তাঁর কখনো ছিল বলে শোনা যায়নি।

সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ প্রামাণ্যচিত্রের দৃশ্য
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ থেকে কেউ কি ভাবতেন অথবা ভেবেছেন? বলা মুশকিল। বাস্তবতা হচ্ছে, রবি ঠাকুরের বায়োপিক নির্মাণের ভাবনা দূরে থাক আজ অবধি এই বাংলায় তাঁর একটি উপন্যাসের চলচ্চিত্র রূপও কাউকে করে ওঠার সামর্থ্যবান হয়ে উঠতে দেখা যায়নি। এখানে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প থেকে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ২০০৪ সালে। ‘শাস্তি’ গল্প থেকে একই নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম। এখানে বলা প্রয়োজন, টেলিভিশনে প্রচারিত ‘গল্পগুচ্ছ’–এর গল্পগুলোর উপুর্যপুরি দুর্বল নির্মাণ আজকের আলোচ্য নয়।

কিন্তু চলচ্চিত্র মাধ্যমে যাঁরা একটু সামর্থ্যবান ছিলেন, তাঁদের কর্মযজ্ঞের দিকে তাকালে কী দেখা যায়। এক সত্যজিৎ রায় ও ঋতুপর্ণ ঘোষ ছাড়া আর কেউই রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তেমনভাবে আগ্রহী ছিলেন কি না, সে প্রশ্ন তোলাই যায়। নাকি‌ কবির বহুবর্ণিল জীবন তাঁরা আত্মস্থ করতে পারছিলেন না, ধারণ করতে পারছিলেন না? বলা মুশকিল!

সত্যজিৎ–পরবর্তী ৫০ বছরে মেধা ও সৃজনশীলতার বিভাজন হয়ে গেছে নানা মাধ্যমের হাতছানিতে। সত্যজিৎ, মৃণাল আর ঋত্বিকের মধ্যে সবচেয়ে ছোট জীবন পেয়েছিলেন ঋত্বিক ঘটক। বেঁচে ছিলেন মাত্র ৫০ বছর। সবার ছোট হয়েও বিদায় নিয়েছেন সবার আগে। ২৫ বছরের সক্রিয় জীবনে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন ৮টি। আর স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন ১২টি।

বাংলাদেশ থেকে কেউ কি ভাবতেন অথবা ভেবেছেন? বলা মুশকিল। বাস্তবতা হচ্ছে, রবি ঠাকুরের বায়োপিক নির্মাণের ভাবনা দূরে থাক আজ অবধি এই বাংলায় তাঁর একটি উপন্যাসের চলচ্চিত্র রূপও কাউকে করে ওঠার সামর্থ্যবান হয়ে উঠতে দেখা যায়নি।

সত্যজিৎ রায় বেঁচে ছিলেন ৭১ বছর। তাঁর ৩৬ বছরের সক্রিয় সময়কালে ছোট–বড় মিলিয়ে কাজও করেছেন ৩৬টি। তার ভেতরে রবীন্দ্রনাথের একটি উপন্যাসসহ ছোটগল্প ছিল চারটি।

তিনজনের মধ্যে মৃণাল সেন সবচেয়ে দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন। বেঁচে ছিলেন ৯৫ বছর। তাঁর ৪৮ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন ২৯টি। পাশাপাশি টেলিভিশনের জন্যও কাজ করেছেন প্রায় ১৪টি। আগামী ১৪ মে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী।

‘নটীর পূজা’ চলচ্চিত্রে অভিনেতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছবি: সংগৃহীত

অন্যদিকে এই বাংলায় যাঁদের সামর্থ্য ছিল—যদি ধরা হয়, জহির রায়হান, আলমগীর কবির কিংবা তারেক মাসুদের নাম—তাহলে দেখা যায়, তাঁদের চলচ্চিত্রজীবন বা ‘ক্যারিয়ার স্প্যান’ খুব একটা দীর্ঘ নয়।

জহির রায়হান বেঁচে ছিলেন মাত্র ৩৭ বছর। তাঁর ১২ বছরের সক্রিয় জীবনে ছোট-বড় মিলিয়ে কাজের সংখ্যা ১৪টি।

আলমগীর কবির বেঁচে ছিলেন ৫১ বছর। তাঁর ১৭ বছরের সক্রিয় জীবনে সব মিলিয়ে কাজের সংখ্যা ১৬টি। এর মধ্যে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ৭টি।

তারেক মাসুদ বেঁচে ছিলেন ৫৪ বছর। তাঁর ২৫ বছরের সক্রিয় জীবনে প্রামাণ্য, স্বল্পদৈর্ঘ্য ও পূর্ণদৈর্ঘ্য মিলিয়ে চলচ্চিত্রের সংখ্যা ১৫টি।

এই বাংলায় অনেক কাজ সম্ভব হয়নি কেবল পারস্পরিক আস্থার অভাবে। শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমান মানুষদের যথাস্থানে না পাওয়ার অভাবে। দর্শক কখনো তৈরি থাকে না, বাজারও‌ নয়। ওই বাংলায় সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকও পাননি। একইভাবে এই বাংলাদেশে পাননি জহির রায়হান, আলমগীর কবির, তারেক মাসুদও। আসলে দর্শক তৈরি করে নিতে হয়। কিন্তু ৫৫ বছরের একটা ইন্ডাস্ট্রি রবীন্দ্রনাথের একটা উপন্যাসকে ধারণ করে একটাও চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারেনি। তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়) মধ্যে অন্তত একজনের একটা উপন্যাস নিয়েও কাজ করতে সমর্থ হয়নি—এই ভাবনাটা পীড়াদায়ক। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ নির্মাণ করতেও ঋত্বিক ঘটককে আনতে হয়েছিল, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ নির্মাণের জন্য আনা হয়েছিল গৌতম ঘোষকে। এই ভূখণ্ডের প্রযোজকদের মধ্যে যাঁরা চলচ্চিত্রকে বিনোদনের বাইরে গিয়ে শিল্প হিসেবেও বুঝতেন, তাঁরা আমাদের অগ্রজ নির্মাতাদের ওপর ভরসা রাখতে চাননি কখনোই। অবস্থাদৃষ্টে এ কথা এখন সত্য বলেই মনে হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষ ‘জীবনস্মৃতি’ নামে যে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন, তার শুটিংয়ে পরিচালক ঋতু মেকআপ করিয়ে দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথের চরিত্র রূপদানকারী অভিনেতা সঞ্জয় নাগকে
ছবি: সংগৃহীত

অধুনা ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে ক্রিমিনালদের জীবন দেখার জন্য আগ্রহী দর্শক কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা বায়োপিক দেখতে চাইবেন? জমিদার, কবি, লেখক, ঔপন্যাসিক, গীতিকার, নাট্যকার, নোবেলজয়ী—এসব বাদ দিয়ে কেবল জাতীয় সংগীতের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথের ওপর একটা বায়োপিক প্রযোজনা করার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান, প্ল্যাটফর্ম, শিল্পমালিক, পৃষ্ঠপোষক কি অবশিষ্ট আছেন?

‘কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো—কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে!’ এই একটি লাইন যিনি স্কুলজীবনেও একবার গেয়েছেন, তিনি বড় হয়ে কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠানে থাকলেও লাইনগুলো শোনার সময় তাঁর চোখ আর্দ্র হয়ে আসার কথা।

রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বয়সে বড় বা তাঁর আগে জন্মানো আর কোনো মনীষীর জন্মদিন বোধ হয় বাঙালিরা রবীন্দ্রনাথের মতো এত নিয়মিতভাবে উদ্‌যাপন করে না। বাঙালির সংস্কৃতি ও মননে তাঁর চেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারকারীও আর কেউ নেই।‌

এখন প্রযুক্তির এই চরম উৎকর্ষের সময়ে চলচ্চিত্রের মতো চতুর্মাত্রিক শিল্পে তাঁর জীবনপ্রবাহ দেখা সব প্রজন্মের জন্যেই অভাবনীয় উপহার হয়ে উঠতে পারে। আপাতত এটুকুই প্রত্যাশা।