রাকা সরোবর

আর কদিন পরেই আগুন–জাগানো ফাগুন। সঙ্গে ভালোবাসা দিবসের হাতছানি। এই ক্ষণে অন্য রকম এক ভালোবাসার গল্প

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

রাকা যা বলল, তা শোনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না।

এই বয়সে কেউ থাকেও না। ১৬ বড়জোর চোখের ইশারার বয়স। মোবাইলটা আদান-প্রদান করতে গিয়ে হাতটা একটু ছুঁয়ে দেখার বয়স। ফেরার সময় বাই বলে একটু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার বয়স। কিন্তু তাই বলে একদম চোখে চোখ, একটু শরীরটা এলিয়ে, কোমরের বাঁকটা আরও বেশি ফুটিয়ে তুলে, একেবারে বলে দেওয়া...

আমার মাথার ভেতর গেঁথে গেল কয়েকটা শব্দ…

আগামীকাল...

বিকেল চারটায়…

আমরা দেখা করি?

প্রশ্নই করেছিল রাকা। উত্তরও যে দিতে হবে বুঝিনি। অনেকক্ষণ বোবার মতো তাকিয়েই থাকলাম। রাকার মুখটা অন্ধকারের দিকে যাচ্ছে। সন্ধ্যা হচ্ছে। বলল, কী, আসবা না?

রাজকন্যার মতো দেখতে রাকা। প্রশ্ন করবে ক্যান...নির্দেশ দেবে। আমরা জো হুকুম জাহাঁপনা বলে তা পালন করব...অস্ফুটে বললাম, হুম্​!

আমি কোচিংয়ে ব্যাচে পড়ি। তিনটা থেকে টিউশনি ছিল। মাস্টারটা এমনিতেই পাগলা টাইপের। পড়া শুরু করলে কবে কোথায় থামতে হয় জানে না। সাড়ে তিনটার সময় উঠে খাড়া আমি, স্যার, আমাকে যাইতে হবে!

চশমার ফাঁক দিয়ে দেখে লোকটা বলল, কই যাবেন?

আমি বলি, কাজ আছে।

পাশ থেকে শিহাব ফিচিক করে হেসে দেয়। আমার নাকি টালটাল অবস্থা! তা প্রেম তো টালমাটাল ব্যাপারই, নাকি?

মেঘ করেছে। করুক। বাতাস হচ্ছে। হোক।

এদিকে শিহাবের পস্তানো মুখ, দোস্ত, তোর তো হইয়া গেল, আমার কী আর হইব না একটা?

আমার মুখটাজুড়ে হাসি। দুবছর আগে প্রিয়ন্তীকে ট্রাই করছিলাম, শালা বেইল দেয় নাই। রাকার সাথে আজকে ডেটের পর ফেসবুকের রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস বদলে দেব। এখন ইটস কমপ্লিকেটেড!

ধানমন্ডি লেক। আট নম্বরে খুব ভিড় থাকে। আমরা দেখা করব রবীন্দ্রসরোবরে। রাকা বলেছিল, তোমাকে আমার ভাল্লাগছে৷ রবীন্দ্রসরোবরে আসো, নাকি?

রবীন্দ্রনাথ ডাকলে নিশ্চয়ই যেতাম না। কিন্তু রাকা তো আসলে সুন্দর সরোবর।

পৌঁছানো গেল না অত দূর। তার আগেই ঝুম বৃষ্টি। আকাশ এক হাত মাথার ওপর। কেয়ামত নাকি? আমরা একটা ছাপরা দোকানে। কোনোমতে বৃষ্টি বাঁচিয়ে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু ছাটে কতক্ষণ বাঁচব জানি না। তার ওপর এ বৃষ্টি কি আসলেই থামবে কখনো?

শিহাব বলে, তুই যা, দোস্ত! বই–খাতা সব দে...।

আমি ছুটলাম।

রাস্তার গাড়িগুলো এর-ওর সাথে লাগালাগি। তারই ভেতর ফাঁক খুঁজে নিচ্ছি, বৃষ্টি পড়ছে ধুমসে। এরই মধ্যে কেউ একজন যেন ডাকল, এই রবিন!

তাকিয়ে দেখলাম। কেউ নেই। দুইটা রিকশা নীল পলিথিন মুড়ে ছুটছে তাড়া–খাওয়া পাখির মতো। আমি ছুটলাম আলোর গতিতে। ৩২ নম্বরকে পাশ কাটিয়ে উঠে গেলাম ব্রিজে। ছাউনি আছে। কিন্তু থাকলেই কী, লাভ নেই। মাথার পানি পায়ে গড়াচ্ছে৷ হাঁপাচ্ছি...তাতে কী...আবার দৌড়।

রবীন্দ্রসরোবর। শালা একটা কাকও নেই। আমিই একা কুত্তাভেজা। মাথা দপদপ করছে, পা ছিঁড়ে গেছে এক জায়গায়। জ্বলছে। কেউ নেই, রাকাও না! মনে হলো এবার রাকাকে ফোন দেওয়া দরকার। কিন্তু ফোন ভেজা এবং ডেড। আর তাতে ঠান্ডা লাগল হঠাৎ করেই। কাঁপল শরীরও। তবু আরও তিন ঘণ্টা রবীন্দ্রসরোবরে। ওভাবেই। কাঁপতে কাঁপতে। বৃষ্টি ধরলে অনেকেই এল, রাকা এল না।

দুই.

শিহাবের ফোন থেকে সারা রাত ট্রাই করলাম, রাকার ফোনও বন্ধ। সকালে রাকার বাসার কাছে দাঁড়ালাম। অবশ্য বাসাটা রাকার নয়, তার ফুফুর৷ রাকার ফুফুতো বোন মিলি আপা; শিহাবের ভাইয়ের ক্লাসমেট। যোগাযোগের চেষ্টাটা তাই কঠিন হয়ে উঠল। শিহাবই খবর আনল আরও তিন দিন পর। খুলনা চলে গেছে রাকা; খুলনা থেকেই এসেছিল বেড়াতে। ফোন-ফেসবুকের গুষ্টি উদ্ধার করলাম। রাকাকে তবু পাওয়া গেল না।

একটা সন্ধ্যা, এক বর্ষণমুখর বিকেল এবং আমার অনেক রাতজাগা নিয়ে রাকা চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল।

তিন.

সাড়ে তিন বছর পর মিলি আপার বিয়েতে রাকাকে পাওয়া গেল।

না, ঠিক পাওয়া গেল এমনটা বলা যায় না।

এক আপাদমস্তক কেতাদুরস্ত সেদিন পরিচিত হলেন। ছাদে সিগারেট খেতে খেতে বাড়িয়ে দিলেন গিফট। ওনার নাম রাফসান। রাকার বয়ফ্রেন্ড৷ অনেক তপস্যা নাকি করেছেন উনি এ কয় বছরে। তবে গিয়ে রাকার হৃদয়ে বেঞ্চ পেতে বসতে পেরেছেন। হাসলাম আমি, বেঞ্চ পাতার জন্য জানালাম অভিবাদন।

রাফসান আমার হাতটা ধরে ফেলল। কৃতজ্ঞতা তার চোখে। কী বিস্ময়!

বললাম, আপনার আনন্দ দেখে আসলেই আমি আনন্দিত!

রাফসান বলল, আপনি যদি সেদিন রবীন্দ্রসরোবরে আসতেন, আমি তো আর থাকতাম না এখানে!

তাই নাকি?

কিন্তু আমি তো...

রাফসান বলে উঠল, সেদিন, ওই যে বৃষ্টির বিকেলে...রাকা এসেছিল সরোবরে...এসেছিল আসলে আগে আগেই। তবে বৃষ্টিতে টিকতে না পেরে বাধ্য হয়েছিল চলে যেতে। এতবার ফোন দিয়েছিল আপনাকে, অথচ ফোনটা আপনি বন্ধ করে রেখেছিলেন! ভাগ্যিস রেখেছিলেন, ভাই!

পরপর দুবার টান দিই সিগারেটে। আস্ত চিবিয়ে খেতে পারলেও হয়তো ভালো লাগত।

রাফসান বলল, এ গিফটটা একেবারেই আমার পক্ষ থেকে। জানতাম, এখানে আপনার দেখা পাব। ভাই, ভাগ্যিস আপনি রাকার ডাকে আসেননি, এলে এমন সুন্দর সুরোবর আমার হতো না!

সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছিল, থাকার কোনো মানে হয় না। চলেই যাচ্ছিলাম। রাফসান বলল, সেদিন রাস্তায় রাকা নাকি আপনাকে ভেবে অন্য কাউকে ডেকেও ফেলেছিল...আমি ওই ছেলেটিকেও ধন্যবাদ দিতে চাই। ওই ছেলেটি ভাগ্যিস আপনি ছিলেন না!

গিফটটা ফেরত দিয়ে বললাম, ভাইরে, আমি আসলে এর যোগ্য নই! সুন্দর সরোবর এবং এই উপহার...সবাই আপনার! আসি!