মৃত্যুর সাথে প্রথম বোঝাপড়া
খান সাহেব আবদুল রব চৌধুরী– ঢাকা কলেজ, রাজশাহী কলেজ, চট্টগাম কলেজের প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংরেজ সরকারের চট্টগ্রাম কলেজকে কুমিল্লায় নিয়ে আসার আদেশ অমান্য করে নজির সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। তাকে নিয়ে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেছেন লেখক।
১৯৬৪ সাল। স্বল্প আলোয় বিষাদময় ঘরটি। রাত বোধকরি ৮টা হবে। খান সাহেব আব্দুল রব চৌধুরীর মা, ছেলে, মেয়ে, নাতি, নাতনি, ছোট ভাই, একমাত্র বোন, সবাই বয়েছেন সে ঘরে। হাসপাতালের বিশেষ খাট থেকে রব চৌধুরীকে তার নিজের সেগুন কাঠের বিশাল চৌকিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। মাঝে মাঝে চেতন আসে। বাকিটা সময় চোখ বন্ধ করে নিস্তেজ পড়ে আছেন তিনি। তরুণ চিকিত্সক ড.বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিকেলে জানিয়ে গেছেন, যে কোন সময় চলে যাবেন রব চৌধুরী তার অনেক মায়ার ৩৭নং নিজিমুদ্দিন রোডের বাড়ি ছেড়ে।
বড় মেয়ে, আয়শা খাতুন চৌধুরী তার চাকুরী ফেলে রাজশাহী থেকে ঢাকায় চলে এসেছেন। ছোট মেয়ে রাজিয়া হকও এসে গেছেন কোয়েটা থেকে। এম সি কলেজের অধ্যাপক সেজ ছেলে আব্দুল মতিন চৌধুরী এবং ব্যাংকার ছেল আব্দুল খালেক চৌধুরী স্বপরিবারে চলে এসেছেন শেষ সময়ে বাবার পাশে থাকতে। সঙ্গে থাকেন মেজো ছেলে এ্যাডভোকেট আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী। তার উপরেই সব দায়িত্ব চোখ মুছতে মুছতে গৃহকর্মীদের নিয়ে চকবাজার থেকে বরফ, চাপাতা ইত্যাদি জোগাড়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বেশ কদিন ধরে নাক দিয়ে খাবার চলছিল। কোন ঔষুধেই কাজ হচ্ছিলা না। ইনজেকশন চলছিল একটা দুটো। কখনওবা দিতে হয়েছে কোরামিন। মলত্যাগও বন্ধ হয়ে গিয়েছে কদিনধরে।
রব সাহেবের ১০ সন্তানের মাঝে সবচেয়ে ছোট ছেলে, আব্দুল রকিব চৌধুরী এখন কানাডায় বড় ডাক্তার। গত কয়েক মাস ধরে তিনিও ঢাকায়। হাতে গ্লাভস পড়ে তাতে গ্লিসারিন লাগিয়ে গভীর নিষ্ঠার সাথে আঙ্গুল দিয়ে বের করে আনছিলেন সেসব। কি অশ্চর্য কিছুটা দূরে বাড়ির অপর অংশে নিশ্চিতে ঘুমাচ্ছেন রব চৌধুরীর ১০০ বছর বয়সি মা।
সপ্তাহ খানেক আগে ৩৭নং নাজিমুদ্দিন রোডের সংসার খরচের জন্য চেক লিখছিলেন রব সাহেব। চেক দুবার ফেরত এলো, সই মিলছিলো না । চেক বই থেকে ঘাড় উঁচু করে সিলেটি ভাষায় মেজো ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন - ‘আমারে তরস্ত বালা খর নাইলে কেমনে চলব এই সংসার’।
হঠাৎ মাথাটা আস্তে ঘুরিয়ে চোখ আধো খুলে বিড়বিড় করে কিছু বলতে চেষ্টা করলেন রব চৌধুরী। একসঙ্গে সবার মাথা নিচু হলো তাঁর চৌকির চারদিকে। মেজ আপা রব চৌধুরীর কানের কাছ থেকে মুখ উঠিয়ে বললেন, ‘রিয়ারে খুঁজতাসইন।’ হ্যাঁ, আমিই সেই রিয়া, তাঁর নাতনি, যাকে তিনি খুঁজছেন। নানাবাড়িতে এলে তাঁর পাশের শোবার স্থানটি আমার। কতদিন তার সঙ্গে শুতে পারিনি। কান্না মেশানো গলায় আবদার করে বসলাম, ‘আমি একটু তাঁর পাশে শুতে চাই।’ দুই–এক দিনের মাথায় যিনি ইহলোক ত্যাগ করবেন, তাঁর পাশে কি সাত বছরের শিশুকে শুতে দেওয়া যায়? বড় খালা মৃদু ভর্ৎসনা করে উঠলেন, ‘না না, ঘুমের মধ্যে তুমি পা তুলে দিবা।’ অর্ধচৈতন্যের ভেতর নানার নড়াচড়ায়, বড় খালা কিছুটা নরম হলেন। আমি পাখির বাচ্চার মতো গিয়ে শুলাম। ওষুধ আর ডেটল মেশানো তাঁর শরীরের গন্ধটা তত দিনে গা সহা হয়ে গেছে। কী নিশ্চিন্তে কাটল আমার কিছু মুহূর্ত প্রাণপ্রিয় নানার পাশে।
এই ঘটনার দুদিন পর নানা শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন। তাঁর মৃতদেহ তখনো বিছানায়। নাক দিয়ে কিছুটা জল বের হচ্ছিল। কেউ একজন তাঁর নাকে তুলা দিয়ে দিলেন। নানার ছোট ভাই অ্যাডভোকেট সোভান চৌধুরী বেঁধে দিলেন পায়ের বুড়ো আঙুল দুটো। তাঁর বিশাল অট্টালিকার দোতলার সিঁড়ির নিচে গোসলের জায়গা তৈরি হচ্ছিল। পেছনের উঠানের বড় আকর্ষণ বরইগাছ। অপূর্ব স্বাদ এই গাছের বরইয়ের। গাছভরা বরই যখন পাকে, আগে থেকে ঠিক হয়, কবে গাছ ঝাঁকানো হবে। মামা, খালা, সব খালাতো–মামাতো ভাইবোন, গৃহকর্মী এবং তাঁদের সন্তানেরা যে যার টুকরি, মগ, বাটি ইত্যাদি নিয়ে প্রস্তুত থাকে। গাছে ঝাঁকি দেন আবুল পুতি বা সিপাই ভাই আর বৃষ্টির মতো ঝড়ে পড়ে সব বরই! যে যা কুড়াতে পারে, সেটুকু তার। দারুণ ইগালিটারিয়ান এক দৃশ্য।
সেই গাছে ঝাঁকি দিতে নয়, তার কটা পাতা ছিঁড়তে গাছে উঠলেন ওয়াবুল্লাহ ভাই। মানুষের শেষ গোসলে নাকি লাগে বরই পাতা। বারান্দায় বড় বড় বালতিতে ভিজিয়ে রাখা হলো সেগুলো।
একসময় মেজ মামা দুই হাতের মাঝখানে শুইয়ে তুলে আনলেন বড় আম্মাকে। নানার কাছে এনে বললেন, ‘দাদিগো, তুমার ফুলই নাই।’ বড় আম্মা অসহায় চোখে তাকালেন বিছানায় শায়িত তাঁর বড় আদরের ছেলের দিকে। ‘আমার ফুলই নাই’ বলে ডুকরে উঠে মেজ নাতির কোল থেকেই আদর করলেন ছেলেকে। লোকে গিজগিজ করছে ঘর। বড় আম্মার অসহায় আর্তনাদে ঘরে সবার ফোঁপানো কান্নার ঢেউ বয়ে গেল আরেক চোট।
আমি নানার ঘরের দরজার চৌকাঠে বসে দেখছিলাম সবকিছু। পানিতে ভেজানো বরইপাতাগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, নানা ছাড়া কেমন হবে আমার পৃথিবীটা? অজানা ভয়ে হাত–পা কুঁকড়ে আসছিল। আরিফ ভাই, যখন তাঁর দাড়িওয়ালা মুখের ঝকঝকে সাদা দাঁতগুলো বের করে হাতের নিচ থেকে সোয়েটার তোলার ভঙ্গি করে আমাকে ‘স্টাইল শেষ’ বলে খ্যাপাবেন, তখন আমি কার কাছে বিচার দেব? কে বেরিয়ে আসবেন হাতের লাঠিটা নিয়ে? লাঠি উঁচু করে কড়া স্বরে কে বলবেন, ‘ক্যাডায় লাগসস রিয়ার সাথে?’ ৩৭ নম্বর নাজিমুদ্দিন রোডের বিশাল একান্নবর্তী পরিবারে খ্যাপানোর লোক তো আর কম নেই। বড় মামার বড় ছেলে আমাদের শামিম ভাই তো আমার পাশ দিয়ে গেলেই মুখ বিকৃত করে আমাকে অনুকরণ করে বলে, ‘নানাগো!’ অর্থাৎ কেউ খ্যাপালে আমি ‘নানাগো’ বলে কাঁদি আর নানা বের হন লাঠি নিয়ে। তাই আমাকে দেখলে সোহেল ভাই, সাদি ভাই, সবই খ্যাপায় ‘নানাগো’ বলে। একবার তো নানাগো বলে খেপিয়ে সোহেল ভাই মারও খেয়েছিল।
নানার মেজ মেয়ে সাঈদা আমার মা। আমরা থাকি ২৬/এ আজিমপুর কলোনিতে। প্রতি বৃহস্পতিবার নানা হয় নিজে আসেন অথবা যেকোনো মামাকে বা খালাতো ভাইকে পাঠিয়ে দেন, আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যেতে। বৃহস্পতিবারে এসে শুক্রবারে খেলাধুলা আর আনন্দের পর শনিবার সকালে আবার স্কুলে নামিয়ে দেওয়া হয়। আমাকে এখন কে নিয়ে যাবে ৩৭ নম্বর নজিমউদ্দিন রোডে? রাতে ঘুমাতে ঘুমাতে কে শোনাবেন ফারসি কবিতা ‘তাজা বাতাজা নওবনও’? আমরা নাতি–নাতনিরা অর্থ না বুঝেই কী করে বলে উঠব, ‘নানাকে সেই নৌকায় তুলে নাও’ আর সমস্বরে হাসব খিল খিল করে। আজানের সাথে সাথে কার গলায় শুনব ‘হাসবুনাল্লাহু ওয়া নিমাল ওয়াকিল, ওয়া নিমাল মাওলা ওয়া নিমান-নাসির’। বিরক্ত হয়ে আর বলব কাকে, ‘নানা, ঘুম কেন ভাঙালে?’
বছরওয়ারী দাঁতের মাজন বানানোর যে উত্সব হতো, তা কি থেমে যাবে? গাইল ছিয়া ধুয়ে রোদে শুকায় রুপার মা–ঝি। গাছে উঠে নিমপাতা পাড়ে সিপাই ভাই। কাপড় রোদে দেওয়ার তারে লাইন করে শুকানো হয় সেই পাতা। সব আয়োজন সাঙ্গ হলে পেছনের উঠানে নানা বসেন উঁচু জলচৌকিতে। হামু আপা, জবানঝিবু, আঞ্জনিবু নানার নির্দেশমতো গাইল ছিয়ায় সব সরঞ্জাম মাপমতো দিতে থাকে। আর গেদিবু পাড় দেয় সেই সব। তৈরি হয় সাদা পাউডারের মতো দাঁতের মাজন। বাড়ির যত নিম্নবর্গীয় কর্মী, তাঁদের সারা বছরের মাজন হতো এই গুঁড়ো।
আমরা কি আর শুক্রবার মর্নিং ওয়াকে রমনা পার্কে যাওয়ার সময় হাইকোর্টের পাশের চিড়িয়াখানার চালতা তুলতে গিয়ে বানরের খামচি খাব না? নানার সব বন্ধু মর্নিং ওয়াকে আসতেন একা একা আর নানার ছিল বিশাল অন্তরাজ। আমরা অর্থাৎ তাঁর নাতি–নাতনিরা এবং গৃহকর্মীদের সন্তান–সন্ততি নিয়ে ২০ থেকে ২২ জন তো হবই নানার সঙ্গী। সেই সাথে চলত আমাদের দুই কুকুর—ল্যাকি আর জো। মানুষটা চলে যাওয়ার সাথে সাথে কি শেষ হয়ে যাবে জীবনের এই সব অনাবিল আনন্দ? নানার হোমিওপ্যাথি ওষুধের বাক্সটা, যা দিয়ে তিনি বাড়িসুদ্ধ সবার চিকিত্সা করতেন, সেটা কে পাবে? সেই বাক্স থেকে চুরি করে করে সাদা গোল গোল ওষুধগুলো সমবয়সী মামাতো ভাই জামিল আর আমি কি আর খেতে পাবনা?
১৯৬৩ সালে আমার মা সাঈদা সিদ্দিকী পড়াশোনা করতে আমেরিকায় গিয়েছিলেন। আমার বাবা তখন ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছিলেন। ৬৪ সালে মা ফিরলেন। পাইলট ক্যাপ্টেন সবুজের গাড়িতে করে মা এলেন। আমি সামনের উঠানে ধুলাবালুতে খেলার সাথি চিকুনির সাথে রান্নাবাড়ি খেলছিলাম। দেখি, মা দৌড়ে ঘরে ঢুকে ভীষণ আবেগে ছোট বোন রিফিকে কোলে জাপটে ধরলেন। আমি দরজার কছে এসে অধীর আগ্রহে মায়ের আদরের অপেক্ষায় ছিলাম। আমার বুভুক্ষু চাহনি নানার দৃষ্টি এড়াল না। তাঁর মেয়েকে অনেকটা আদেশের সুরেই বললেন, ‘হিলারে (অর্থাৎ আমাকে) কুলো লও, হিলারে আদর খর।’ ভাইবোনদের কেউ একজন বলে উঠল, ‘রিয়ার তো চিকেনপক্স হইছে।’ নানা জোরের সাথে আবার বললেন, ‘তে কিতা হইছে? অলির তো আগে চিকেনপক্স হইসেওই।’
ছোট বয়সে বাচ্চাদের নানা রকম অনিরাপত্তা থাকে। অনেক ক্ষেত্রে তা তৈরি করে দেয় তাদের আশপাশের লোকেরা। খ্যাপাতে খ্যাপাতে আমার ভাইবোনেরা বলত, ‘মাইজ্জা খালাম্মা রুমিরে বেশি আদর খরইন। আর খালু আদর খরইন রিমারে। তরে আদর করইন না।’ আমার বড় ভাই রুমি, আমাকে খ্যাপাতে আরও বড় অস্ত্র ব্যবহার করতেন। আমাকে নাকি রিমার সাথে খেলার জন্য মা এক জমাদারনি কাছ থেকে রেখে দিয়েছিলেন। ‘দেখিস না আমরা দুই ভাইবোন ফরসা আর তুই কেমন কালো।’ এ রকম মুহূর্তগুলোয় ‘নানাগো’ বলে ছুটে যাই আমার নিরাপত্তাবলয়ে। নানা বলেন, ‘তুই সবার চেয়ে ফরসা, তুই সবার চেয়ে সুন্দর। তাইতো ওরা তোকে হিংসা করে আর খ্যাপায়।’ ছোট্ট রিয়াকে এখন কেদেবে সেই মনোবল?
নানার মৃত্যুর পর জীবন বদলেছিল অনেক। তবে মামা, খালা আর ভাইবোনরা মিলে তৈরি করেছি আরও বহু আনন্দঘন মুহূর্ত। সেই সাত বছরের শিশু আমি, একসময় বড় হয়েছি। পড়াশোনা শেষ করেছি, পছন্দের মানুষকে জীবনসঙ্গী করেছি, দুই সন্তানকে তাদের নিজ নিজ লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহযোগিতা করেছি। তিনটি দুরন্ত নাতির দাদি আর নানি হয়েছি। সেই শামিম ভাই নেই। কোভিড নিয়ে গেছে হামু আপাকে। হবু আপা, আবু আপা, হালিমা আপা, নিনি আপি, সোহেল ভাই, শাহিন ভাই, সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন। সবার আগে আকস্মিকভাবে চলে গেছে আমার খেলার সাথি জামিল। আরিফ ভাই ভুগছেন দুরন্ত ক্যানসারে। কেউ আর আমাকে ‘নানাগো’ বলে খ্যাপায় না। মাঝেমধ্যে বড় সাধ হয়, আমার ভাইরা আমাকে একটু খ্যাপাক। আর আমি আমার নানার বুকের সবটুকু নিরপত্তার বেষ্টনীতে লুকিয়ে থাকি। জীবনের সব কঠিন বাঁক পার হয়ে এসে আজ মনে হয়, নানা ছিলেন আমার গভীর ভালোবাসায় ভরা নিরাপদ আশ্রয়।