কিভাবে এল কারওয়ান বাজার

ঢাকার কারওয়ান বাজার এখন পণ্য কেনাবেচার বড় কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। আদতে কেমন ছিল এই স্থান? কীভাবে তা হয়ে উঠল কারওয়ান বাজার?

শিল্পীর চোখে আম্বর শাহ মসজিদের গম্বুজসহ পঞ্চাশ দশকের কারওয়ান বাজারঅলংকরণ: আরাফাত করিম

কারওয়ান বাজার না কাওরান বাজার? আসলে হওয়ার কথা ছিল কারওয়ান বাজার, কিন্তু মানুষের চলতি কথায় হয়ে গেল কাওরান বাজার। তা কাওরান বাজারই সই। 

মোগল আমল বা ইংরেজ আমল বা উনিশ শতকের কথা বাদ দিই। ১৯৪৬ সালে শহর ঢাকা ছিল কেমন? বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর লিখেছেন সেই ঢাকা সম্পর্কে, ‘১৯৪৬ সনে ঢাকা শহর কেমন ছিল? দক্ষিণে পুবে পশ্চিমে নদীর মধ্যে ঢাকা শহর ঢিবির মতো জেগে আছে। এই ঢিবিটি উত্তরের দিকে ছড়ানো। আর ঢিবিটি কেটে বেরিয়ে আছে ফাঁটা তরমুজের মতো, জলার পর জলা। একটু হাঁটলেই জলা, একটু হাঁটলেই বনজঙ্গল, একটু হাঁটলেই গ্রাম, সে জন্য জলা জঙ্গল গ্রামের মধ্যেই ঢাকা শহরটা গম্বুজের মতো।’ সেই জলার কিছু অংশ এখনো চোখে পড়বে সোনারগাঁও হোটেলের পাশে বা হাতিরঝিলে।

সেই যে ১৬১০ সালে বুড়িগঙ্গার তীরে রাজধানী শহরের পত্তন হলো, সেই থেকে সাড়ে তিন শ বছর আসল ঢাকা সেখানেই রয়ে গেল। রেললাইন, যা এখন লুপ্ত বা এখনকার নবাবপুর থেকে সদরঘাটই ছিল আসল ঢাকা, যার নাম আমরা দিয়েছি পুরান ঢাকা। নতুন ঢাকা গড়ে ওঠা শুরু করে ১৯০৫ সালে রমনাকে কেন্দ্র করে।

সে তো অনেক পুরোনো কথা। আমাদের কথাই বলি। গত শতকের সত্তর দশকে যখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন এই নতুন ঢাকার পরিধিই–বা ছিল কতটুকু? এখন যে রাস্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সোজা ফার্মগেট হয়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরে গেছে, সে রাস্তা ছিল সরু। ওই রাস্তা ধরেই তেজগাঁও পৌঁছাতে হতো। মনে হতো কত লম্বা রাস্তা। সে রাস্তা ধরে এগোলে ডান পাশে পড়ত মোগল আমলের একটি মসজিদ। আর তার আশপাশের জায়গাটুকু পরিচিত ছিল কারওয়ান বাজার নামে। ছোট বাজার। আশপাশে প্রায় বিরান। 

কাওরান বাজারের পত্তন সেই মোগল আমলে। মোগল আমলে ঢাকার বিস্তার ছিল মিরপুর পর্যন্ত। আসল ঢাকা নবাবপুর থেকে সদরঘাট। রমনায় অভিজাত দুটি পাড়া। আর তারপর ক্যানেল বা খাল। রাস্তা তো তেমন ছিল না।

বাহন ছিল হাতি, ঘোড়া, পালকি আর নৌকা। এই নৌকায় করে মিরপুর, বাড্ডা বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া যেত। দুপাশে ছিল জঙ্গল। মিরপুর ছিল ছোটখাটো বন্দর। অনুমান করে নিচ্ছি, মিরপুর বা আরও দূর থেকে যারা আসত হাতি-ঘোড়ায় চড়ে বা হেঁটে বা নৌকায়, তাদের নামতে হতো এই কারওয়ান বাজারের মোড়টায়। মোগল আমলে এখানে ছিল একটি চৌকি (থানা)। শহরে ঢোকার মুখে এই নিরাপত্তাচৌকিতে সবাইকে পরীক্ষা করা হতো। শহর নদীর তীরে বটে। কিন্তু রমনা, বকশীবাজার বা উমরাপুরে (নবাবপুর) তো থাকেন অভিজাতরা। তাঁদের নিরাপত্তার একটা ব্যাপার তো ছিলই।

সৈয়দ মোহাম্মদ তাইফুর লিখেছেন, এই চৌকির পাশে ছিল একটি কারওয়ান সরাই বা সরাইখানা। শহরে ঢোকার আগে পথিক এখানে জিরিয়ে নিতেন, খাওয়াদাওয়া করতেন বা থাকতেন। আবার মাঝে মাঝে বণিকেরা কাঁরাভা (কারাভান) নিয়ে যখন আসতেন, তখন হয়তো নামতেন এই চৌকিতে। সেই কাঁরাভা থেকেও তো হতে পারে কারওয়ান বাজার। তাইফুরের কথা ধরলে মনে হয়, খুব সম্ভবত এই কারওয়ান সরাই কালক্রমে পরিচিত হয়ে উঠেছে কারওয়ান বা কাওরান বাজার নামে। নামটি সেখান থেকে এলেও বাজারের বয়স খুব বেশি নয়, ৬০-৭০ বছর মাত্র। 

ঔপন্যাসিক রিজিয়া রহমান ১৯৪৮ সালে ঢাকায় আসেন প্রথম। তাঁর স্মৃতিতে আমরা অন্য রকম এক কারওয়ান বাজারের চিত্র পাই। লিখেছেন তিনি, ‘সামনে জনহীন ময়মনসিংহ সড়ক (এখনকার গ্রিন রোড যা কুলি রোড নামেও পরিচিত ছিল) খোলা উদার প্রান্তরে রোদ পোহাচ্ছে। দুপাশে তার জলাশয়। ধানক্ষেত, বিল। কারওয়ান বাজারে আম্বর শাহের পুরনো মসজিদের কাছে হাতির পিঠের মতো উঁচু পুলের নিচে দিয়ে কারওয়ান বাজারের খালের দিকে ভেসে আসছে শালবোঝাই নৌকা। রাস্তার ঢাল যেখানে ঝিলে নেমেছে, সেখানে ভিড়ে আছে সেই ছোট–বড় নৌকার সারি। কিছুটা সামনে রোডের ওপরই ধান শুকোতে দিয়েছে কেউ, গরুর পাল শিষ্ট গতিতে হেঁটে চলেছে। গাড়ি, বাস-ট্রাক-রিকশা দূরে থাক, একটি পালকি গাড়িও চোখে পড়ে না। চারধারে ধূ ধূ খোলা। গাছ-গাছালি, জলো ঘাস, ঢোলকলমি, বইন্যা ঝোপে দোলা দিয়ে ছুটে বেড়ায় ভেজা মাটি আর বিলের জলজ গন্ধ ভরা বাতাস। অর্থাৎ পঞ্চাশ দশকেও
বাজারের সামনের যে খাল, তাতে (সোনারগাঁও হোটেলের পাশে) পণ্য বা মানুষ নিয়ে নৌকা ভিড়ত এখানে।’ 

সেই মোগল আমলেই যখন সরাইখানায় পথিক আসত, বিশ্রাম নিত, তাদের জন্য একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। তিন গম্বুজওয়ালা শায়েস্তাখানি স্থাপত্যের অনুসরণে নির্মিত মসজিদটি পরিচিত ছিল খাজা আম্বরের মসজিদ নামে। পাশে ছিল বাগান, খাজা আম্বরের বাগান। ওই আমলে সারা ঢাকায়ই ছিল বাগান। এখন অবশ্য মসজিদটি পরিচিত কাওরান বাজার মসজিদ নামে। তিন দশক আগেও সাধাসিধে মসজিদটি রাস্তা থেকে চোখে পড়ত। এখন সংস্কারের ফলে তার আসল রূপ অনেকটা হারিয়ে গেছে।

এই মসজিদের শিলা লেখাটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন বিখ্যাত ভাষাবিদ ঢাকা কলেজের একসময়ের শিক্ষক হরিনাথ দে। আর ওই  শিলা লেখার বাংলা অনুবাদ করলে তা দাঁড়াবে এমন: 

 ‘অরঙ্গজেবের রাজত্বকালেই তার মহত্ত্ব চারপাশে প্রকাশিত হচ্ছিল। শায়েস্তা খানের সময়ে বাংলা ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল উন্নতির দিকে । এ সময়ই আম্বার বাগান, মসজিদ, সেতুসহ নানা কিছু নির্মিত হয়। এসব গড়ে ওঠার পর মসজিদের ইমাম সাহেব প্রার্থনা করেন, “সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এই আম্বর ব্রিজ ও মসজিদ যেন অনেককাল টিকে থাকে।”  

খাজা আম্বর ছিলেন শায়েস্তা খানের খোজা প্রধান। মসজিদটি তিনি নির্মাণ করেছিলেন ১৬৭৯-৮০ সালে। প্রাচীনত্বের দিক থেকে ঢাকার মসজিদগুলোর মধ্যে এর স্থান দ্বাবিংশতম। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য কালো পাথরের তৈরি মেহরাব, যা আনা হয়েছিল রাজমহল থেকে। খাজা আহ্‌ছানউল্লা মসজিদটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কিছু জমি ওয়াক্ফ করে দিয়েছিলেন। স্থানীয় মানুষ তখন চাঁদা তুলে মসজিদটি সংস্কারও করিয়েছিলেন। বলা ভালো, এই মসজিদের পাশেই সমাহিত আছেন খাজা আম্বর। 

রমনা থেকে যাঁরা মসজিদে আসতেন, তাঁদের জন্য খাজা আম্বর সুন্দর একটি পুল নির্মাণ করে দিয়েছিলেন বর্তমান ইস্কাটন খাল বা নালার ওপর, সোনারগাঁও হোটেলের পাশে। গত শতকের ষাটের দশকে রাস্তা প্রশস্ত করার সময় পুলটি ভেঙে ফেলা হয়। 

এখনো যখন কারওরান বাজারের পাশ দিয়ে যাই, তখন মনে হয়, কবে এই বাজার অপসারণ করা হবে। এখানে হবে সাংস্কৃতিক বলয়। বাগান, ফোয়ারা আর সবুজ ঘাসে ঢাকা চত্বরের পাশে থাকবে রঙ্গালয়, বইয়ের দোকান, বুটিক শপ, রেস্তোরাঁ। ঢাকা শহরের বাসিন্দারা এখানে আসবে অবকাশে। ঝলমল করা এলাকাটি ঢাকাকে করে তুলবে বৈশিষ্ট্যময়। এ রকম কথা দিয়েছিল সরকার। সরকার কি কথা রাখবে?